এ সপ্তাহের ব্লগারঃ রেজওয়ান

গ্লোবাল ভয়েসের নতুন দক্ষিণ এশিয়া সম্পাদক বাংলাদেশের রেজওয়ান ২০০৫ সাল থেকে গ্লোবাল ভয়েসের একজন ভলান্টিয়ার হিসাবে কর্মরত আছেন। রেজওয়ানের স্মরণীয় পোস্টগুলোর মধ্যে আছে বাংলাদেশে একটা ভূমিকম্পের উত্তেজনা নিয়ে প্রতিবেদন এবং বর্ণালী ও ব্যয়বহুল বাংলাদেশী বিবাহ-অনুষ্ঠানের গল্প। প্রথিতযশা নেহা বিশ্বানাথানের বদলে তিনি এখন দক্ষিণ এশিয়া সম্পাদক।

তার ব্যক্তিগত ব্লগ দ্যা থার্ড ওয়ার্ল্ড ভিউ ইংরেজীতে বিশ্বব্যাপী পাঠকদের সম্মুখে বাংলাদেশীদের কথা উপস্থাপন করে।

ওয়েবে বাংলায় তথ্য-উপাদান সমৃদ্ধ করতে উৎসুক রেজওয়ান আরো কিছু সহ-অনুবাদক সঙ্গে নিয়ে বাংলায় গ্লোবাল ভয়েসের লিঙ্গুয়া ওয়েবসাইটটি আরম্ভ করেন।

তিনি রাইজিং ভয়েসের বিশেষ নিবন্ধের একজন সম্পাদক। রাইজিং ভয়েস হচ্ছে গ্লোবাল ভয়েসের একটা প্রকল্প যা বিশ্বের সবচেয়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে নতুন ব্লগিং প্রকল্প চালু করতে বড় ধরণের অর্থ-সাহায্য অনুদান হিসাবে প্রদান করে থাকে। এখানে রেজওয়ান লিখেছেন কেনিয়ার রিপ্যাকটেড ব্লগারদের ইন্টারনেট সংযোগের সমস্যা, কলম্বিয়ার লা লোমার তরুন ব্লগারদের অদম্য শক্তি সম্বন্ধে এবং বাংলাদেশের নারীজীবনের মহিলা ব্লগারদের তোলা চমৎকার ছবি বিনিময় করেছেন।


বাংলাদেশের কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত থেকে নারী জীবনের ব্লগার নীলুফা এ্যানীর তোলা মনোরম সূর্যাস্তের ছবি

২০০৩ সালে কেন আপনি ব্যক্তিগত ব্লগ লেখা শুরু করেন এবং কি কারণে আপনি ইংরেজী ভাষা বেছে নেন?

আমি তখন ঢাকায় ছিলাম। স্থানীয় একটা পত্রিকায় বিখ্যাত ইরাকী ব্লগার সালাম প্যাক্সের গল্প পড়ি। তার দৈনন্দিন জীবনের উপরে যুদ্ধ কিভাবে প্রভাব ফেলতো সেগুলো তিনি একটা অনলাইন ডায়েরীতে লিপিবদ্ধ করতেন। আমি তার ব্লগ পড়তে শুরু করি এবং এভাবে আরো কিছু চিত্তাকর্ষক ব্লগের সাথে পরিচিত হয়ে উঠে।

এর ফলে ২০০৩ এর এপ্রিলের কোন এক সময়ে আমি নিজের ব্লগ শুরু করতে প্রলুব্ধ হই। প্রথমদিকে নিশ্চিত ছিলাম না লেখার বিষয় নিয়ে। তবে ক্রমশ অন্যান্য ব্লগ পড়ে অনুধাবন করতে সক্ষম হই যে বাংলাদেশ সম্বন্ধে প্রচুর ভুল ধারণার ছড়াছড়ি। এর প্রধান কারণ ইন্টারনেটে বাংলাদেশীদের অনুপস্থিতি। এবং আমি আমার দৃষ্টি নিবন্ধের জায়গা খুঁজে পাই: বাংলাদেশ হয়ে ওঠে বিষয় এবং এরপরে বাংলাদেশী ব্লগস্ফিয়ার।

সেই দিনগুলোতে বাংলা ইউনিকোড ছিল প্রস্তুতি পর্যায়ে। ফলে বাংলাতে ব্লগ লেখা সম্ভব ছিল না (যেহেতু পাঠকের কাছেও আমার ব্যবহৃত বাংলা সফটওয়ার/ফন্ট থাকতে হতো)। আমার মনোযোগ ছিল বিশ্বের সাথে যোগাযোগ স্থাপন এবং এর জন্য ইংরেজী ছিল সবচেয়ে প্রস্তুত অবলম্বন।

গ্লোবাল ভয়েস সম্বন্ধে কিভাবে আপনি প্রথম জানলেন?

সম্ভবত প্রথম এই সাইট সম্বন্ধে জানতে পারি আমার ব্লগের লিংক গ্লোবাল ভয়েসে স্থাপন করায়। ইতোমধ্যে আমার ব্লগে একটা ক্ষুদ্র রাউন্ডআপ এবং কয়েকটা অঞ্চলের গেস্ট ব্লগিং শুরু করেছিলাম।

এরপর ২০০৫ এর জুলাইতে আমি গ্লোবাল ভয়েসের সহ-প্রতিষ্ঠাতা রেবেকা ম্যাকিনন এর একটা মেইল পেলাম: “আমরা দেখেছি যে গ্লোবাল ভয়েসে আপনার লিংক প্রায়শই দেয়া হয় এবং আপনার সম্বন্ধে আরো কিছু জানতে পেলে আমরা আনন্দিত হবো”.. গ্লোবাল ভয়েসে লিখতে তিনি আমাকে অনুরোধ করেন।

গ্লোবাল ভয়েসে লেখার জন্য আমি শিহরণ অনুভব করি এবং এরপরের ঘটনা তো ইতিহাস।

আপনার সবচেয়ে স্মরনীয় ব্লগিং অভিজ্ঞতা কি?

অনেক মজার অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার। মনে পড়ে ২০০৪ এর এপ্রিলে আমি শ্রীলংকা ভ্রমণে গিয়েছিলাম এবং সে সম্পর্কে ব্লগও লিখেছিলাম। মনে আছে আমার তোলা ছবি এবং দৈনিক প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য ইন্টারনেট সংযোগ আছে এমন একটা কম্পিউটার হন্যে হয়ে খুঁজেছিলাম। এই তীব্র আকাঙ্খাই একজনকে আবেগপ্রবণ ব্লগারে পরিণত করে।

আমার ব্লগ পোস্টে প্রাপ্ত মন্তব্য আমাকে আমোদের একটা অংশ সরবরাহ করে। বাংলাদেশের জাতিয় পরিচয়পত্র বাস্তবায়ন পদ্ধতি সম্বন্ধে আমি একবার লিখেছিলাম এবং সেখানে আমার কাছে কারো কারো সুনিদৃষ্ট প্রশ্ন ছিল এমন “আমার আইডি কার্ড হারিয়ে গেছে। দয়া করে আমাকে জানাবেন নতুন আইডি কার্ড কিভাবে উত্তোলন করবো”।

বাংলাতে গ্লোবাল ভয়েস আরম্ভ করার পেছনে কি প্ররোচনা ছিল?

বাংলা ব্লগিং অপেক্ষাকৃত নতুন একটা ফেনোমেনা। বাস্তবিক অর্থে সমস্ত প্রযুক্তিগত প্রতিবন্ধকতা অপসারণ করে ২০০৫ এর ডিসেম্বরে একটা বাংলা ব্লগিং প্লাটফর্ম (এখন যা বৃহত্তম) চালুর মাধ্যমে এর যাত্রা শুরু হয়। বিশ্বের ২৩ কোটি মানুষের ভাষা হলো বাংলা, কিন্তু ইউনিকোডের অভাবে বাংলাদেশ ও ভারতের শ'য়ে শয়ে বাংলা অনলাইন সাইট/প্রকাশনা খুঁজে পাওয়া যায় না এবং প্রকৃতপক্ষে ওয়েবে মানসম্মত বাংলা তথ্য-উপাদানের প্রচুর ঘাটতি রয়েছে।

এজন্য গ্লোবাল ভয়েসের বিষয়গুলো আমার মাতৃভাষায় অনুবাদ শুরু করি। আমি জানতাম শীঘ্রই ইন্টারনেটের সাথে যুক্ত হওয়া মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে এবং চাইতাম নিজেদের ভাষায় বিশ্বের নানা অঞ্চলের মানুষের ব্লগের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে। আমাদের এখন ১৫জন অনুবাদক রয়েছেন যদিও মাত্র ৪-৫ জন নিয়মিত। তবে আশা পোষণ করি অচিরেই হয়তো আরো উদ্দীপ্ত ভলান্টিয়ার যোগ দেবে আমাদের দলে।

বাংলা ফন্ট পড়ার জন্য এখন আপনার যা করা দরকার তা হলো ব্রাউজারের ক্যারেক্টার এনকোডিং টাকে ইউনিকোডে (ইউটিএফ৮) সেট করা। আগে আপনাকে কমপক্ষে একটা বাংলা ফন্ট ডাউনলোড করতে হতো, কিন্তু এখন বেশীরভাগ অপারেটিং সিস্টেমে সবকিছু আগেই ইনস্টল করা থাকে। এখানে দেখতে পারেন যদি আপনি বাংলা ফন্ট পড়তে অথবা লিখতে কোন সমস্যার সম্মুখীন হন।
(https://bn.globalvoicesonline.org/bangla-settings/)

রাইজিং ভয়েস প্রকল্পে লেখার মাধ্যমে সিটিজেন মিডিয়া সম্বন্ধে আপনি কি কি জানলেন?

রাইজিং ভয়েসের অনুদানপ্রাপ্ত বিভিন্ন প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি বেশ উপভোগ করি। আমি নিজেই একটা উন্নয়নশীল দেশ থেকে এসেছি এবং তারা যে সব প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয় তার বেশীরভাগই অনুধাবন করতে পারি, যেমন ইন্টারনেটের সাথে সংযোগ স্থাপন অথবা স্রেফ একটা কম্পিউটারের সমানে বসতে পারা। আমি এখনও আমার দেশের ব্লগারদের বলতে শুনি তারা একটা ওয়েব পেইজ খুলতে গিয়ে যখন দেখে যে সেটা লোড হতে প্রচুর সময় নিচ্ছে, সে সুযোগে এক কাপ চা পান করতে পারে। তথাপি এই মানুষগুলো ব্লগ লিখতে উৎসাহী এবং প্রতিটা রাইজিং ভয়েস প্রকল্পে অংশগ্রহণকারী মানুষের জন্যই এটা সত্য; হোক না তা মাদাগাস্কার, কেনিয়া অথবা ঢাকায়। তাদেরকে উপস্থাপন করতে গিয়ে আমি আরো ভীষণভাবে উপলব্ধি করি যে যা করছি তা সঠিকই আছে।


বিগত বৎসরে বাংলা সিটিজেন মিডিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতিগুলো কি কি বলে আপনি মনে করেন?

প্রথমতঃ বাংলা ব্লগিং প্লাটফর্ম যা আমি ইতোমধ্যে উল্লেখ করেছি। এখন আমাদের ৪-৫টা প্লাটফর্ম আছে যেখানে হাজারের উপরে ইউজার এবং অসংখ্য পাঠক রয়েছে। এই প্লাটফর্মগুলোর মধ্যে পারস্পরিক প্রতিযোগিতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। আরো অনেক বহুভাষিক প্লাটফর্ম যেমন ব্লগার, ওয়ার্ডপ্রেস ইত্যাদিতেও ব্লগ তৈরী হচ্ছে।

কিছুদিনের মধ্যে বাংলাদেশের জনপ্রিয় একটা বাংলা দৈনিক পত্রিকা ব্লগিং চালু করতে যাচ্ছে এবং তাদের দেখাদেখি নিশ্চিতভাবে অন্যরাও অনুসরণ করবে। সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা করেছে যে তারা দেশের প্রায় দশ হাজার বিদ্যালয়ে কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট সংযোগ প্রদান করবে।

আপনার কি মনে হয় সামগ্রিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক বিভিন্নতা সম্বন্ধে মানুষের মনোভাব ও ধারণায় সিটিজেন মিডিয়া কোন প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছে?

হ্যা অবশ্যই। ঐ সমস্ত দেশের ব্লগস্ফিয়ারে বিভিন্নমুখী অগ্রগতি হচ্ছে এবং কম বেশী মানুষ ব্লগিং এর শক্তি সম্বন্ধে অবগত হচ্ছে।

প্রচারমাধ্যমের একঘেয়েমী চিত্রায়ন ভেঙে পাকিস্থানী ব্লগস্ফিয়ার তাদের বৈচিত্র এবং খোলামন প্রদর্শন করেছে। ভারতীয় ব্লগস্ফিয়ার অনেক বিশাল এবং দেশের বহুসাংস্কৃতিক, জাতিস্বত্তার ঐতিহ্যের প্রতি জোর দিয়ে আঞ্চলিক ভাষার ব্লগস্ফিয়ার বিকশিত হচ্ছে। বাংলাদেশে প্রচলিত প্রচার মাধ্যমে ব্লগ উপেক্ষিত এবং নিজেদের রক্ষার জন্য স্বআরোপিত নিষেধাজ্ঞা বলবৎ করে থাকে, কিন্তু ব্লগাররা সমস্ত প্রতিবন্ধকতা ভেঙে গুড়িয়ে দিয়ে তাদের মতামত নির্ভিকচিত্তে তুলে ধরছে এবং এখন কয়য়েকজন সাংবাদিক তাদের তদন্তমূলক প্রতিবেদন ব্লগে প্রকাশ করতে পছন্দ করছে।

শ্রীলংকার জাতিগত সমস্যা সম্বন্ধে ব্লগারদের অভিমত, গনতন্ত্রের পথে নেপালের যাত্রা, ভুটানের সংস্কৃতি এবং মালদ্বীপের সূদীর্ঘকালের রাষ্ট্রপতির বিরোধীতার খবর জানা বেশ আকর্ষণীয়।

এসব দেশের প্রচলিত প্রচার মাধ্যম তিক্ত রাজনীতি অনুসরণ করে; ফলে এইসব দেশগুলোর মধ্যে উত্তরোত্তর জাতীয়তাবাদ এবং ঘৃণা বৃদ্ধি পায়। যদি কিছু সাধারণ ঘটনার দিকে তাকান (যেমন ভারত ও পাকিস্থানের সীমান্ত গন্ডগোল) এবং উভয় দেশের পত্রিকার কভারেজ দেখেন তবে বুঝতে পারবেন যে প্রতিবেদকরা কি ভয়ংকর রকমের একপেশে। অন্যদিকে ব্লগাররা এসব বিষয়ে একটা মানবীয় স্পর্শ দিয়ে দূরত্বের মাঝে সেতু স্থাপন করে থাকে এবং এই দেশগুলোর মাঝে শত্রুর বদলে বন্ধুত্ব তৈরী করছে।

উপরে রেজওয়ানের ছবি জেন ব্রিয়া তুলেছেন এবং এখানে ক্রিয়েটিভ কমনস লাইসেন্সের আওতায় ব্যবহার করা হয়েছে।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .