বাংলাদেশ: দুই সমকামী নারীর বিয়ে নিয়ে তোলপাড়

সম্প্রতি বাংলাদেশে একজন মুসলমান এবং একজন হিন্দু নারী একে অপরকে বিয়ে করার পর গ্রেফতার হয়েছেন। বাংলাদেশের আইনে সমকামী বিয়ের অনুমোদন না থাকলেও এটিকেই এরূপ বিয়ে হিসেবে দেশের প্রথম দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে।

২১ বছরের তরুণীটির সাথে ১৬ বছরের তরুণীর গৃহশিক্ষিকা হিসেবে পরিচয় হয়। জানা গেছে, তারা দু'জন বেশ কয়েক বছর ধরে গোপনে প্রেম করে আসছিলেন। সম্প্রতি তারা পিরোজপুর থেকে পালিয়ে এসে ঢাকায় বিয়ে করে একসাথে বসবাস শুরু করেন। তবে দুই তরুণীর একজনের বাবার অভিযোগের প্রেক্ষিতে পুলিশ তাদের খুঁজে বের করার পর জানা যায় তাদের বিয়ের খবর। এরপর তারা গ্রেফতার হন।

বাংলাদেশে সমকামী সম্পর্ক এবং সম লিঙ্গের বিয়ে বেআইনি এবং এজন্যে সাজা দশ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড থেকে শুরু করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে। দেশে সমলিঙ্গের মেলামেশাকে দৃষ্টিকটু হিসেবে দেখা হয় না তবে মুসলমান প্রধান দেশ হিসেবে বাংলাদেশে সমকামিতাকে মানা হয় না। কিছু লুকানো সমকামী গোষ্ঠী রয়েছে এই দেশে তবে তারা লুক্কায়িত সংখ্যালঘু (গ্লোবাল ভয়েসেস এর রিপোর্ট দেখুন)।

World homosexuality Laws. Click on image to see legend. courtesy Wikimedia Commons. CC BY-SA 3.0

বিশ্বজুড়ে সমকামিতা নিয়ে আইন। লাল রং এর দেশগুলোতে এর সাজা জেল (যাবজ্জীবন পর্যন্ত) এবং গাঢ় বাদামী দেশগুলোতে সাজা মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত। লিজেন্ড পড়তে ছবিতে ক্লিক করুন। গ্রাফিক্স উইকিমিডিয়া কমন্স এর সৌজন্যে। সিসি বাই-এসএ ৩.০ লাইসেন্স এর আওতায় ব্যবহৃত।

এই দুই তরুণীর বিয়ের খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হলে বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় শুরু হয় আলোচনা ঝড়!

বাংলাদেশের প্রথম সমকামী বিয়েকে অনেকেই অভিনন্দন জানিয়েছেন। গোলাম রাব্বানী তার ফেসবুক পেজে লিখেছেন:

যে দুটি মেয়ে বিয়ে করেছে তাদের জন্য শুভকামনা রইলো… জীবন সুন্দর… তাদের এ সাহসের জন্য অভিনন্দন তাদেরকে… জয় হোক জীবনের…

অভিজিৎ রায় বাংলা ব্লগে সমকামিতা নিয়ে অনেক বৈজ্ঞানিক লেখা লিখেছেন। এ বিষয়ে তার একটা বই-ও প্রকাশিত হয়েছেন। তিনিও এই দুই তরুণীর সাহসী ভূমিকার প্রশংসা করে লিখেছেন যে একজন মেয়ে র‍্যাবের কর্মকর্তাকে প্রশ্ন করেছেন:

একটা ছেলে যদি একটি মেয়েকে ভালো বাসতে পারে, তবে একটা মেয়ে কেন আরেকটা মেয়েকে ভালোবাসতে পারবে না?

তবে সমকামী বিয়েকে অনেকেই মেনে নিতে পারেননি। মেহদী আকরাম (@mehdiakram)একে দেখছেন পশ্চিমা সংস্কৃতির আগ্রাসন হিসেবে:

কেউ কেউ বাড়াবাড়িও করছেন। গত বছর বাংলাদেশী নোবেল বিজেতা অর্থনীতিবিদ ও গ্রামীন ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড: মুহম্মদ ইউনুস ও আরও তিনজন নোবেল বিজেতা একটি যৌথ বিবৃতিতে বিশ্বজুড়ে সমকামী সম্পর্ককে বৈধতা দেবার আবেদন করেছিলেন। এই দুই তরুনীর বিয়ের খবর প্রকাশের পর “উলামা মাশায়েখ সংহতি পরিষদ” নামে সংগঠন ইউনুসকে বাংলাদেশে সমকামিতা উৎসাহিত করার অভিযোগে অভিযুক্ত করে তাকে গ্রেফতার ও শাস্তির দাবী করেন। তারা আরও ঘোষণা দিয়েছেন যে তারা ঈদের পর ইউনুস সেন্টার ঘেরাও করবেন এবং এই নোবেল বিজেতাকে সামাজিকভাবে বয়কট করার আহ্বান জানিয়েছেন।

অনেকে আবার সহনশীলতা দেখিয়েছেন। সামহোয়ারইনব্লগের একটি পোস্টে নতুন নামক ব্লগার মন্তব্য করেছেন:

সমকামিতাকে আমি ভালো মনে করি না… কিন্তু এটা তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার… তাই তাতে আমি নাক গলাবো না…

দুই তরুণীকে পুলিশের গ্রেফতার, তাদের নিয়ে কটু মন্তব্যে প্রেক্ষিতে প্রণবেশ দাশ ফেসবুকে লিখেছেন:

They are just unlucky to born in the wrong country in the wrong time.

তাদের দুর্ভাগ্য, তারা ভুল দেশে ভুল সময়ে জন্ম নিয়েছে।

এটি ভালবাসা. ছবি মোকোদ্যাক্রেজির। সিসি বাই-এনসি-এনডি

রায়হান রশীদ এই সমকামী বিয়েকে চারটি কারণে তাৎপর্যপূর্ণ মনে করেন:

(১) যে সমাজে নারীর নিজের কোনো পছন্দ অপছন্দ থাকতে নেই, সেখানে তারা নিজেদের পছন্দকেই প্রাধান্য দিয়েছেন;
(২) তারা দু'জন ভিন্ন ধর্মের, একজন তো আবার সংখ্যালঘু ধর্মের। কিন্ত তাদের সম্পর্কের কাছে সে দেয়াল দাঁড়াতে পারেনি;
(৩) ধর্মীয় গোঁড়ামীর দেশে সম-লিঙ্গের সম্পর্কের সাহস দেখিয়ে নিজের মতো করে ঘর বেঁধেছেন;
(৪) দেশের আইনে ফৌজদারী অপরাধ জেনেও নিজেদের বিবেক, পছন্দ এবং সম্পর্কের সাথে কোনো ধরনের আপোষ করেননি দু'জন।

ভাস্কর আবেদীন দুই নারীর সমকামী সম্পর্কের খবর নিয়ে নিউজ সাইট এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় মাতামাতির মধ্যে পুরুষালি জাজমেন্টের সেক্সিস্ট উত্তাপ খুঁজে পেয়েছেন:

[…] গতকাল দুই নারীর সমকামী সম্পর্কের খবর নিয়া নিউজ পোর্টাল আর সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলিতে যেমন প্রতিক্রিয়া হইলো তাতে পুরুষালি জাজমেন্টের সেক্সিস্ট উত্তাপটা বেশ টের পাইলাম […]

কিছুদিন আগে এক ইসলামপন্থী নেতা তার ধর্মীয় বক্তৃতায় নারীদের ‘তেঁতুল’ হিসেবে উল্লেখ করে তাদেরকে ঘরে থাকতে বলেছিলেন। জনপ্রিয় নাট্যকার ও চলচ্চিত্র নির্মাতা মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী সেই বিষয়টি উল্লেখ করে তার ফেসবুক পেজে লিখেছেন:

If the news is true, we have the first official lesbian couple exposed here in Bangladesh. In a country where mr. Tetul Hujur preaches girls not to mix with boys, now how this girl-mixing-girl would be seen? Eager to study the next episodes!

খবরটা যদি সত্যি হয়, তাহলে বাংলাদেশে আমরা প্রথম লেসবিয়ান দম্পতির কথা জানতে পারলাম। এদেশে যেখানে তেঁতুল হুজুর নারীদেরকে পুরুষের সাথে না মেশার ধর্মোপদেশ দেয়, এখন নারীর সাথে নারীর এই মিলনকে কীভাবে দেখা হবে? এই ঘটনার পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে, তা দেখতে অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে আছি।

এদিকে সংবাদমাধ্যমে মেয়ে দু'টির নাম পরিচয় প্রকাশ হয়ে পড়ায়, তা নিয়েও সমালোচনা উঠেছে। এতে মেয়ে দু'টির ব্যক্তি নিরাপত্তা হুমকির আশংকা করছেন অনেকেই। শওগাত আলী সাগর লিখেছেন:

যারা নাগরিকের ‘প্রাইভেসি’ ‘প্রাইভেসি’ বলে গলা ফাটান, তারা কি … [সমকামী তরুণী] আর … [সমকামী তরুণী] এর ‘প্রাইভেসি'কেও সম্মান দিতে প্রস্তুত। নাগরিক হিসেবে তাদেরও তো ‘প্রাইভেসি’ আছে। নাকি?

মোস্তফা সরওয়ার ফারুকীর পোস্টে কথাসাহিত্যিক ও সংবাদকর্মী আনিসুল হক মেয়ে দু'টির নাম-ঠিকানা-ছবি প্রকাশ হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে মন্তব্য করেছেন:

[…] I am afraid we are crossing the limit, we are violating their right to privacy by publishing their photo, name, address. will they be able to live in this society after this news? Does any journalist have the right to kill any citizen?

[…] সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ায় আমি খুব ভয় পাচ্ছি, তাদের ছবি, নাম, ঠিকানা প্রকাশ করে আমরা তাদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার লংঘন করেছি। এই সংবাদ প্রকাশের পরে তারা কি এই সমাজে বাস করতে পারবে? কোনো সাংবাদিকের কি অধিকার আছে কোনো নাগরিককে হত্যা করার।

সমকামী গোষ্ঠী বয়েজ অফ বাংলাদেশ এই দুই নারীর সম্পর্কে সর্বশেষ খবর জানিয়েছে তাদের ফেইসবুক পাতায়:

As you have already known, [the 21-year-old] is now under custody and [the 16-year-old] has been returned to her family. [The 21-year-old] was shown arrested in a case filed abduction and trafficking. [..] Of immediate concern is the protection of the two young women involved. Second, file a complaint with the Press Council against making public the identity of at least the minor. We are also trying to convene an urgent meeting to formulate a strategic response to address the immediate concerns as well as the longer term potential to gain official recognition of same sex desire and same sex relationships.

আপনারা জানেন যে [২১ বছর বয়সী নারী] এখনও পুলিশের জিম্মায় এবং [১৬ বছর বয়সী] কে তার পরিবারের কাছে ফেরত দেয়া হয়েছে। [২১ বছর বয়সী নারী] কে অপহরণ ও নারীপাচার আইনে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। বর্তমানে প্রধান উপজীব্য হচ্ছে এই দুই নারীর নিরাপত্তা বিধান করা। দ্বিতীয়ত প্রেস কাউন্সিলে একটি অভিযোগ দাখিল করতে হবে মিডিয়াতে তাদের পরিচয় প্রকাশ করে দেবার জন্যে নিন্দা জানিয়ে। বিশেষ করে অপ্রাপ্তবয়স্ক নারীটির পরিচয় প্রকাশ করা একদম উচিৎ হয়নি। আমরা একটি মিটিং এর আয়োজন করতে চাচ্ছি যেখানে এ নিয়ে বর্তমানে কি করা প্রয়োজন তা সম্পর্কে আলোচনা করা হবে এবং আলোচনা করা হবে সমকামিতা ও সমকামী সম্পর্ককে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেবার সম্ভাবনা দীর্ঘমেয়াদে আছে কিনা।

1 টি মন্তব্য

আলোচনায় যোগ দিন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .