চীনের বিনিয়োগ: দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার জন্য আর্শীবাদ না অভিশাপ?

আমাদের এই পোস্ট আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিশেষ কভারেজ এর অংশ।

গত মে মাসে মিয়ানমারের বিদ্যুৎ সংকট নিয়ে জনগণের স্বত:স্ফূর্ত বিক্ষোভ পত্রপত্রিকাগুলো ফলাও করে প্রচার করেছে। কারণ সরকার খুব কম সময়েই সরকারবিরোধী কার্যকলাপকে অনুমোদন করে থাকে। এমনকি এই বিক্ষোভ হয়েছে মিয়ানমারের রাজধানী ইয়াঙ্গুনে। বিক্ষোভকারীরা চীনের কাছে বিদ্যুত বিক্রি করা নিয়ে সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়েছে।
মিয়ানমারের সবচেয়ে বড়ো বেসরকারি মিডিয়া সংস্থা ইলেভেন মিডিয়া গ্রুপ [মিয়ানমার ভাষায়], এর পাতায় নিচের মন্তব্য প্রকাশ পেয়েছে, যেখানে জনগণের আবেগ উঠে এসেছে:

মিয়ানমারের ৭০% বিদ্যুৎ আসে লাও পি তা এবং ইয়ে ইওয়ার জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের মাধ্যমে। শায়ে লি কেন্দ্রের বিদ্যুৎ চীনে সরবরাহ করা হয়। সেজন্য ইয়াঙ্গুনে বিদ্যুৎ ঘাটতি হয়। তাই চীনের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করো।

Protest against electricity shortages around City Hall, Yangon. Image from Facebook page of CJMyanmar.

ইয়াঙ্গনের সিটি হলের সামনে বিদ্যুৎ সঙ্কটের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ। ছবি সিজেমিয়ানমারের ফেসবুকের পাতা থেকে নেওয়া।

শতাব্দীকাল ধরে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সাথে চীনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে চীনের ব্যাপক প্রবৃদ্ধি দেশটিকে এই অঞ্চলের নেতৃত্বশীল বিনিয়োগকারী দেশে পরিণত করেছে। জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়ার পরে মালয়েশিয়ায় তৃতীয় বৃহত্তম বিনিয়োগকারী দেশ হলো চীন।

গত ১৫ বছরে কম্বোডিয়ায় ৮.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করে দেশটির সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগকারী হয়েছে। গত বছর থাইল্যান্ড এবং ভিয়েতনামকে পেছনে ফেলে লাওসে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করেছে চীন।

চীন এ অঞ্চলে বড় বড় খাতে বিনিয়োগ করছে। খাতগুলোর মধ্যে রয়েছে জলবিদ্যুত, খনি, নির্মাণ, কুষি, যোগাযোগ এবং অবকাঠামো রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে বিনিয়োগকে সবসময় স্বাগত জানানো হয়। কারণ এতে করে কর্মসংস্থান সুযোগ তৈরির মাধ্যমে স্থানীয় অর্থনীতিতে এর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। এ অঞ্চলে চীনের আগ্রাসী অর্থনৈতিক সম্প্রসারণের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে কথা উঠেছে। এই নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জাতীয়তাবাদকে উস্কে দিচ্ছে। যেমন, স্থানীয় শিল্পপতিরা বিদেশীদের সাথে প্রতিযোগিতাকে প্রত্যাখান করেছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ যারা চীনের বিনিয়োগের কারণে ঘরবাড়ি ছাড়া হয়েছে, তাদের কাছে এটা বেঁচে থাকা এবং মানবাধিকারের ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে।

চীন ভিত্তিক বৃহৎ জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র

Ayeyarwaddy River, Myanmar. Photo from Flickr page of DamienHR used under CC license Attribution-ShareAlike 2.0 Generic (CC BY-SA 2.0).

ইরাবতি নদী, মিয়ানমার। ছবি ডিমেইনএইচআরের ফ্লিকার পেজ থেকে সিসি লাইসেন্স অ্যাট্রিবিউটন-শেয়ারঅ্যালাইক ২.০ আওতায় প্রকাশিত। (সিসি বিওয়াই-এসএ ২.০)।

জনগণের আন্দোলনের মুখে মিয়ানমার সরকার ইরাবতি নদীতে চীনের অর্থায়নে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ বাতিল করেছে। কারণ এই জলবিদ্যুৎ নির্মাণের কারণে কয়েক হাজার গ্রামবাসী উচ্ছেদ হয়েছিল। এটাই প্রথম ঘটনা যেখানে জান্তা সরকার নাগরিক সমাজের দাবিকে মেনে নিলো। এই প্রকল্প বাতিল করায় জনগণের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে, তা ১১-মিডিয়া.কম ওয়েবসাইটে নিচের মন্তব্যে [মিয়ানমার] ফুটে উঠেছে:

জনগণের ইচ্ছাকে মূল্য দিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ায় মাননীয় প্রেসিডেন্টকে সর্বান্তকরণে ধন্যবাদ জানাই। এটা চীনের দীর্ঘমেয়াদি বিদ্যুত চাহিদায় প্রভাব ফেলবে। এটা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমারকে প্রতিরোধ করতে পারে। তাছাড়া ইতোমধ্যে যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, তা প্রত্যাখ্যানের সামিল।

কম্বোডিয়ার ভুমি সমস্যা

কম্বোডিয়ার কৃষকরা চীন কর্তৃক তাদের জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে কথা তুলেছে। কম্বোডিয়ার সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটস-এর মতে, ১৯৯৪ সাল থেকে কম্বোডিয়া সরকার চীনের ১০৭টি প্রতিষ্ঠানকে ৪৬১৫৭৪৫ হেক্টর জমির অনুমোদন দিয়েছে। এর মধ্যে ৩৩৭৪৩২৮ হেক্টর বনভুমি এবং ৯৭৩, ১০১ হেক্টর অর্থকরী ভুমি এবং ২৬৮৩১৬ হেক্টর খনিজ এলাকা রয়েছে।

Land disputes often lead to militarization in Cambodia. Photo from Licadho.

ভুমি বিরোধ প্রায়ই কম্বোডিয়া সামরিকায়নের সম্ভাবনা তৈরি করে। ছবি লিকাঢো থেকে নেয়া।

এই প্রবন্ধে সাংবাদিক অ্যালেক্স ওয়াটস ব্যাখ্যা করেছেন, কেন কম্বোডিয়ার সরকারের কাছে চীন আকর্ষণীয় বিনিয়োগকারী:

কম্বোডিয়ায় বেড়াতে যেতে চাইলে খুব শিগগিরই বোধহয় চীনের ভিসা নিয়ে যেতে হবে। কারণ, এশিয়ার এই পরাশক্তির কাছে কম্বোডিয়া বিপুল পরিমাণ জমি বিক্রি করেছে।

কিছু কিছু কর্মকাণ্ড দেখে মনে হচ্ছে কম্বোডিয়ার বেশিরভাগ জাতীয় উদ্যান এবং পশুপাখির অভয়ারন্যগুলো চীনা বিনিয়োগকারীদের কাছে বিক্রি করে দেবে।

কম্বোডিয়ার সরকারের কাছে চীন আকর্ষণীয় বিনিয়োগকারীর হওয়ার কারণ হলো চীন দেশটির সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী, বিপুল পরিমাণ বিদেশী সাহায্যের উৎসও তারা। এবং এই টাকা পশ্চিমাদের চেয়ে কম সুদে তারা দিয়ে থাকে। আর তাই মানবাধিকার এবং গ্রামবাসীর উচ্ছেদের কথা যখন আসে, তখন এটা তুচ্ছই মনে হয়।

ফিলিপাইনে বিনিয়োগ

চীন ফিলিপাইনে যে পরিমাণ বিনিয়োগ করেছে, তার উল্লেখযোগ্য অংশের বিরুদ্ধেই ইতোমধ্যে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। চীনের একটি প্রতিষ্ঠান কাজ পেতে সরকারি কর্মকর্তাকে ঘুষ দিয়েছে, এমন অভিযোগের ভিত্তিতে ফিলিপাইন সরকার প্রস্তাবিত ন্যাশনাল ব্রডব্যান্ড নেটওয়ার্ক এবং নর্থরেইল প্রকল্প বাতিল করেছে। এমনকি ফিলিপাইনের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তিনি টাকার বিনিময়ে বড় বড় প্রকল্প পেতে চীনকে সহযোগিতা করেছেন।

Chinese firm ZTE was embroiled in a corruption scandal in the Philippines

 ফিলিপাইনে চীনা প্রতিষ্ঠান জেডটিই  দুর্নীতে জড়িয়ে পড়েছে।

একজন সিনেটর ফিলিপাইনের মূল কৃষিজমি চীনা প্রতিষ্ঠানের কাছে লিজ দেয়ার বিতর্কিত চুক্তি ফাঁস করে দিয়েছেন। সিনেটর এই চুক্তির বিরুদ্ধে সাংবিধানিক এবং সার্বভৌমত্বের ইস্যু তুলে ধরেছেন। ফিলিপিনো জনগণ শুরুতেই অতিমূল্যের উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রকল্প বাতিলের দাবি জানায়। কিন্তু এই চুক্তি দেশে চীনা বিনিয়োগ আসার ওপরও প্রভাব ফেলে। এটা দুই দেশের সম্পর্কের ওপর কতটা প্রভাব ফেলে তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ব্লগার বং মেনদোজা:

চীন- ফিলিপাইন সম্পর্ক আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে একেবারে তলানির দিকে রয়েছে। ১৯৯৫-১৯৯৭ সালে মিসশেফ রিফ সংকটের সময়ও দু’দেশের মানুষে মানুষে মিল ছিল, অর্থনৈতিক সুসম্পর্ক বজায় ছিল। এখন নানা ধরনের দুর্নীতির কারণে চীনের সাথে অর্থনৈতিক সহযোগিতা প্রশ্নের মুখে পড়েছে।

কোনো সন্দেহ নেই যে অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে চীনের আবির্ভাব দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার প্রতিবেশীরা নানাভাবেই লাভবান হবে। কিন্তু চীনের সম্প্রসারণশীল অর্থনীতির ধাক্কা কী ধরনের অসামঞ্জস্যতা তৈরি করে তার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। চীন আধিপত্য বিস্তারের জন্য দক্ষিণপূর্ব এশিয়াকে অন্য একটি বাজার হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না। তবে এ অঞ্চলের পুরোনো ব্যবসায়িক অংশীদারের সাথে এর অনন্য ঐতিহ্য, প্রথা এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থারও সঙ্গী হবে।

অতি সংক্ষেপে চীনের টাকা দরিদ্র গ্রামবাসীর কাছ থেকে বর্ধিষ্ণু সম্প্রদায়ের কাছে যেতে পারে। তবে এই অর্থ পরিবেশ ধ্বংস, নাগরিক অধিকার লঙ্ঘন এবং এ অঞ্চলে ভয়াবহ দুর্নীতির কাছে ব্যবহার হতে পারে। চীন জোরপূর্বক যে অর্থ বিনিয়োগ করেছে, তার প্রভাব যদি সনাক্ত করতে না পারে, তবে দক্ষিণপূর্ব এশিয়া অন্য কোনো বিনিয়োগকারী খুঁজতে পারে।

ISN logoআন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং নিরাপত্তা ইস্যুতে বিশ্ববাসী নাগরিক কণ্ঠস্বর খোঁজার অভিপ্রায়ে ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল (আইএসসি) এই পোস্ট এবং স্প্যানিশ, আরবি এবং ফরাসি ভাষায় এর অনুবাদ অনুমোদন দিয়েছে। এই পোস্ট প্রথম প্রকাশিত হয় আইএসএন ব্লগে। এ ধরনের আরো লেখা দেখুন এখানে

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .