দুনিয়ার স্বল্প সংখ্যক দেশগুলোর মধ্যে মলদোভা হল অন্যতম রাষ্ট্র যারা ভাষা দিবস পালন করে এবং নিজ ভাষায় কথা বলার দাবি প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের এ দিনটিকে জাতি এ ছুটির দিন হিসেবে পালন করে থাকে।
বিশ বছর আগে ১৯৮৯ সনের ৩১ আগস্ট তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ হিসেবে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মাধ্যমে মলদোভা রোমানীয় ভাষাকে তাঁদের রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে এবং পুরোনো ল্যাটিন বর্ণমালায় ফিরে যায়। সোভিয়েত শাসনামলে এ রাষ্ট্রকে প্রায় ৫০ বছর ধরে সাইরিলিক বর্ণমালা ব্যবহারে বাধ্য করে এবং বিরতিহীনভাবে মলদোভীয় ভাষাকে রোমানীয় ভাষার অপভ্রংশ হিসেবে চালানোর অপচেষ্টা চালায়।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের বিশ বছর পরেও মলদোভার সরকারি ভাষা কি হবে সে বিষয়ে আজও বিতর্ক রয়েছে, সংবিধানে যদিও মলদোভীয় ভাষার কথা বলা হয়েছে তথাপি মলদোভার শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালিত হচ্ছে রোমানীয় ভাষায়, আর নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু সম্প্রদায় রুশ ভাষাকে দ্বিতীয় সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের দাবি জানাচ্ছে।
রোমানীয় ভাষা দিবস পালন ছাড়াও মলদোভীয় নেটিজেনরা ফেসবুকের মাধ্যমে [রো] সংবিধানের বিতর্কিত ১৩ অনুচ্ছেদে বর্ণিত “মলদোভীয় ভাষার পরিবর্তে “রোমানীয় ভাষা” প্রতিষ্ঠার দাবিতে কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবাদ জানিয়েছে।
আয়োজকগণ নিম্নের শ্লোগান দ্বারা অংশগ্রহণকারীদের উদ্বুদ্ধ [রো] করেছিলেন:
যে দাবিটি আপনার; রোমানীয় ভাষার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ দাবি করুন!
বিশ বছর ধরে মলদোভীয় সংবিধানে একটা অবিচার লিপিবদ্ধ হয়ে আছে, এটা আমাদের জাতির ঐতিহাসিক সত্যের পক্ষে ক্ষতিকর। গতকাল, আজ এবং আগামীতে যারা প্রতিদিন এ অবিচারের মধ্য দিয়ে বাস করছেন, তাঁরা এ অবিচারকে সহ্য করেছেন, মেনে নিয়েছেন, তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন, বিদ্রোহ করেছেন এবং এতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন কিন্তু আমরা আমাদের প্রজন্মের জন্য কি রেখে যাচ্ছি, আমরা কিভাবে শরমে আনত চোখে, কাপুরুষোচিত ভাবে তাদের চোখের দিকে তাকাবো?
আমাদের বাবা-মা রা সোভিয়েত সাম্রাজ্য ত্যাগের জন্য যুদ্ধ করেছেন আর আমরা কি তাঁদের নামের সেই গৌরবকে ধরে রাখতে পেরেছি?
নিম্নের এ বার্তাসমূহের [রো] মধ্য দিয়ে এ প্রতিবাদের সমাপ্তি ঘটে:
রোমানীয় প্রজাতন্ত্রে আমাদের প্রতিবেশীদের নৃতাত্ত্বিক ক্ষুদ্র গোষ্ঠীগুলোকে ( ইউক্রেনীয়, রুশ, বুলগেরীয়, গাগাউজ) এ নিশ্চয়তা দিচ্ছে যে রোমানীয় পরিচয়ের মনোভাব তাদের জন্য ক্ষতির কারন হবে না। আমাদের প্রত্যেককেই প্রত্যেকের সম্মান করা উচিত।
সারজিউ স্কারলাট এ বিষয়ে ফেসবুক পাতায় লিখেন [রো]:
অনুপ্রবেশকারীদের (রুশ বন্ধুদের) বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধ করতে হবে এবং তাঁদের কেউ যদি আলাদা করে আমাদের চিহ্নিত করে…. তবে তাঁদের পরিষ্কার করে দেখিয়ে দিতে হবে যে আমরা আমাদের ঘরেই থাকি এবং সেখানে আমরা রোমানীয় কিংবা নিদেনপক্ষে মলদোভীয় ভাষায় কথা বলি।
ফেসবুকে স্বাক্ষর করা প্রায় ১০০০ জনের মধ্যে প্রায় ২০০ জন গত ৩০ আগস্ট চিসিনাউয়ের বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করে।
বিক্ষোভকারীদের প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল:
ভাষা নাই তো ইতিহাসও নাই। রুটি আর সার্কাস ছাড়া আমরা কি থাকতে পারবো?
মলদোভীয় ভাষার বিশ বছর। আর কত বছর টিকবো?
মলদোভীয় ভাষা- দখলকালীদের আবিষ্কার?
রোমানীয় ভাষা আমার মাতৃভূমি!
এ অনুষ্ঠানটি মূলধারার মিডিয়াতে কভারেজ পেয়েছে।
ট্রিভিয়ান ভাসিলকাউ [রো] মলদোভায় বিদ্যমান রোমানীয় ভাষার বিষয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন:
অবমাননার ভিত্তি ভূমিতে দাড়ানো রোমানীয় ভাষার চোখ সামনে এক অন্ধকার সাগর দেখতে পাচ্ছে, সেটা এত বড় যে যে কেউ যে কাউকে চপেটাঘাত করতে পারে।
তিনি বলেন:
মলদোভা প্রজাতন্ত্রের স্বাধীনতা ঘোষণার দিন থেকে আমরা জানতাম বেসারবারিয়ান মিত্রের ১ শতাংশ এ ছদ্ম রাষ্ট্রের ভাষা জানে।
“ছদ্ম” কারন, রোমানীয় ভাষার চিরন্তন সমস্যা বৈজ্ঞানিক কল্প কাহিনীর উপন্যাসের অংশ।
এটা মলদোভীয় অসচেতন জনগণের এবং কম্যুনিস্ট পন্থী ও রোমানীয় [বেসারাবিয়া] সচেতন অংশের জন্য।
অ্যালেক্স কোজার পরিস্থিতিকে একইভাবে ব্যখ্যা [রো] করেন:
এখনও “স্বাধীনতা” বিষয়ের মত আমাদের “রোমানীয়” ভাষা দিবস উদযাপন একটা ভ্রান্ত বিষয় বাস্তবিক পক্ষে স্বাধীনতার মত রোমানীয় ভাষাকেও সম্মানের পরিবর্তে পদদলিত করা হয়েছে।
প্রধান ও প্রাধান্য বিস্তারকারী রোমানীয় চলচ্চিত্রের ভাষান্তর বা সাবটাইটেল প্রচারের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী যে অঙ্গীকার করেছিলেন তা পালন করার জন্য ব্লগাররা প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করেছেন। মলদোভার রাজধানীতে প্রদর্শিত চলচ্চিত্রগুলো কেবলমাত্র রাশিয়ান।
এ প্রতিবন্ধকতার অপর প্রান্তে ব্লগার নিকোল পাসকারু অন্য একটি বিতর্কে [রো] লিপ্ত। তিনি যুক্তি দেখান যে ভাষার নাম হবে মলদোভীয়, কারন সংবিধানে সেরকমই লেখা রয়েছে।
তাঁর চিন্তা ভাবনা থেকে বিষয়টি মুলত: জটিল। নিজেকে ইনফিনিট নামে পরিচয় দেন এমন একজন টুইটার ব্যবহারকারী বলেন [রো]:
জেনে দুঃখিত হবেন যে,সংবিধানে কিছু সমস্যা রয়েছে। আমি ভীত যে কিছু ভুল সেখানে রয়েই গেছে। এর মধ্যে মলদোভীয় ভাষা অন্যতম যদিও এটা কোন মারাত্মক ভুল নয়। মলদোভীয় সংবিধানে ১৯৯০ সাল থেকে ট্রান্সনিস্ট্রিয়ার নিয়ন্ত্রণ যে স্বঘোষিত বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা স্মিরনভ [ট্রান্সনিস্ট্রিয়া] এর নিয়ন্ত্রনে ছিল এবং সেনা বাহিনীর ইউনিটগুলো যে মলদোভার কোন প্রদেশে আসন গাড়তে পারেনি সে বিষয়ে কোন কিছু আমি মলদোভীয় সংবিধানে দেখিনি।
টুডর দারি নিন্দা জানিয়ে [রো]বলেন বাস্তবতা হল এই যে মলদোভীয় সংসদ সদস্যের কিছু অংশ রোমানীয় ভাষায় কথা বলতে পারেন না। তাঁর মতে এ সমস্যার সমাধান হল:
“সরকারি ভাষা” কে প্রচার ও রক্ষণের জন্য সরকার ও সংসদের প্রয়োজনীয় শর্তাবলি তৈরি করা প্রয়োজন এবং আমরা (যারা ঐতিহাসিক সত্যকে অনুসরণ করি) তাঁদের করুণা কামনা করা উচিত নয়, দরকার রোমানীয় ভাষার প্রতি সম্মান আরোপ!
করনেলিউ গ্যানদ্রাবুর তাঁর ব্লগ পোস্ট-এ[রো] ৩১ আগস্ট,১৯৮৯ সালে ফিরে যান:
৩১ আগস্ট, ১৯৮৯ সালে আমি ২ বছর ৯ মাস বয়সের ছিলাম; সম্ভবতঃ আমি তখন রোমানীয় ভাষা বলতাম। সেদিন আমি যখন লেনিন স্ট্রীটে আমার বাড়ীর সামনে বালু নিয়ে খেলছিলাম তখন কিছু লোক একই স্বরে রোমানীয় ভাষা আর লাতিন বর্ণমালার দাবি জানাচ্ছিল। তাঁরা যা চেয়েছিল তা তাঁরা পেয়েছে,কিন্তু তা কেবল বছরে একবার মাত্র সে ভাষায় কথা বলার অধিকার আদায়ের মধ্য দিয়ে […] এভাবে আমরা আর কত দিন বছরে মাত্র একদিন রোমানীয় ভাষায় কথা বলবো? প্রশ্নটা আমার জন্যেও জটিল,যারা বর্তমানে ক্ষমতায় আছেন তাঁদের বিষয়ে আমি লিখতে আগ্রহী নই!
আলেক্সান্দ্রু তানাসি তাঁর ফেসবুক দেওয়ালে লিখেন [রো]:
৮৯ সালে রোমানীয় ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা ও লাতিন বর্ণমালায় ফেরত যাবার করার দাবিতে হাজারো লোকের লড়াইয়ে আমিও চত্বরে [জাতীয় চত্বর] ছিলাম। প্রকৃতপক্ষে এ লড়াই কেবলমাত্র রোমানীয় ভাষাকে জনজীবনে ফিরিয়ে দেবার লড়াই ছিল না, ৮৯ সালে আমরা সকল মানবাধিকার, মূল্যবোধ এবং মর্যাদার সার্বিক সংগ্রাম করেছি। সবাইকে অভিনন্দন!