আনহার্ড ভয়েসেস ব্লগ ইউএনডিপি থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে গতমাসে বাংলাদেশের ভয়াবহ আতঙ্কের চিত্র তুলে ধরে:
গগনচুম্বী তেলের দাম বিশ্বব্যাপী খাদ্যের দাম বাড়িয়েছে কিন্তু এর তীব্রতা ভয়াবহ রূপে প্রতিফলিত হয়েছে বাংলাদেশে যেখানে সাড়ে চৌদ্দ কোটি জনসংখ্যার অর্ধেক দৈনিক এক ডলারের নীচে আয় করে থাকে।
যারা জানেন না তাদের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, চাল হচ্ছে বাংলাদেশের প্রধান খাদ্যশস্য যার দাম বিগত এক-দেড় বছরের মধ্যে দ্বিগুণ হয়েছে। ফলশ্রুতিতে, এই লোক বহুল দেশের দরিদ্ররা সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
ডাব্লু এফ পি (বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচী) সতর্ক করে দিয়েছে:
খাদ্যের বিশেষ করে চালের বাড়ন্ত দাম দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে পারে যেহেতু দরিদ্র পরিবারগুলোকে এখন উপার্জনের ৮০ ভাগই খাদ্যের পেছনে ব্যয় করতে হচ্ছে।
হিমু একটা পত্রিকার নিবন্ধ থেকে উদ্ধৃত করে দেখান কিভাবে এখন দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত বাংলাদেশীরা কোনমতে টিকে থাকছে। জনগণ ভাল নেই এবং ব্লগ, মিডিয়া সর্বত্রই আপনি তাদের দুর্দশা ও ক্ষোভের কথা শুনতে পাবেন।
ইন দ্যা মিডল অফ নোহোয়ার এর রুমি আহমেদ তার “ইজ ইট হিয়ার” লেখায় দুর্ভিক্ষ বিষয়ে প্রশ্ন করেছেন। একজন চর্ম সার লোকের ছবি দিয়ে যাকে অনেকটা নেশাখোরের মত দেখতে, বলেছেন:
সমাজের সবচেয়ে অসহায় ও দরিদ্রদের মধ্যে দরিদ্রতম হচ্ছে আবাসনবিহীন মানুষ। নিরাপদ অবস্থান থেকে এদের মধ্যে প্রথম অবনতি ঘটছে মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধী, নেশাসক্ত, বয়স্ক ও শিশুদের। বাংলাদেশের কংকালসার মানুষের এমন ছবি শেষ দেখেছিলাম অনেক বছর আগে।
মুদ্রণ মাধ্যমে ক্ষুধা জনিত মৃত্যু সংবাদ আসতে শুরু করেছে। এই নিবন্ধটি কয়েকটি এমন মৃত্যু সংবাদ নিশ্চিত করেছে।
এমনকি খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় স্বীকার করেছে, কোন দুর্ভিক্ষ নয় তবে দেশে সংগোপিত ক্ষুধা বিরাজমান।
এর মাঝে সেনাবাহিনী প্রধান ভাতের পরিবর্তে আলু খাবার উৎসাহ ধর্মী বক্তব্য দিলে ব্লগাররা তাকে তীব্রভাবে সমালোচনাবানে বিদ্ধ করেন। সেনাপ্রধানের মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া স্বরূপ শফিউর আলু ভর্তার রেসিপি পর্যন্ত লিখে ফেলেছেন।
এই আসন্ন দুর্যোগের পেছনে বহুবিধ কারণ রয়েছে। বাংলাদেশের জন্য ২০০৭ ছিল প্রাকৃতিক দুর্যোগ কবলিত একটা বাজে বছর। প্রলম্বিত বন্যা এবং বিধ্বংসী সিডরের কারণে স্বাভাবিকের চেয়ে দেশে অনেক কম ফসল উৎপন্ন হয়েছে। তদুপরি নতুন সরকার অনভিজ্ঞতাহেতু খাদ্য ঘাটতি এবং প্রয়োজনীয় খাদ্য মজুদ অনুমান করতে ব্যর্থ হয়েছে – যদিও তাদেরকে সতর্কিত করা হয়েছিল বিভিন্ন মাধ্যমে। ফলত: সরবরাহের ঘাটতি দামের উপর প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। উপরন্তু কয়েক বৎসর পূর্বে বিশ্ব ব্যাংক ও আই এম এফ (আন্তর্জাতিক মুদ্রা ফান্ড) এর চাপে সরকার নিয়ন্ত্রিত খাদ্য বন্টন কেন্দ্রগুলোও বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। ফলে, সরকারের দেশব্যাপী নিজস্ব বণ্টন অবকাঠামো না থাকায় কেবল মাত্র কতিপয় ক্ষুদ্র রেশনিং কেন্দ্রের মাধ্যমে কোনভাবেই দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হচ্ছে না।
সুবিনয় মুস্তফি, একজন ব্লগার ও পেশাজীবি অর্থনীতিবিদ বাংলা ব্লগ “না বলা কথা” য় প্রকাশিত পোস্টে চালের দাম বৃদ্ধির কারণ বর্ণনা করেছেন:
১) চাল উৎপাদনকারী দেশগুলোতে সাম্প্রতিক দুর্যোগ পূর্ণ আবহাওয়া শস্য উৎপাদনকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
২) পাশাপাশি ব্যাপক নগরায়নের ফলে চাল উৎপাদনের জন্যে পূর্বে বরাদ্দ অনেক ক্ষেত-খামার ভরাট করে ফেলা হয়েছে, তার উপর রাস্তা-ঘাট বা বিল্ডিং নির্মাণ করা হয়েছে। এতে চাল উৎপাদনের পরিমাণ কমে গেছে।
৩) আরো আছে চীন ও ভারত সহ অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশ থেকে চালের বাড়ন্ত চাহিদা। এইসব দেশে দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাথে সাথে সমাজের সকল স্তরে বিভিন্ন প্রকারের খাবারের চাহিদা বেড়েছে।
অতএব ব্যাপক চাহিদা বৃদ্ধি ও যোগানের ঘাটতির কারণে বিশ্ব বাজারে চালের দাম বিশ বছরের মধ্যে সর্বাধিক বৃদ্ধি পেয়েছে।
দামের বৃদ্ধির কারণে প্রধান চাল উৎপাদনকারী দেশ যেমন ভিয়েতনাম, মিশর এবং ভারত রপ্তানীর পরিমাণ কমিয়েছে এবং অভ্যন্তরীণ বাজারে চালের দাম নিয়ন্ত্রণ রাখার দিকে দৃষ্টি দিয়েছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বৃহৎ চাল সরবরাহকারী রাষ্ট্র প্রতিবেশী ভারত চালের রপ্তানী মূল্য ১২০০ ডলার নির্ধারণ করেছে যা ছ'মাস আগের তুলনায় তিন গুণ। সর্বোপরি, বিশ্বব্যাপী খাদ্যের মজুদ সর্বকালের চেয়ে এখন সবচেয়ে কম।
জ্যোতি আনহার্ড ভয়েসে দাবী করেছেনঃ
নিম্নোক্ত চার্টে দেখা যায় ২০০৭ এর শুরু থেকে রুপীর বিপরীতে টাকার মুদ্রামানের অবনতি ঘটেছে ২০ পয়সা।
বৈশ্বিক ফ্যাক্টরগুলো (এখানে দেখুন) ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়া কেবল মাত্র এই অবনমন আমাদের খাদ্যের বাজারকে অশান্ত করতে পারত।
সুবিনয় মুস্তফি আরো দেখান যে মুদ্রাস্ফীতির কারণে বাংলাদেশের দরিদ্র মানুষের ক্রয় ক্ষমতা (আসল আয়) ৫% কমেছে যদিও মোটের উপরে জিডিপির বৃদ্ধি ঘটেছে ৫%।
এই অবস্থা অদূর ভবিষ্যতে এমনই বিরাজ করবে। ২০০৮ এর ২৮শে মার্চ ফিন্যানন্সিয়াল টাইমসের এক নিবন্ধে তুলে ধরা হয়:
গত বৃহস্পতিবার আড়াইশ কোটি মানুষের প্রধান খাদ্য শস্য চালের দাম সর্বকালের মধ্যে সবচেয়ে বেশী ৩০% বৃদ্ধি পেলে এশিয়াব্যাপী ভয়াবহ সামাজিক অস্থিরতার স্পষ্ট ভীতি সঞ্চারিত হয়েছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে কিভাবে এই অবস্থাকে সামলে ওঠা যায়। বিখ্যাত লেখক আনিসুল হক বাংলা ব্লগ না বলা কথা তে ভারতীয় নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন এর উদ্ধৃতি দিয়েছেন:
দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ করা খুবই সহজ যদি মারাত্মক উদ্যোগ সত্যিই নেয়া যায় এবং নির্বাচন, বিপক্ষদল এবং স্বাধীন সংবাপত্রের সমালোচনা সহ্য করে একটা গনতান্ত্রিক সরকারের জন্য এমন উদ্যোগ নেয়া ছাড়া দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধে ভিন্ন কোন উপায়ও থাকে না।
বিবিসির সাম্প্রতিক একটা বিতর্কে (বাংলায়) রাজনীতিবিদ ও সাধারণ মানুষের মধ্য থেকে অংশগ্রহণকারীরা এই কথাই উচ্চারণ করেছেন জোরেশোরে এবং বাংলাদেশকে চটজলদি গনতন্ত্রের পথে ফিরে যেতে হবে বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন।
এ্যান অডিনারী সিটিজেন জানান যে সরকার গরীবদের জন্য ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরী করতে যাচ্ছে – এপ্রিল পর্যন্ত এক কোটি টাকার এ প্রকল্প দরিদ্রদের জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির সাথে তাল মিলিয়ে ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে।
সরকার বসে আছে বাম্পার ফলনকৃত বোরোশষ্যের বাজারে আগমন প্রত্যাশায়, আশা করছে বাজারে এলেই চালের দাম কমতে শুরু করবে। এই সংবাদের সাথে যুক্ত হয়েছে সরকারী ব্যবস্থাপনায় ভারত থেকে সম্প্রতি আমদানীকৃত চালের খবর যা শুনে মনে হচ্ছে, আপাতদৃষ্টিতে, চালের দাম নিয়ন্ত্রণে থাকবে। কিন্তু সাধারণ মানুষের আশংকা এখনও সর্বগ্রাসী – এই প্রচেষ্টা কি সংগোপিত ক্ষুধা কমানোর জন্য যথেষ্ট হবে?