বাংলাদেশ: বব্স-এ বাংলা ব্লগ- আলি মাহমেদের সাথে পরিচিত হউন

ডয়েশে ভেলের ২০১০ সালের সেরা আন্তর্জাতিক ব্লগ পুরস্কার (দি বেস্ট অফ ব্লগস বা বব্স ), বাংলাদেশ, ভারত ও সারা বিশ্বের প্রবাসী বাঙ্গালী ব্লগারদের জন্য এক বিশেষ গুরুত্ব বহন করছে। ষষ্ঠবারের মত অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া এই বব্স প্রতিযোগিতায় এই প্রথম বাংলা ব্লগ অর্ন্তভুক্ত হয়েছে। সারা বিশ্বে প্রায় ২৩০ মিলিয়ন (২৩ কোটি প্রায়) লোক বাংলা ভাষায় কথা বলে, যার ফলে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বলা ভাষাগুলোর মধ্যে বাংলা অন্যতম। এই পুরস্কারের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে এই কারণে যে, আমরা এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ বা ভারতের কোথাও সমস্ত বাঙ্গালী জাতির জন্য কোন সফল সেরা বাংলা ব্লগ প্রতিযোগিতার দর্শন পাইনি।

মনোনয়ন প্রাপ্ত ১১ জন বাংলা ব্লগার বিভিন্ন প্রেক্ষাপট থেকে এসেছে, এদের মধ্যে গ্লোবাল ভয়েসেস বাংলা লিঙ্গুয়ার অনুবাদক কৌশিকও রয়েছেন।

Ali Mahmed (Shuvo)

আলি মাহমেদ(শুভ)

আজ আমরা আলি মাহমেদ (শুভ)-কে আপনাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি, যিনি বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের একটি সীমান্ত এলাকা আখাউড়া উপজেলার গঙ্গাসাগর ইউনিয়ন থেকে ব্লগ লিখেন। সম্প্রতি যারা এই প্রতিযোগিতায় সেরা বাংলা ব্লগার হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছেন, তাদের মধ্যে পাঠকদের ভোটে আলি মাহমেদ এখন পর্যন্ত সবচেয়ে এগিয়ে আছেন। সম্প্রতি আমি ই-মেইলের মাধ্যমে আলি মাহমেদের এক সাক্ষাৎকার নেই, যেখানে বাংলাদেশের ব্লগ এবং ব্লগিং-সম্বন্ধে তার ধারণা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

জিভি: দয়া করে আপনি আপনার ব্লগের পরিচিতি ও ব্লগে আপনি কি বিষয় নিয়ে লেখেন সে সম্বন্ধে আমাদের কিছু বলবেন কি?

উত্তরটা আমার জন্য বড় কঠিন। আমি যেটা করার চেষ্টা করি, আমার বিক্ষিপ্ত ভাবনাগুলো একত্রিত করে লেখার প্রচেষ্টা, সবিরাম। আর এখানে লেখা মানেই তো ব্লগিং।

অবশ্য আমার লেখাগুলো আদৌ প্রচলিত ব্লগিং-এর পর্যায়ে পড়ে কিনা আমি জানি না। এবং প্রচলিত কোন ধারা আমি মেনে চলি না। যেমন আজ মশা নিয়ে লিখলাম- মশার প্রতি মানুষের বিশ্বাঘাতকতা নিয়ে, তো কাল মা হাতি- যে হাতিটা আগে মা পরে হাতি। পরশু হয়ত কোন একটা ধর্ম নিয়ে, এর পরের দিন হয়ত বা বিজ্ঞান বিষয়ক কোন একটা লেখা। এই জন্যই শুরুতে বলেছিলাম, এই প্রশ্নের উত্তর দেয়াটা আমার জন্য মুশকিল।

জিভি: আপনি মূলত একজন লেখক। কবে থেকে আপনি ব্লগ লেখা শুরু করেন এবং কেন?

আমি নিজেকে লেখক বলে স্বীকার করি না। বলি লেখার রাজমিস্ত্রি। একজন রাজমিস্ত্রি যেমন একের পর এক শব্দের ইট বসিয়ে একটা কাঠামো গড়ে তোলার চেষ্টা করেন তেমনি আমিও একের পর এক শব্দের ইট বসিয়ে একটা কাঠামো গড়ার চেষ্টা করি। কোন পাঠক যখন আমার সেই নিষ্প্রাণ বাড়ি নামের কাঠামোটা ছুঁয়ে দেন তখন সেটা হয়ে উঠে ঝলমলে একটা প্রাসাদ।

আমি লেখালেখির নামে ব্লগিং শুরু করি ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে। কোন এক দৈনিকে ‘সামহোয়্যার ইন ব্লগ ডট নেট’ এই সাইটটার খোঁজ পাই। ওখানেই শুরু।

এঁরা এক অভাবনীয় কাণ্ড করে ফেলেছিলেন। এঁরাই প্রথমে এই দেশে বাংলায় লেখালেখি করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। এই দেশের পক্ষ থেকে আমি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। আমরা যারা দেশে থাকি তাদের চেয়ে এটা অতি জরুরি ছিল প্রবাসীদের জন্য। খানিকটা অক্সিজেন, প্রবাসীরা এখানে তাদের দমবন্ধ শ্বাস ফেলার সুযোগ পেতেন- একমুঠো দেশের সোঁদা মাটির গন্ধ! এর ফল যে কী অকল্পনীয় তার পুরোটা আঁচ করা মুশকিল।

কেন ব্লগিং শুরু করলাম এটা অল্প কথায় বলি, আমি তো আগেও লেখালেখি করতাম। ওখানে ব্লগিং শুরু করার পূর্বেই বিভিন্ন পত্রিকায় লিখেছি, তখন পর্যন্ত আমার বেশ ক-টা বইও প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু ওখানে এসে লেখার শক্তি দেখে হতভম্ব হয়ে গেলাম। ফারাকটা টিভি নাটক এবং মঞ্চনাটকের যে তফাত, এমন! একেবারে লাইভ, জীবন্ত!

একটা লেখা দিয়ে আপনি পার পাবেন না, পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ভাললাগা-মন্দলাগা জেনে যাবেন, ভুল লিখলে জালে আটকা পড়বেন।

Shuvo blogging

জিভি: ২০০৭ সালে “শুভর ব্লগিং” নামক বইটি প্রকাশিত হয়েছিল। সম্ভবত বাংলায় প্রকাশিত এটাই প্রথম বই যা ব্লগিং-নিয়ে লেখা। এই কাজের পেছনে কোন বিষয়টি আপনাকে উৎসাহিত করেছিল?

এটা বের করার পেছনে ঠিক সুনির্দিষ্ট কোন কারণ ছিল না। এক বছর আমি সামহোয়্যারে চুটিয়ে লেখালেখি করেছিলাম। ওখানে বেশ কিছু আমার পছন্দের লেখা ছিল, তাছাড়া অনেকের সঙ্গে অজস্র মন্তব্য চালাচালি হয়েছিল। ইচ্ছা ছিল মন্তব্যসহ পোস্টগুলো নিয়ে আসা কিন্তু তা হলে বইটা গিয়ে দাঁড়াত প্রায় হাজার পৃষ্ঠার, এই বিপুল আকারের বই বের করতে প্রকাশক আগ্রহ বোধ করতেন না। আরও কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে কেবল পোস্টগুলো নিয়েই বই বের হলো।

জিভি: আপনি প্রথম কমিউনিটি প্লাটফর্ম (সম্প্রদায় বা সবার জন্য তৈরি করা ব্লগ)-এ লিখতে শুরু করেন-আর এখন নিজের সাইটে লিখছেন। এই দুই জায়গায় লেখার ক্ষেত্রে পার্থক্যটা কি আমাদের জানাবেন।

কমিউনিটি ব্লগিং-এর বিপুল শক্তি হচ্ছে এর পাঠক। সামহোয়্যারে বা অন্যত্র লেখার সময় এমনও দাঁড়িয়েছে আমার কিছু পোস্টে হাজারেরও উপর হিট ছাড়িয়ে গেছে, যেটা আমার নিজের সাইটে অকল্পনীয়। কিন্তু কেবল হিটটাই বড়ো কথা না, অনেকের মন্তব্য পড়ে বোঝা যেত আদৌ তিনি লেখাটা পড়েননি!

কমিউনিটি ব্লগিং-এ যে সমস্যা আমাকে ভারী বিব্রত করত, তা হচ্ছে দলাদলি। বুশ স্টাইল, হয় তুমি আমার দলে নইলে খেলা থেকে বাদ। এতে আমার প্রবল আপত্তি ছিল, এখনো আছে। আসলে এটা হচ্ছে আমাদের দেশের কালচার। এখানে জন্মের পরই আলাদা করে ফেলা হয় একটা প্রাণ পশুর, না মানুষের বাচ্চার? এরপর ছেলে, না মেয়ে? কোন ধর্মের? বাড়ি কোন এলাকায়? পরিশেষে কোন দল করে? কালে কালে এটা আমাদের শেখানো হয়েছে!

অনলাইনে লেখার সময় আমি ভয়ে কাঠ হয়ে থাকি, এই রে কোথাও ভুল লিখে বসলাম না তো আবার- প্রচুর পড়তে হয়, হাতের নাগালে তথ্য-উপাত্ত রাখতে হয়। এখানকার পাঠক কিন্তু আমার উপন্যাসের টিনএজ পাঠক না, দুর্ধর্ষ সব মানুষ, যারা প্রবাসে গেছেন উচ্চশিক্ষার জন্য। এঁদের রয়েছে চিন্তা করার বিপুল ক্ষমতা!

অন্যদের কথা জানি না কিন্তু এই সব আমার উপর চাপ পড়ত। তারচেয়ে আমার নিজের সাইটে যখন লিখি, লিখে বড় আরাম পাই। বাড়তি চাপ নাই। যে অল্প পাঠক সাইটটা ভিজিট করেন তারা মুলত পড়ার জন্যই আসেন। তাঁদের সঙ্গে আমি আমার ভাবনা শেয়ার করতে পারি, ‘বাঁশে ভিউ মিরর‘ লাগাবার আইডিয়া। আমার স্বপ্নগুলো ছড়িয়ে দিতে পারি, আমার ভুলগুলো শোধরাতে পারি।

জিভি: অনুগ্রহ করে বাংলাদেশের ব্লগিং-এর গভীরতা নিয়ে আপনার ভাবনা আমাদের জানান।

আমি প্রচন্ড মুগ্ধ! এক কথায় দুর্ধর্ষ, এখানে ব্লগিং-এর নামে যেসব লেখালেখি হয়, অনেকের লেখা পড়ে, তাঁদের ভাবনার প্রসারতা দেখে আমি থ হয়ে যাই। পারলে এদের হাত সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে দিতাম। আমাদের দেশের যেসব বিখ্যাত লেখকগণ রয়েছেন এঁরা কল্পনাও করতে পারবেন না, এখানে এমন অনেকে লেখালেখি করেন তাদের লেখার-ভাবনার কী গভীরতা!

জিভি: যে দেশে ৪০ শতাংশ মানুষ নিরক্ষর, সেখানে গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নামক উপাদানকে কি ভাবে দেখেন এবং ব্লগিং এখানে কোন ধরনের ভূমিকা পালন করতে পারে?

এই প্রশ্নের উত্তর চট করে দেয়াটা মুশকিল। যদি বলা হয় হ্যাঁ তা হলে অতিশয়োক্তি হবে। যেখানে শতকরা ৪০ ভাগ মানুষ অশিক্ষিত, এখানে খুব অল্প মানুষই নেট ব্যবহার করেন। তাছাড়া আমাদের দেশ যারা চালাচ্ছেন তাঁদের এইসব পড়ার সময়, যোগ্যতা কই? এমতাবস্থায় ব্লগিং করে চট করে কিছু করে ফেলা যাবে এটা বলা মুশকিল। তবে ভূমিকা রাখা যেতে পারে পরোক্ষভাবে।

জিভি: বব্স-এর মত একটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় মনোনয়ন লাভ করার পর আপনার অনুভূতি কেমন?

অবশ্যই এটা অতি আনন্দের। তবে আমি পেছনের কাতারের মানুষ। হুট করে সামনে চলে এলে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি।

জিভি: দয়া করে গ্লোবাল ভয়েসেস-এর পাঠকদের বলবেন কি, বাংলা ব্লগের লেখা পড়ে তারা কি ভাবে উপকৃত হতে পারে?

এটা আমি একটু ঘুরিয়ে বলব। কোন দেশ কতটা সভ্য এটা তার স্বর্ণের মজুত বা মিসাইলের সংখ্যা দিয়ে হয় না। আমি মনে করি ওই দেশের মানুষদের ভাবনা, যার আরেক নাম ব্লগিং নামের লেখালেখি দিয়ে হয়।

এখন আমরা কোন দেশের লোকজনের ভাবনা জানব কেমন করে? পত্রিকা-মিডিয়ার মাধ্যমে, উঁহু। ওখানে আমরা কেবল জানতে পারব মেদবহুল ভাবনা। নির্মেদ ভাবনা জানার জন্য ব্লগিং নামের শক্তিশালী এই মাধ্যম ব্যতীত অন্য কোন উপায় নাই। দেশটা বাংলাদেশ নাকি কঙ্গো সেটা দেখার বিষয় না, দেখার বিষয় হচ্ছে ওখানকার মানুষদের ভাবপ্রকাশ-ব্লগিং।

যেমন আমরা এই গ্রহের সাহিত্য বলতে বুঝি ইংরেজি সাহিত্য প্রকারান্তরে আমেরিকা-বৃটেনের সাহিত্য। মুভি বলতে বুঝি আমেরিকার মুভি। ব্লগিংটাও যেন সে পর্যায়ে না যায় সেজন্য আমাদের যেটা অতি সত্বর করা প্রয়োজন পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার ব্লগারদের লেখা অন্য ভাষায় অনুবাদ করার ব্যবস্থা করা।

জিভি: আপনার ছয় বছরের সন্তান এখন ব্লগিং করা শুরু করেছে, এই বিষয়ে আপনার অনুভূতি কি?

অনুভূতিটা অন্য রকম। আমি আমার সন্তানকে ব্লগিং করা দেখিয়ে দিয়েছি। আর সে আমাকে দেখিয়েছে এটা, সে ৬ বছর বয়সে ব্লগিং করে আর আমি ২৭ বছর বয়সে প্রথম কম্পিউটার ছুঁয়ে দেখেছিলাম!

ববস-প্রতিযোগিতার জন্য ভোট দানের শেষ তারিখ ১৪ এপ্রিল, কাজেই আপনি যদি একজন বাংলাভাষী হন,তা হলে অনুগ্রহ করে এই ব্লগগুলো পাঠ করুন এবং আগামী বুধবারের মধ্যে আপনার পছন্দের সেরা ব্লগটিকে ভোট দিতে ভুলবেন না যেন।

5 টি মন্তব্য

আলোচনায় যোগ দিন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .