সম্প্রতি জনপ্রিয় আর ব্যাপক ব্যবহৃত বিনামূল্যের বাংলা ইনপুট সিস্টেম ‘অভ্র’কে জনপ্রিয় বাণিজ্যিক বাংলা ইনপুট সিস্টেম ‘বিজয়’ এর চুরি করা সংস্করণ আর অভ্রের নির্মাতা দলকে হ্যাকার বলায় প্রতিবাদে মুখর হয়েছে বাংলা ব্লগ জগৎ আর বাংলাদেশী ফেসবুক ব্যবহারকারীরা।
বাংলা দৈনিক পত্রিকার একটি প্রতিবেদনে ‘বিজয়’ এর স্বত্বাধিকারী আর বাংলা কম্পিউটিং এর প্রথম সারির একজন মুস্তাফা জব্বার বলেছেন যে ইন্টারনেটে তার বিজয় সফটওয়্যারের চুরি করা সংস্করণ ছড়ানোতে হ্যাকারদের অবদান আছে। তিনি আরো বলেছেন জাতীয় পরিচয়পত্র ও ভোটার লিস্টের প্রকল্পের কাজের জন্য বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন যে এইসব হ্যাকারদের বেছে নিয়েছে তা হয়েছে ইউএনডিপির প্ররোচনায়।
এখানে উল্লেখ করা প্রযোজন যে বাংলাদেশে ১৯৮৪ থেকে ২০০২ সালের মধ্যে ২০টি বাংলা ইনপুট সফটওয়্যার স্বত্বাধিকার পণ্য হিসেবে বাজারে এসেছে আর এই সময়কালে সব থেকে জনপ্রিয় ছিল মুস্তাফা জব্বারের ‘বিজয়’ সফ্টওয়্যারটি। অনেক নির্মাতা এর বিভিন্ন সংস্করণের উপরে কাজ করেছে।
এটা সত্ত্বেও বাংলা কম্পিউটিং এ আসল জোয়ার এসেছে যখন ২০০৩ সালে বাংলাদেশী একজন চিকিৎসাবিদ্যার ছাত্র মেহেদি হাসান খান অভ্র তৈরি করেন ইউনিকোড মান ব্যবহার করে। অভ্র ক্লোজড সোর্স (কোড উন্মুক্ত নয়) তবে বিনামূল্যে বিতরণ যোগ্য গ্রাফিক কিবোর্ড লেআউট পরিবর্তনকারী একটি সফ্টওয়্যার। গত ছয় বছরে মেহেদি আর তার বন্ধু রিফাতুন্নবি, তানভির ইসলাম সিয়াম, রায়ান কামাল, শাবাব মুস্তাফা আর নিপুন হক এটাকে আরো উন্নত করেছেন।
বিজয় আসকি নির্ভর ব্যক্তিমালিকানার একটি বাংলা ইনপুট সিস্টেম সফটওয়্যার আর এটা ব্যবহার করতে একটি লাইসেন্স কিনতে হয়। অন্যদিকে অভ্র ইউনিকোড নির্ভর – বিনামূল্যে বিতরণকৃত সফ্টওয়্যার – যেটাতে চারটা কিবোর্ড লেআউট চারটা ভিন্ন ইনপুট সিস্টেমের সুবিধা দেয়- অভ্র ফোনেটিক, বর্ণনা, জাতীয় আর ইউনিবিজয়। এর মধ্যে অভ্র ফোনেটিক ইনপুট সিস্টেম সব থেকে জনপ্রিয় আর বহুল ব্যবহৃত- বিশেষ করে প্রবাসি বাঙ্গালী দ্বারা যাদের কাছে বাংলা কিবোর্ড নেই। অভ্র ফোনেটিক ব্যবহার করে ইংরেজী কি বোর্ড থেকে ট্রান্সলিটারেশন সিস্টেম তারা রোমান হরফ থেকে সহজে বাংলা শব্দ তৈরি করতে পারেন।
জনাব জব্বারের অভিযোগের পরে বাংলা ব্লগ জগৎ দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। আমরা বন্ধু ব্লগে লোকেন বোস জনাব জব্বারকে চ্যালেঞ্জ করেছেন প্রমান করতে যে অভ্র চুরি করা সফটওয়ার। তিনি লিখেছেন:
কম্পিউটারে বাংলা লেখায় বিজয় মাইল ফলক হয়ে এসেছিলো। বিজয়ের অবদানকে অস্বীকার করার কিছু নেই। এখনো প্রফেশনাল প্রিন্টিংয়ের কাজে বিজয়ের বিকল্প নেই।
কিন্তু ইন্টারনেটের এই প্রসারের যুগে বিজয় ধীরে ধীরে অকেজো হয়ে যাচ্ছে। [..] তাই নতুন সময়ের দাবীতেই এলো অভ্র। মেহদী হাসান খান নামের এক তরুণ সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে তৈরি করলেন অভ্র নামক একটি সফটওয়্যার। এবং যা তিনি বিনামূল্যে ছড়িয়ে দিলেন সমস্ত বিশ্বে। যে কেউ চাইলেই এই সফটওয়্যার ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করে ব্যবহার করতে পারবেন।
অভ্রর জনপ্রিয়তা এখন আকাশচুম্বী। ধীরে ধীরে শুরু হয়ে গেছে বিজয় বর্জন। [..] মোস্তফা জব্বার শঙ্কিত। তাই এই মিথ্যাচার। নির্বাচন কমিশন যখন ভোটার আইডির কাজে বিজয় না ব্যবহার করে অভ্র ব্যবহার করলো, তখনই তার গাত্রদাহ প্রবল হয়েছিলো। [..] আর পাশাপাশি নিজের খ্যাতিকে কাজে লাগিয়ে চালিয়ে যাচ্ছেন অভ্রর বিরুদ্ধে মিথ্যাচার। আর এই করে করে তিনি নিজেই নিজেকে হাস্যকর প্রমাণ করছেন, আমাদের যেখানে উনাকে শ্রদ্ধা করার কথা ছিলো, সেখানে এখন তার প্রতি ঘৃণা তৈরি হচ্ছে।
সচলায়তন ব্লগে অভ্রনীল জানিয়েছেন:
বাংলাদেশের ইতিহাসে এই পর্যন্ত বাংলায় ডিজিটাল তথ্য সংগ্রহের সব চাইতে বড় প্রকল্প ‘ভোটার তালিকা ও জাতীয় পরিচয়পত্র প্রস্তুতকরণ’ প্রকল্পে অভ্র ব্যবহার করা হয়েছিল। তাদের প্রথম পছন্দ বিজয় হলেও বিজয়ের প্রস্তুতকারক কম্পানি বিজয়ের জন্য কম্পিউটার প্রতি পাঁচ হাজার টাকা লাইসেন্স ফি চেয়েছিল যা পরে বাতিল করে দিয়ে অভ্র ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এ জন্য নির্বাচন কমিশনের অভ্রকে দেয়া একটা স্বীকৃতি মুলক সনদের জন্য একটা কাগজ আর সামান্য কালি ছাড়া আর কিছুই খরচ করতে হয় নি।
জনাব জব্বারের দাবি হল ইউনিবিজয় কিবোর্ড ব্যবস্থা, যা অভ্রর চারটের মধ্যে একটা কিবোর্ড, তার বিজয় কিবোর্ড লেআউটের চুরি করা সংস্করণ যেটা তিনি কয়েক বছর আগে স্বত্ব করিয়েছেন। মেহদি হাসান খান তার ব্লগে জনাব জব্বারের অভিযোগের উত্তর এভাবে দিয়েছেন:
মোস্তফা জব্বার তার লেখায় ঢালাওভাবে পুরো অভ্র কীবোর্ডকেই “পাইরেটেড” হিসেবে অভিযুক্ত করেছেন। মজার ব্যাপার হল, মানুষজন অভ্র কীভাবে পাইরেটেড প্রশ্নটা করে তাকে চেপে ধরার পর তিনি বললেন অভ্র নিয়ে তার আপত্তি নেই, অভ্রতে ইউনিবিজয় নামে যে কীবোর্ড লেআউট আছে ঐটা তার বিজয় লেআউট থেকে চুরি করা। চমৎকার, আসুন দেখি কী করলে একটা কপিরাইটেড/পেটেন্ডেড লেআউট (অথবা সেটার প্রয়োগ) এ আমরা চুরির অভিযোগ দিতে পারি।
১) অবিকল লেআউট স্বত্বাধিকারীর অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে:
অনুমতির প্রসঙ্গ যখন উঠলই তখন বলি, ২০০৩ সালে অভ্র ডেভেলপের পরিকল্পনা করার সময় আমি ফোনে মোস্তফা জব্বারের কাছে বিজয় লেআউট ব্যবহারের অনুমতি চেয়েছিলাম। তিনিও তার জবাব জানিয়ে দিয়েছিলেন, তাকে টাকা না দিলে তিনি অনুমতি দিবেন না। বেশ ভালো কথা, আমিও বিজয় কীবোর্ড অভ্রর সাথে দেইনি। [..] ইউনিবিজয় আর বিজয় কোনদিনই এক কীবোর্ড লেআউট ছিল না, এখনও নেই। যেখানে একটা কী এর পার্থক্য একটা আলাদা লেআউটের জন্ম দেয়, ইউনিবিজয়ের সাথে বিজয়ের সেখানে অন্তত ৮ টি কীতে পার্থক্য রয়েছে।
২) ফিজিক্যাল লেআউট অনুমতি ছাড়া বিতরণ করলেঃ
প্রশ্নই আসে না। অভ্র কীবোর্ড একটা সফটওয়্যার মাত্র, এর সাথে বিজয় লেআউট ছাপানো কোন কীবোর্ড আমরা বিতরণ করি না।
৩) কীবোর্ড ইন্টারফেস প্রোগ্রামের কোড অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলেঃ
আবারো বলি, এই পয়েন্টও খাটে না। বিজয় ক্লোজড সোর্স, সেটার সোর্স থেকে অভ্র ডেভেলপ করা সম্ভব না। কীভাবে বিজয় হ্যাক করে অভ্র বানানো হল তার ব্যাখ্যা আপনার কাছে দাবী করছি।
বিস্তারিত তথ্যের জন্য তার লেখাটি পড়ুন।
প্রযুক্তি ফোরামের জাহিদ সুমন ইউনিবিজয় আর বিজয়ের মধ্যকার পার্থক্য দেখিয়েছেন। কয়েকটি বিষয় এখানে তুলে ধরা হল:
* অভ্রতে জব্বার সাহেবের একটি ফন্টও কাজ করে না। তাই অভ্র ফন্ট পাইরেসী থেকে মুক্ত। সে সর্বদাই ইউনিকোড বেজড মুক্ত ফন্ট এর উপর নির্ভরশীল।
* অভ্রের লিনাক্স ভার্সন রয়েছে কিন্তু বিজয় শুধুমাত্র ম্যাক ও উইন্ডোজে চলে।
নাম করা উকিপিডিয়ান রাগিব হাসান মেহেদির প্রতিবেদনের ব্যাপারে একটি মন্তব্য করেছেন:
২০০৬ সালে যখন বাংলা উইকির কাজ শুরু করি, তখন বাংলা টাইপিং এ অভ্যস্ত ছিলাম না মোটেও। আমাদের উইকির কর্মী যারা আছেন, তাঁদের প্রায় সবাইই বাংলা লিখতে শিখেছেন অভ্র ফোনেটিকে। আজ বাংলা উইকিতে ২০,০০০ ভুক্তি আছে, যার প্রায় সবটাই লেখা হয়েছে অভ্র দিয়ে। আগামী প্রজন্মের কাছে বাংলায় তথ্য রেখে যাওয়ার এই প্রয়াসে অভ্র তাই রেখেছে এক বিশাল অবদান।
বাংলাদেশী নেট নাগরিকরা ফেসবুক আর ব্লগে অভ্রর জন্য তাদের সমর্থন দেখাচ্ছেন। এমনটি আগে দেখা যায়নি যে তিনটা বাংলা ব্লগিং প্লাটফর্ম সচলায়তন, আমার ব্লগ আর আমরা বন্ধু তাদের ব্যানার অভ্র লোগোতে পরিবর্তন করেছেন জনাব জব্বারের দাবির প্রতি প্রতিবাদ দেখাতে।
মানুষ ফেসবুকে দল গঠন করছেন আর তাদের ফেসবুক স্ট্যাটাস পরিবর্তন করছেন অভ্রর সাথে একাত্মতা দেখাতে। এখানে সেরকম দুটি স্ট্যাটাস বার্তা দেয়া হল:
নজরুল ইসলাম ভাষা হোক উন্মুক্ত। কোনো বেনিয়ার কাছে আমার মাতৃভাষাকে ইজারা দেবো না… কক্ষণো না
অমি রহমান পিয়াল: রক্ত দিয়ে যে অক্ষর কিনেছি তার জন্যে যে বেনিয়া টাকা খোঁজে তাকে ধিক্কার। ভাষা হোক উন্মুক্ত।