বাংলাদেশ: কয়লার বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সুন্দরবন রক্ষায় ৪০০ কি.মি. লংমার্চ

পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন বাংলাদেশের সুন্দরবনের কাছে রামপালে প্রস্তাবিত তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের প্রতিবাদে লংমার্চ করেছে একটি সংগঠন। গত ২৪ সেপ্টেম্বর ঢাকা থেকে লংমার্চ শুরু হয়ে ২৮ সেপ্টেম্বর রামপাল প্রকল্প অঞ্চলে গিয়ে শেষ হয়। এই লংমার্চের আয়োজন করেছে বাংলাদেশ তেল গ্যাস খনিজসম্পদ, বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি

ভারতের সাথে যৌথ উদ্যোগে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মিত হচ্ছে বাগেরহাট জেলার রামপালে যা সুন্দরবন থেকে মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত (বিস্তারিত প্রতিবেদন দেখুন গ্লোবাল ভয়েসেস অনলাইনের এই প্রতিবেদনে)। এই প্রকল্পের প্রস্তুতিমূলক কাজ ও জমি দখল ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে।

শুরু থেকেই পরিবেশবাদী সংগঠনসহ অনেকেই এই প্রকল্পের বিরোধীতা করছেন। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দ্বারা পরিবেশের উপর প্রভাব নিয়ে জাতিসংঘের সংস্কৃতি ও বিজ্ঞান বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সেন্টারও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। উল্লেখ্য, ইউনেস্কো ১৯৯৭ সালে সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ ঘোষণা করে। এদিকে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিরোধীতায় লংমার্চের প্রেক্ষাপটে গত ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৩ তারিখে সরকার একটি প্রেসনোট জারি করে। প্রেসনোটে বলা হয়েছে, এই বিদ্যুৎকেন্দ্র হবে সুন্দরবন থেকে ১৪ কিলোমিটার এবং ইউনেস্কোর স্বীকৃত ন্যাশনাল হেরিটেজ সাইট থেকে ৭২ কিলোমিটার দূরে, যাকে ‘নিরাপদ দূরত্বে’ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

আগামী ২২ অক্টোবর ২০১৩ তারিখে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির নির্মাণ কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হবে বলে প্রাথমিকভাবে জানা যায়। এদিকে ২৮ সেপ্টেম্বর, লংমার্চের সমাপনী দিনে ১১ অক্টোবরের মধ্যে প্রকল্পের নির্মাণ কাজ বন্ধের আলটিমেটাম দেয়া হয়েছে। তা না হলে ১২ অক্টোবর কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি। তবে সর্বশেষ খবরে জানা যায় যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির নির্মাণ কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করবেন ৫ই অক্টোবর শনিবার। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ভিডিও কনফারেন্সিং এর মাধ্যমে তার সাথে যোগ দেবেন।

সুন্দরবন রক্ষায় লংমার্চ কর্মসূচী। ছবি মোহাম্মদ আসাদ। স্বত্ত্ব: ডেমোটিক্স (২৪/০৯/২০১৩)

সুন্দরবন রক্ষায় লংমার্চ কর্মসূচী। ছবি মোহাম্মদ আসাদ। স্বত্ত্ব: ডেমোটিক্স (২৪/০৯/২০১৩)

বাম রাজনৈতিক কর্মী ফিরোজ আহমেদ তার ফেসবুক নোটে দেখিয়েছেন এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র কীভাবে পরিবেশ বিপর্যয় ডেকে আনবে:

[…] কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে উদ্গীরিত বিশাল ধোঁয়ার রাশি গ্রীষ্মকালে মৌসুমী বায়ুর সাথী হয়ে গোটা উত্তরবঙ্গ এবং মধ্যবঙ্গকে কলুষিত করবে,সমুদ্র থেকে ভেসে আসা জলীয় বাষ্প কয়লার ধোঁয়ার সালফারের সাথে মিশে তৈরি করবে সালফিউরিক এসিড। মারাত্মক অম্ল বৃষ্টিতে আক্রান্ত হবে এই অঞ্চলের মানুষ, প্রাণ, প্রকৃতি, কৃষি। শীতকালে আবার উত্তুরে বায়ুর ধাক্কায় তা আচ্ছাদিত করবে গোটা সুন্দরবনকে, সেখানাকার স্পর্শকাতর প্রাণ ব্যবস্থা অচিরে বিলুপ্ত হবে। বঙ্গোপসাগরের মাছের ভাণ্ডার, তিমি আর ডলফিনের বিচরণক্ষেত্রও বিনষ্ট হবে।

তাই তিনি সবাইকে সুন্দরবন রক্ষার লংমার্চে শরিক থাকার আহবান জানিয়েছেন।

সুন্দরবন আমাদের যেমন প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করে, তেমনি খাদ্যসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের যোগানও দিয়ে থাকে। এজন্য সুন্দরবনকে রক্ষা করা সবার দায়িত্ব বলে মনে করেন ব্লগার, অ্যাক্টিভিস্ট কল্লোল মোস্তফা:

সুন্দরবন আমাদের অস্তিত্বের সাথে যুক্ত। সুন্দরবন এতদিন আমাদের গোলপাতা, কাঠ, মোম,মধু,মাছ দিয়েছে, প্রতিরক্ষার দেয়াল হিসেবে ঘূর্ণিঝড় থেকে বাঁচিয়েছে। সেই সুন্দরবনের অস্তিত্ব যখন রামপাল কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য হুমকিগ্রস্ত, তখন সেই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিপদ থেকে সুন্দরবনকে বাঁচানো আমাদেরই দায়িত্ব।

লংমার্চে সুন্দরবনের জীব-বৈচিত্র্য রক্ষার আহবান। ছবি ইন্দ্রজিৎ ঘোষ। স্বত্ত্ব: ডেমোটিক্স (২৪/০৯/২০১৩)।

লংমার্চে সুন্দরবনের জীব-বৈচিত্র্য রক্ষার আহবান। ছবি ইন্দ্রজিৎ ঘোষ। স্বত্ত্ব: ডেমোটিক্স (২৪/০৯/২০১৩)।

এদিকে সাংবাদিক, সাংস্কৃতিককর্মী আহমেদ মুনীরুদ্দিন সুন্দরবন রক্ষার এই লংমার্চ নতুন এক ইতিহাস লিখতে যাচ্ছে বলে উল্লেখ করেছেন:

মনোভূমির লড়াই, ভাষার লড়াইয়ে জিতে আমরা বিশ্বের সাংস্কৃতিক মানচিত্রে ‘একুশে’র ইতিহাস গড়েছি। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনভূমি আর সেখানকার প্রাণবৈচিত্র্য জাগিয়ে রাখার লড়াইয়ে জিতলে, সারা দেশে সেই চেতনা বিকশিত করতে পারলে তা হয়তো একদিন দুনিয়ার প্রাণ-প্রকৃতির লড়াইয়ে আরেকটা ‘একুশ’ হয়ে থাকবে।

এভারেস্টজয়ী বাংলাদেশী মুসা ইব্রাহিম (@beyondallpeaks) সুন্দরবনের কাছে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন না করার অনুরোধ জানিয়ে টুইট করেছেন:

সুন্দরবনকে রক্ষার আহবান জানিয়ে জাওয়াদুল ফাত্তাহ (@JawwadulFattah) টুইট করেছেন:

ব্লগার আকতার আহমেদ বিষয়টি নিয়ে ব্যঙ্গ করে ফেসবুকে লিখেছেন:

সুন্দরবনের ক্ষতি হইলে হোক। আমাদের বিদ্যুৎ কেন্দ্র দরকার। ইলেকট্রিসিটি থাকলে বাঘ, হরিণ, গাছপালা এইসব টিভিতেও দেখা যাবে। ব্যাপার না!

এদিকে পরিবেশকর্মী মুনতাসির মামুন অন্য এক দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি দেখেছেন। তিনি তার ফেসবুকে লিখেছেন:

আমি জানি কথাটা আমার বন্ধুদের খারাপ লাগবে, রামপাল নিয়ে আমার বেশ কিছু নামিদামী বন্ধুরা ব্লগীং এবং স্ট্যাটাস আপডেটের মাধ্যমে এর বিরোধিতা করে আসছেন। কিন্তু খুবই লজ্জার বিষয় হলো তাদের সবারই বসার ঘরে এসি আছে ! এমনও কয়েকজন আছেন যারা মিনি এসি নিয়েই ঘোরেন। তো সরকার কেন আপনাদের কথা শুনবে? সরকারতো জানেই আপনাকে তুষ্ট করার জন্যই এত কিছু।

কানাডা প্রবাসী সাংবাদিক শওগাত আলী সাগর সরকারের কাছে এই প্রকল্পের পরিবেশ ও অর্থনৈতিক সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশের দাবি জানিয়েছেন:

রামপাল নিয়ে কোনো ধরনের গোয়ার্তুমি বা রাজনৈতিক বক্তব্য চাই না। সরকারের উচিত হবে প্রস্তাবিত প্রকল্প স্থাপনের আগে পরিবেশ এবং অর্থনৈতিক উপযোগিতার যে সমীক্ষা (যদি হয়ে থাকে) হয়েছে তার তথ্য জনসম্মুখে প্রকাশ ও প্রচার করা।

1 টি মন্তব্য

আলোচনায় যোগ দিন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .