গাজার অনিবার্য বাস্তবতা: চড়ুই, সাইরেন ও বেঁচে থাকা

'বাড়ির উপরের শান্ত আকাশ ভেঙে আসা ক্ষেপণাস্ত্রের আতঙ্কে চোখ বিস্ফারিত'

ইসরায়েলি বিমান ৮ অক্টোবর, ২০২৩, গাজা শহরের পশ্চিমে আল-কুদস উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে আল-নাসর সড়কে বাতনিজি ও বদরাসাউই পরিবারের পাঁচতলা ভবন ধ্বংস করে। অনুমতি নিয়ে মোহাম্মদ জানোনের ইনস্টাগ্রামের ছবি ব্যবহার করা হয়েছে।

অবিরাম বোমা হামলার মধ্যে একটি ব্যক্তিগত বর্ণনা হিসেবে ইমান আশরাফ আলহাজ আলী লিখিত এই গল্পটি ৯ অক্টোবর, ২০২৩-এ আমরা শুধু সংখ্যা নই-তে প্রথমবার প্রকাশিত হয়

শনিবার ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলনের (হামাস) আক্রমণের পর ইসরায়েল গাজা উপত্যকায় ১৬ বছরেরও বেশি সময় ধরে অবরোধ সহ্য করে এই অঞ্চলে আটকে থাকা বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপত্তা উপেক্ষা করে একটি বড় আকারের বিমান হামলা শুরু করেছে। তার ওপর ইসরায়েলের পদক্ষেপের মধ্যে খাদ্য, জল, জ্বালানী ও বিদ্যুতের মতো প্রয়োজনীয় সংস্থানগুলির সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে  ভূ-খণ্ডে বন্দী ২৫ লক্ষেরও বেশি মানুষের জীবনকে বিপন্ন করে তোলার মতো “সম্মিলিত শাস্তি” অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সাম্প্রতিক এসব ঘটনায় প্রাণহানির পরিমাণ ব্যাপক।

ইসরায়েলি দখলদারিত্বে বসবাস করার বিষয়ে আমি যে জিনিসটি জানাতে চাই তা হলো পাখির গান খুব দ্রুতই মিসাইলের চিৎকারে পর্যবসিত হতে পারে। গাজার বেশিরভাগ সকালে, আমার পরিবার আমাদের রান্নাঘরের জানালায় স্পেনীয় চড়ুইয়ের সুরেলা ঐক্যতানে জেগে ওঠে। আমার মা কোমলভাবে আমার ছোট ভাইবোনদের জাগিয়ে তোলার পর সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ স্নাত আমাদের দিনগুলি ভোরের প্রার্থনার সাথে শুরু হলে এমনকি আমরা আমাদের সতর্কভাবে তৈরি করা করণীয় তালিকাগুলি সম্পাদনের প্রত্যাশা করি।

তবে ৭ অক্টোবরের সকাল আমাদের মনে করিয়ে দেয় আমাদের কার্যসুচি যতো পবিত্রই হোক না কেন তা কখনোই নিরাপদ নয়। ক্ষেপণাস্ত্রের বিকট গর্জন আমাদের বাড়ির উপরে শান্ত আকাশকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে আমার চোখ চকচক করে উঠে আতঙ্ক ঘিরে ধরে।

“মা, কী হচ্ছে?” আমার কন্ঠস্বর কেঁপে উঠলো।

আমার  ছয় থেকে ১২ বছর বয়সী ভাই-বোনেরা সবেমাত্র স্কুলে গেছে। আমরা দৌড়ে জানালার কাছে গিয়ে রাস্তায় সাহায্যের জন্যে তাদের ভয়ার্ত কণ্ঠে চিৎকার করতে দেখলাম। “এখনই ফিরে এসো!” আমার মা অনুনয় করে ডাকলেন।

