নিহত কর্মীদের স্মরণে ব্লগ চালু করলো বাংলাদেশের সমকামী সম্প্রদায়

বাংলা নববর্ষ উদযাপন উপলক্ষে এলজিবিটি সম্প্রদায়ের ‘রংধনু যাত্রা’। ছবি তুলেছেন নাহিদ সুলতান। উৎস: উইকিপিডিয়া

২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল আততায়ীদের হাতে নিজ বাড়িতে খুন হন সমকামী অধিকারকর্মী জুলহাস মান্নান ও মাহবুব তনয়।

বাংলাদেশে ২০১৩ সাল থেকে অসাম্প্রদায়িক চিন্তাবিদ আর ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিধন করা হচ্ছে এবং এরা দুজন সেই লম্বা তালিকায় অবস্থান নিয়েছেন (গ্লোবাল ভয়েসেস এর রিপোর্ট দেখুন)।

হত্যাকাণ্ডের পর আনসার আল-ইসলাম (আল-কায়েদা ইন ইন্ডিয়ান সাব-কন্টিনেন্ট) টুইটারে এক বিবৃতির মাধ্যমে খুনের দায় স্বীকার করেছে। এখন পর্যন্ত পুলিশ দুজনকে গ্রেফতার করেছে এই হত্যাকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত থাকার জন্যে। কিন্তু এক বছরেরও বেশী হতে চলল এখনো তদন্তকারীরা চূড়ান্ত চার্জশিট দাখিল করতে পারেনি।

বিশ্বব্যাপী বিশ্লেষকরা বলছেন যে জুলহাস ইসলামি চরমপন্থীদের লক্ষ্যে পরিণত হয়েছিল বাংলাদেশে সমকামী সম্প্রদায়ের প্রতি বাড়ন্ত ঘৃণা এবং সমকামী সম্পর্ক আইন দ্বারা নিষিদ্ধ করার কারণে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ দন্ড বিধির ৩৭৭ ধারা অনুযায়ী, পারস্পরিক সম্মতিক্রমে মুখমেহন ও মলদ্বারের যৌণক্রিয়া “প্রাকৃতিক শৃঙ্খলার বিপরীতে একটি কামজ মৈথুন ক্রিয়া” এবং এর সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে যাবজ্জীবন কারাদন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। অর্থাৎ এই ধারার মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশে সমকামী যৌণক্রিয়াকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। এই আইনটি ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসকদের দ্বারা উনিশ শতকে প্রণয়ন করা হয়েছিল যা এখনো অনেক দেশে বহাল আছে।

জুলহাস মান্নান ও মাহবুব তনয়ের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে ‘ধী’ নামে একটি ব্লগ সাইট চালু করেছে বয়েজ অব বাংলাদেশ। উল্লেখ্য, বয়েজ অব বাংলাদেশ বাংলাদেশের সমকামীদের অবস্থা তুলে ধরার জন্যে এই সম্প্রদায় নিয়ে কাজ করে থাকে।

‘ধী’ হলো বয়েজ অব বাংলাদেশ-এর ১৪ মাসব্যাপী একটি প্রকল্প যার মাধ্যমে নারী সমকামীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ করে থাকে। লিঙ্গ আর যৌনতা সম্পর্কিত জ্ঞান মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে প্রজেক্ট ‘ধী’ ২০১৫ সালে বাংলাদেশের প্রথম নারী সমকামী কমিক চরিত্র ‘ধী’ উদ্বোধন করে। পরবর্তী সময়ে প্রজেক্ট ‘ধী’ বাংলাদেশের সাতটি বিভাগীয় শহরে তেরোটি লিঙ্গ আর যৌনতা বিষয়ক অনুষ্ঠান সম্পন্ন করে।

আর ‘ধী’ ব্লগ হলো এই প্রকল্পের একটি উদ্যোগ। এই ব্লগে বিভিন্ন সমকামী একটিভিস্ট জুলহাস আর তনয়ের স্মৃতিচারণ করছে এবং জানাচ্ছে যে এই হত্যাকাণ্ডের পরে তারা কিভাবে ভয়ের মধ্যে বসবাস করছে। এই ব্লগে লেখকদের পরিচয় গোপন রাখা হয়। এমনকি মন্তব্যকারীদের ইমেইল ও প্রকাশ করা হয় না নিরাপত্তার কারণে। এ সম্পর্কে ব্লগ সাইটটিতে বলা হয়েছে:

জুলহাজ মান্নান ও তনয়ের নির্মম হত্যাকান্ডের ঘটনাটি ধী এর মত যাদের জীবনে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে প্রভাব ফেলেছে তাদের বলা কিছু লেখা/কথা/ছবি/ভিডিও সংরক্ষণ করে রাখার প্রাথমিক উদ্দেশ্য নিয়ে এই কমিউনিটি ব্লগের যাত্রা শুরু হচ্ছে। আমাদের এই আহবানে সাড়া দিয়ে বিভিন্ন মানুষ, যারা নানা সময়ে জুলহাজ আর তনয়ের সান্নিধ্যে ছিলেন, তাদের লেখনী আলোকচিত্র দিয়ে জানিয়েছেন তাদের মনের অব্যক্ত সেসব কথা। বাংলাদেশের সমকামীদের আন্দোলনের বর্তমান পরিস্থিতির ঘোলাটে এক টুকরো ছবি মিলবে ধী ব্লগে।

বুকের ভেতর বড় বড় দীর্ঘনিঃশ্বাস

জুলহাজ মান্নান ছিলেন ইউএসএইড বাংলাদেশের একজন কর্মী এবং বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র সমপ্রেমী সাময়িকী ‘রূপবান’ এর প্রকাশক এবং সহ-প্রতিষ্ঠাতা। উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের ১৮ই জানুয়ারি ‘রূপবান’ সাময়িকী প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল।

এই প্রকাশনার আগে বাংলাদেশের সমকামী সম্প্রদায় গোপনে কাজ করে যাচ্ছিল এবং তারা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখত ইমেইল ও সোশ্যাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে।

বয়েজ অফ বাংলাদেশের শাখাওয়াত হোসাইন সংবাদ সাইট ওয়াইয়ার্ড ডট ইন এ লিখেছেনঃ

Mannan believed in visibility. All his life he worked to provide a safe space for people to come out and be who they were. He opened up his house, spent all his earnings and dedicated his spare time towards mobilising the community and giving us a sense of belonging. He had a unique way of encouraging us to speak up and be assertive of our rights – of our right to love. How ironical it is for the merchant of love to succumb to such hatred and violence.

Tonoy used his theatre experience to produce and act in various short dramas to spread awareness about LGBT issues.

জুলহাজ দৃষ্টিগোচরতায় বিশ্বাস করত। তার সারাটা জীবন সে কাজ করেছে যাতে সমকামীরা আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে। সে তার বাসাকে সম্প্রদায়ের জন্যে উন্মুক্ত করে দিয়েছিল, এবং অবসর সময়ে সম্প্রদায়ের জন্যে কাজ কোর্ট। সে তার সমস্ত উপার্জন এ লক্ষ্যে ব্যয় করত। সে আমাদের অধিকার, ভালবাসার অধিকার আদায় করার জন্যে উদ্বুদ্ধ করত তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে। কি বিদ্রূপাত্মক এটি যে এই ভালবাসার বণিককে ঘৃণা এবং সহিংসতার কারণে মৃত্যুবরণ করতে হল।

তনয় তার নাটক করার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে সমকামী অধিকার সম্পর্কে লোককে জানানোর জন্যে বিভিন্ন প্রকার ছোটো নাটকের রুপায়ন করত।

জুলহাস আর তনয়। ছবি তাঁদের ফেসবুক পাতা থেকে

জুলহাস মান্নানকে নিয়ে ‘ধী’-তে একজন লিখেছেন:

২৫শে মার্চ আমি শেষবারের মতো জুলহাজ ভাইয়ের বাসায় পা দিয়েছিলাম। এক জন্মদিনের উৎসবে। [..]

ঠিক এক মাস পর তার মৃত্যু হল।

মাঝেমধ্যে আমি হিসাব করতে বসি। কতো দিন হল? ১০ দিন? ১৫ সপ্তাহ? ৬ মাস? আর কতো মাস পর এক বছর হবে?

প্রথম প্রথম ঘোরের মধ্যে ছিলাম। ঠিকমতো বুঝতে পারছিলাম না জীবনে কতো বড় পরিবর্তন চলে এসেছে। যখন ঘোর কাটিয়ে একটু-আধটু বোঝার চেষ্টা করতে শুরু করলাম তখন বড় বড় দীর্ঘনিঃশ্বাস বুকে জমতে শুরু করলো। আমাদের পুরো জগত বদলে গিয়েছে। আচমকা এক ঝড়ে সব লণ্ডভণ্ড করে গিয়েছে।

রূপবান ম্যাগাজিন প্রকাশ করতে গিয়ে তার আর জুলহাস মান্নানের কী দিন গেছে, সেটা নিয়ে একজন লিখেছেন:

অন্যান্য ম্যাগাজিনের মত রূপবানের প্রথম সংখ্যার পর দ্বিতীয় প্রকাশ কিছুটা মসৃণ হবার কথা ছিল। কিন্তু কপালে শনি, চারপাশ থেকে অক্টোপাসের অশুভ শুঁড় আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলল। প্রধানমন্ত্রী নাকি মন্ত্রীসভার স্ট্যান্ডিং কমিটিতে রূপবান দেখে নাখোশ হয়েছেন। এদিকে ভোরের কাগজে বড় করে রিপোর্ট বের হয়েছে গোয়েন্দা বাহিনী রূপবানের পেছনের লোক খুঁজছে। … রূপবানের প্রথম সংখ্যা বের হয়েছিল যে ছাপাখানা থেকে, ভোরের কাগজের রিপোর্ট বেরোবার পরের দিনই জানিয়ে দিলো তারা আর আমাদের ম্যাগাজিন ছাপাতে পারবে না।আমি তখন নিতান্তই ভেঙে পড়েছিলাম। রূপবান ছাপানোর শোকে না, ডিবি পুলিশের ভয়ে! বাসায় কলিং-বেল বাজলেই মনে হয় পুলিশ।

এই ভয়ের মধ্যে জুলহাস মান্নান তার পাশে কীভাবে দাঁড়িয়েছিল, সেটাও উল্লেখ করেছেন তিনি:

পুলিশ আসলে কোনো ঝামেলা করবা না। কোনোকিছু অস্বীকার করবা না। চুপচাপ থানায় যাবা। ওখানে গিয়ে সবার আগে আমার নাম বলবা। বলবা জুলহাস মান্নান সব নাটের গুরু।

আরেকজন মাহবুব তনয়ের বিষয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তার সাম্প্রতিক একটি অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করেছেন:

গত সপ্তাহে আমি বৈষম্য বিলোপ আইন বিষয়ক একটা আলোচনায় অংশ নিতে গিয়েছিলাম। টেবিলের আরেক মাথা থেকে আমাকে পরিষ্কার বলে দেয়া হল সরকার এমন কিছু করতে পারবে না যা ৩৭৭ ধারার বিপক্ষে যাবে। এই অশান্ত পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে না পেরে তারা এলজিবিটি শব্দটা শুনতেও এখন নারাজ। সবকিছু এখন কেমন যেন অনেক অন্তঃসার শূন্য মনে হয়। আরেকটু বেশী সম্মান কি রাষ্ট্রের কাছে তোমাদের প্রাপ্য ছিল না?

এ কেমন মাতৃভূমি? যার বুকে আমার জন্য এতোটুকু জায়গা নাই?

বাংলাদেশের রক্ষণশীল সমাজ সমকামীদের প্রতি অনেক অসংবেদনশীল হতে পারে। লৈঙ্গিক কারণে তনয়কে বাড়িতে কী ধরনের পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়েছে, সেটা নিয়ে একজন পোস্ট দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন:

তনয়ের বাসার পরিবেশটা একটু অন্যরকম। বাসার সবাই জানত তাদের ছেলে একটু আলাদা। পাড়ার আর দশটা ছেলের মতন নয়। ছোটবেলা থেকেই সে নিজেকে লুকাতে চাইতো না। ছেলে হয়ে মেয়েলী স্বভাব, মেয়ের কাপড়ে পারিবারিক উৎসবে নাচ, এসব কারণে বহুবার তার বাবার দ্বারা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিল ওকে অনেকবার।

বাংলাদেশে যারা এলজিবিটি নিয়ে কাজ করছেন, তারা এখন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন এই দুই কর্মীর মৃত্যুর পর। এদের অনেকেই ফেসবুক প্রোফাইল বন্ধ করে, ফোন নম্বর, বাসা বদলে ফেলে বেঁচে থাকার যুদ্ধে নাম লিখিয়েছেন। আরেকজন নারী একটি পোস্টে লিখেছেন:

এই ঘটনা ঘটার পর আমার কাছের যে কয়টি মানুষ আছে তারা সবাই আমাকে বলেছে দেশ ছেড়ে চলে যেতে। আমি ছোটবেলা থেকে অনেক বড় বড় স্বপ্ন দেখেছি কিন্তু নিজের দেশ ছেড়ে চলে যাবার স্বপ্ন কক্ষনো দেখিনি, কক্ষনো না। আমি ছোটবেলা থেকেই ভালো ছাত্রী ছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করেছি, ছাত্রাবস্থা থেকেই সামাজিক নানা কাজে যুক্ত ছিলাম। এখন ভালো চাকরী করছি। আমি সবসময় দেশের জন্য কিছু করতে চেয়েছি। সুবিধা-বঞ্চিতদের সাথে কাজ করবো, দেশের ইকোনমিতে কন্ট্রিবিউট করবো। অনেক আশা ছিল আমার। কিন্তু আমি কেমন করে এ দেশে থাকবো যেখানে আমার বেঁচে থাকার নূণ্যতম গ্যারান্টিটুকু নাই? আমি কেমন করে থাকবো এদেশে যেখানে আমি জানি আমি মরে যাবার পর হোমপেইজ, চায়ের-কাপ সবখানে সোল্লাসে ঝড় উঠবে বেশ হয়েছে মরে গিয়ে দেশটাকে সাফ হয়েছে! এ কেমন মাতৃভূমি? যার বুকে আমার জন্য এতো টুকু জায়গা নাই?

গতবছর আগস্ট মাসে তদন্তকারীরা পাঁচজন সন্দেহভাজনকে চিহ্নিত করে এই খুনের জন্যে। পুলিশ ইতিমধ্যে দুইজনকে গ্রেফতার করেছে যাদের থেকে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিও নেয়া হয়েছে।

জুলহাস আর তনয়ের মৃত্যুর একবছরের বেশী পার হয়ে গেছে, কিন্তু পুলিশ এখন পর্যন্ত চার্জশিট দাখিল করতে পারেনি। অথচ তারা দুইজনকে ধরেছে এবং গণমাধ্যমকে জানিয়েছে “আমরা জানি কারা করেছে”। কোর্ট ইতিমধ্যে সময় বাড়িয়েছে ১২ বার।

গত ৮ মে ২০১৭ ছিল তাদের মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার দিন। কিন্তু মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তারা এদিন প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেননি। প্রতিবেদন দাখিলের নতুন তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ জুন ২০১৭।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .