এক বাংলাদেশি পর্যটকের চোখে কাশ্মীরের কারফিউয়ের দিনগুলি

কাশ্মীরের মানুষ নিজেরাই কারফিউ দিয়েছে, যাকে বলে সিভিল কারফিউ

শ্রীনগর এর ডাল হ্রদ, কাশ্মীর। ছবি তুলেছেন ফাতিমা জাহান। অনুমতি নিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে।

ফাতিমা জাহান জন্মসূত্রে বাংলাদেশি হলেও থাকেন ভারতের ব্যাঙ্গালোরে। ভ্রমণ তার পছন্দ আর সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন ঘুরতে। আর ঘোরাঘুরির প্রিয় জায়গার তালিকায় আছে ভূস্বর্গ খ্যাত কাশ্মীর

এবারো তার কাশ্মীর যাবার প্রস্তুতি ছিল, কিন্তু ভ্রমণের সময় আসার আগেই সেখানকার রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে। আগস্ট মাসের ৫ তারিখে ভারতের সংবিধানে কাশ্মীরকে যে বিশেষ স্বায়ত্বশাসিত এলাকার মর্যাদা দেয়া ছিল ৩৭০ ধারা অনুযায়ী – তা বাতিল করে ভারত সরকার। সাথে সাথে শত শত রাজনৈতিক নেতা এবং তাদের সঙ্গীদের গৃহবন্দী করে এবং প্রদেশটির মোবাইল ফোন, ল্যান্ড লাইন ও ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়

আরও পড়ুন: ভারতের কাশ্মীর সঙ্কট

তার টিকেট কাটা ছিল আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহে। ততদিনে সেখানে কারফিউ শিথিল করা হয়েছিল, যদিও অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রিত ছিল। ফাতিমা তার যাত্রা অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নেন এবং কয়েক দিন থাকার পড় আবার ব্যাঙ্গালোরে ফিরে আসেন। তার কাশ্মীরের অভিজ্ঞতা তিনি ফেসবুকে ধারাবাহিকভাবে কয়েকটি পোস্টের মাধ্যমে শেয়ার করেছেন যার থেকে উল্লেখযোগ্য অংশ আমরা নীচে তুলে ধরছি।

কারফিউর সময় জীবন অনিশ্চিত হয়ে পরে আর সময় থমকে দাঁড়ায়। ডাল হ্রদ, শ্রীনগর, কাশ্মীর। ছবি তুলেছেন ফাতিমা জাহান। অনুমতি নিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে।

এখানে তার ভ্রমণের প্রথম দুই দিনের ঘটনার বর্ণনা করা আছে।

২০/০৮/২০১৯ আগমন

সপ্তম বারের মত কাশ্মীরে এসেছি।

[…] প্লেন থেকে নেমে দেখি বাইরে সব থমথমে। এয়ারপোর্টের কোন দোকান খোলা নেই। আমি কোন অফিসারের দিকে ভয়ে তাকাচ্ছিলাম না। তাকানোর অপরাধে যদি ফেরত পাঠায়। লাগেজ বেল্টে লাগেজ পাওয়ার সাথে সাথে বেরিয়ে পড়লাম। পুরো ফ্লাইটের যাত্রীর মধ্যে আমি একমাত্র ট্যুরিস্ট।

এই রাস্তাটি সচরাচর অনেক ব্যস্ত থাকত। ছবি তুলেছেন ফাতিমা জাহান। অনুমতি নিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে।

২০/০৮/২০১৯ঃ কারফিউর সময়ে কাশ্মীর

শ্রীনগর এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে প্রিপেইড ট্যাক্সি স্ট্যান্ড থেকে ট্যক্সি নিলাম। বের হয়ে দেখি শহর থমথমে। এখন বাজে সকাল ৭.৩০। বাইরের তাপমাত্রা ১৩° সেলসিয়াস। পরশু কারফিউ তুলে দেয়া হয়েছে। কোন দোকানপাট খোলা নেই। স্থানীয় মানুষজন দু’ একজন বেরিয়েছে বাজার করার জন্য। কেউ গাড়ি বের করেনি। হেঁটেই চলাফেরা করছেন, ২/১ জন মহিলাকে দেখলাম হেঁটে বাজারে যাচ্ছেন। ট্যাক্সিচালক এজাজ ভাই বললেন আমাকে পৌঁছে দিয়ে তিনি বাড়ি চলে যাবেন। দিন চালানোর জন্য একজন প্যাসেঞ্জারই যথেষ্ট এখন।

এজাজ ভাই বললেন কোন অপরাধে আর্মি ধরে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে সে ভয়ে কেউ ঘরের বাইরে থাকেনা। দোকানপাট বন্ধ তাই খুব হিসেব করে আগের করা বাজার খরচ করতে হচ্ছে, পরে অবস্থা কি হয়, কিভাবে সংসার চলবে কে জানে!

এজাজ ভাই আরো জানালেন এখানকার সব হোটেলে পুলিশ সিল করে দিয়েছে। গেস্ট রেজিস্ট্রার বইয়ে আগস্ট ৫ এ লিখে দেয়া হয়েছে এরপর আর কোন গেস্ট রেজিস্ট্রার হবেনা।

রাস্তা ভরে গেছে আর্মিতে। এত আর্মি আগে একসাথে দেখিনি। প্রতি তিন মিটার দূরত্বে একজন আর্মি পারসন দাঁড়িয়ে আছেন পাহারায়।

আমি যাব হোসেন আঙ্কেলের হাউসবোটে। আমাকে ডাল গেট নং ৭ এ এজাজ ভাই নামিয়ে চলে গেল। শিকারা নিয়ে পৌঁছালাম হাউসবোট, হোসেন আঙ্কেলের হাউসবোট আর বাড়ি।

ডাল হ্রদের শিকারা নৌকা। ছবি তুলেছেন ফাতিমা জাহান। অনুমতি নিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে।

AFSA [army force special power act] ১৯৯০ সাল থেকে চালু আছে। আর্মির হাতে সমস্ত ক্ষমতা অর্পন করা হয়েছে। আর্মি যে কাউকে তুলে নিয়ে যেতে পারে, সিভিলিয়ান বা মিলিট্যান্ট যে কাউকে গুম বা হত্যার জন্য আর্মিকে কোন জবাবদিহি করতে হয়না এই ধারার কারনে। হাজার হাজার মানুষের গনকবর আছে বারামোল্লা, উডি এসব জায়গায়। যুবকদের তুলে নিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে মিলিট্যান্ট সন্দেহে। গ্রামের পর গ্রাম উজাড় করে দেয়া হয়েছে এভাবে।

৫ আগস্ট, ২০১৯ থেকে নাকি অনেক যুবককে গ্রেফতার করা হয়েছে, যার কোন খবর জানা যাচ্ছেনা।

পরশু কারফিউ তুলে নেবার পর এখানকার মানুষ নিজেরাই কারফিউ দিয়েছে, যাকে বলে সিভিল কারফিউ। কেউ দোকান খোলেনি, কেউ কোথাও কাজ করছেনা। ৩৭০ ধারা তুলে নেবার যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে তার বিরোধিতা করে।

ছবি তুলেছেন ফাতিমা জাহান। অনুমতি নিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে।

PSA [public safety act] ধারা ১৯৭৮ সাল থেকে কার্যকর করা হয়েছে। এর কারনে কোন ধরনের মিটিং, মিছিল নিষিদ্ধ কাশ্মীরে। তবে মিছিল বের হয় এবং ধরপাকড়ও হয়।

এবারের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ, টেলিফোন, ইন্টারনেট লাইন বন্ধ। বাইরের জগতের সাথে কোন যোগাযোগ নেই। তবুও মিছিল বের হচ্ছে শহরে আর সেখানে মিছিলে পেলেট বা স্প্লিন্টার ছোড়া হচ্ছে আর্মির পক্ষ থেকে। এসব খবর মুখে মুখে ছড়াচ্ছে।

এবার কারফিউ এর আগে পুলিশের কাছ থেকে পাওয়ার নিয়ে নেয়া হয়েছে, পুলিশের অস্ত্র জমা নিয়ে রেখে দেয়া হয়েছে। এয়ারপোর্ট থেকে আসার পথে কোন পুলিশ তো দেখলামও না।

বেশিরভাগ রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতার করে দিল্লী, আগ্রার জেলে পাঠানো হয়েছে। শোনা গেছে কাশ্মীর আর জম্মুর সব জেল নাকি ভরে গিয়েছে। অবশ্য তা শোনা কথা।

কারফিউ শিথিল করার পর থেকে কেউ গাড়ি বের করছেন না। কারণ পেট্রোল পাওয়া যাচ্ছেনা তাই। বাস চলছেনা।

বিকেলে হোসেন আঙ্কেলকে বললাম লেকপাড়ে যাব শহরের পরিস্থিতি দেখতে। আঙ্কেল মানা করলেন। বললেন, ‘কাল যেও। আজ শহর মোটেই ঠান্ডা নয়।’

২১/০৮/২০১৯: দ্বিতীয় দিন

ব্যক্তিগত জীবনে কোন কাজের তাড়া নেই। আর কারফিউ এর কারণে কোথাও যাবারও প্ল্যান নেই। হুসেন আঙ্কেলের দু'টো হাউসবোটের একটিতে নিজেরা থাকেন আর আরেকটি রেখেছেন ট্যুরিস্টদের জন্য। আমি এখন আছি ট্যুরিস্টদের বিশাল হাউসবোটে একা। সব ধরনের ট্যুরিসম বন্ধ এখন কাশ্মীরে। তবে লাদাখের অবস্থা স্বাভাবিক।

নাস্তা করতে করতে হুসেন আঙ্কেলের ছেলে শেহজাদের সাথে কথা হচ্ছিল। গতকাল নাকি শালিমার গার্ডেনের দিকে মিছিল বের হয়েছিল। পরের খবর কেউ জানেনা। কতজন গ্রেফতার, আহত, নিহতের সংখ্যা জানার উপায় নেই। টেলিফোন, ইন্টারনেট বন্ধ।

সরকারী ভবন আর ব্রিজের সামনে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা। ছবি তুলেছেন ফাতিমা জাহান। অনুমতি নিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে।

পাবলিক সেইফটি এক্টের কারনে মিছিল বের করার অনুমতি নেই। আগে একবার সরকার অনুমতি দিয়েছিল মিছিল করার ২০০৮ সালে, তখন নাকি সারা শহরের মানুষ পথে নেমে এসেছিল, কন্ট্রোল করা মুশকিল হয়ে গিয়েছিল। তারপর থেকে সরকার আর মিছিলের অনুমতি দেয়না।

কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ চায় আজাদী। সেটা রাজা হরি সিং এর আমল থেকেই চাইছিল। এখনকার লিবারাল আর কনসারভেটিভ মানসিকতার ভারতীয় জনগণ কি চায় সে বিতর্কে নাই বা গেলাম। কাশ্মীর তো কাশ্মীরীদের তারা কি চায় সেটাই মূল বিষয়।

আরও পড়ুন: কাশ্মীরি জনগণ বনাম ভারত রাষ্ট্র

ছবি তুলেছেন ফাতিমা জাহান। অনুমতি নিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে।

আজকে নাকি রেশন দিচ্ছে। আঙ্কেলের ছোট ছেলে জুনেয়েদ সদরে গিয়ে খবর এনেছে যে আগামীকাল থেকে রেশন দেয়া শুরু হবে। এখন রেশনে শুধু চাল দেয়। আগে আটা, চিনিও দিত।

আমি খাবারের সময় বাদ দিয়ে বাকি সময় হাউসবোটের বারান্দায় বসে থাকি। লেক থেকে জীবনযাত্রা স্বাভাবিক বলেই মনে হয়। যে যার কাজ করতে নৌকা বেয়ে যাওয়া আসা করছে। কারফিউ এর সময় এখানকার নারীদের করার কিছুই থাকেনা। এবার তো ইন্টারনেটও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। টেলিভিশন দেখা ছাড়া মনোরঞ্জনের কোন মাধ্যম এখন নেই।

বিকালে আমি বের হলাম, আঙ্কেল জুনেয়েদকে আমার সাথে পাঠিয়ে দিল। তীরে নেমে হাঁটলাম শহর অবধি। বোলভার্ড রোড মানে ডাল লেক ঘেসা রাস্তাটায় শুধু অল্প কয়েকজন আর্মি দেখলাম। এরপর প্রতি ১০ মিটার পর পর একজন সেনা সদস্য দাঁড়িয়ে আছে। প্রায় সব সরকারী অফিসের সামনে কাঁটাতারের বেড়া দেয়া। আজ দেখি পথে বেশ কিছু গাড়ি, মোটর বাইক চলছে। বোলভার্ড রোডে স্থানীয় মানুষজন এসেছে ঘুরেফিরে বেড়াতে। সাধারণত বিকেলে শ্রীনগর শহর উপচে পড়ে এখানে। এখন দোকানপাট সব বন্ধ, অল্প মানুষজনের আনাগোনা।

পাবলিক ট্রান্সপোর্ট সব বন্ধ। শুধু জম্মু যাবার জন্য বাস স্ট্যান্ডে কয়েকটা শেয়ার ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে রয়েছে। এখন জম্মু বাদে অন্য সব রুটের রাস্তা বন্ধ।

দোকানপাট বন্ধ। ছবি তুলেছেন ফাতিমা জাহান। অনুমতি নিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে।

রাস্তাঘাটে ছবি তোলা নিষেধ, সেনা সদস্যদের তো একেবারেই না। শুধু অল্প কয়েকজন সাংবাদিক ছবি তোলার অনুমতি পেয়েছেন। আমি একজন ভ্রামণিক। কারফিউ চলাকালীন সময়ে ভ্রমণ করতে এসেছি শুনলে সাথে সাথে পাঠিয়ে দেবে বা উগ্রবাদী সন্দেহে গ্রেফতার করবে। গ্রেফতারের পর সাধারণত সে মানুষের আর কোন খবর পাওয়া যায়না।

অনেকটা সময় বাইরে থেকে ফের নৌকা চেপে হাউসবোটে ফিরলাম। ফেরার পর হউসেন আঙ্কেল জানালেন ডাউনটাউনে নাকি টিয়ারগ্যাস ছেড়েছে। আওয়াজ শোনা গেছে।

মাগরেবের নামাজের পর মসজিদে মসজিদে সমানে দরুদ পড়া শুরু হয়েছে। দোয়া পড়া ছাড়া আর কিছু করারও নেই। ভালো বা মন্দ যে কোন শব্দ মসজিদ থেকে বের হলে মসজিদে উপস্থিত সবাইকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। আর মসজিদের ভেতর কি হচ্ছে তা জানার জন্যও সেনাবাহিনীর গুপ্তচর আছে।

সব বড় মসজিদ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে কারফিউ ঘোষণা দেবার সাথে সাথে।

সম্পাদকের টীকা: ভারত সরকারের ভাষ্যমতে কাশ্মীরের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক আছে। তবে সম্প্রতি বেশ কিছু অঞ্চলে পুনরায় কারফিউ ও নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে।

Exit mobile version