“ভয়ঙ্কর আতঙ্কের দিনগুলি ফিরে এসেছে … আবার,” আমি ফিসফিসের মতো বিড়বিড় করে বললাম। আমি আমার ফোনের কাছে গিয়ে ডিজিটাল জগতে উত্তর খুঁজি। “অতর্কিত হামলার পর ইসরায়েলের ‘মারাত্মক প্রতিশোধের’ প্রতিশ্রুতি“র মতো শিরোনামগুলি আমার চোখে জল এনে দেয়। ঘটনার এতো দ্রুত মোড় বোঝা কঠিন হলেও গাজার জীবন এমনই। পাখির গানের পরের মিনিটে ক্ষেপণাস্ত্রের (ঝঙ্কার)।

কিছুদিন আগেও জীবন মসৃণভাবে এগোচ্ছিল। আমি কাজের পরে জিমে যাওয়ার পর আমার বন্ধু আসমার সাথে দেখা করে আসতাম। গাজায় আমরা দৃশ্যমানতার নিচে লুকিয়ে থাকা সত্যগুলো বের করার জন্যে হৃদয়বিদারক বাস্তবতার গভীরে অনুসন্ধান করার জরুরী প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা করতাম। একেবারে বুঝতেই পারিনি যে আমরা আরেকটি ছিন্নভিন্ন স্বপ্ন ও যন্ত্রণাদায়ক অগ্নিপরীক্ষার জন্যে জেগে উঠবো।

গত কয়েকদিন ধরে একজন ব্যক্তিকে তার পুরো পরিবার থেকে বঞ্চিত করা ছেড়ে বেসামরিক বাড়ির দিকে ইসরায়েলের দৃষ্টিপাতের মতো একটির চেয়ে আরো বেশি অসহনীয় ও হৃদয় বিদারক সংবাদের বর্ষণ চলছে। একটি অল্পবয়সী মেয়ে তার প্রিয় বন্ধুকে হারিয়ে শোক করেছে। হতাহতের সংখ্যা বেড়ে শতাধিক। ধ্বংসস্তূপ থেকে আরো লাশ বের হয়েছে। অগণিত ভবন ধ্বংসস্তূপে পড়ে আছে, গণহত্যা ও জাতিগতহত্যায় ক্ষতিগ্রস্ত একটি দৃশ্যপট। আমাদের বিশ্বাসের প্রতীক মসজিদ ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে এবং লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে অন্তত দুটি অ্যাম্বুলেন্স।

এখনো সাইরেনের বীভৎস আর্তনাদ আমাকে দিশেহারা করে। আমাদের বাড়ির কাছে ক্ষেপণাস্ত্রের বধিরকারী দুর্ঘটনা আমার ধৈর্যের পরীক্ষা করছে। আর আসন্ন বিপদের আভায়  আমার জানালাকে লাল করে দিলেও আমি আমার উপর দায়িত্বের ভার অনুভব করলেও চাপ নেওয়া ছাড়া আমার কোন উপায় নেই। আমার সময়সীমা পূরণে ব্যর্থতার কোনো সুযোগ নেই জেনে আমি আমার ল্যাপটপ আঁকড়ে ধরে রেখে নিজেকে মনোযোগ দিতে বাধ্য করি।

গাজার প্রতিটি পরিবারের মতো আমাদের হঠাৎ সরে যাওয়ার জন্যে প্রয়োজনীয় পোশাক ও কাগজপত্রের জরুরি ব্যাগ প্রস্তুত রয়েছে। অজানা ভয়ে আবদ্ধ একটি পরিবারের আমরা একসাথে জড়ো হয়ে থাকি;  ব্রেকিং নিউজের অবিরাম স্রোতের সাথে জড়িয়ে রয়েছে আমাদের প্রার্থনা।

তিক্ত অস্তিত্বের এই গাজা প্রতিটি দিন আমাদেরকে প্রান্তিকতার কাছাকাছি নিয়ে আসে। আমাদের সন্তানদের সরলতা ও আনন্দ এবং আমাদের জানালা থেকে পাখির গান চুরি করে নিয়ে আমাদের ঘাড়ে চেপে ধরা একটি অন্যায্য নিপীড়কের ভারে চাপা একটি অমানবিক ও নির্দয় পরিস্থিতিতে আমরা প্রতিদিন মৃত্যুর করাল মূর্তির মুখোমুখি হই।

Exit mobile version