মাতৃভাষায় বই পড়ার আনন্দ উপহার দিতে ম্রো ভাষায় প্রথম গল্পের বই প্রকাশ

নিজেদের ভাষায় লেখা প্রথম গল্পের বই হাতে ম্রো নৃগোষ্ঠীর মানুষেরা। ছবি অনুমতি নিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে।

মায়ের ভাষার চেয়ে মধুর আর কিছুই হয় না! আর তাই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষ্যে বাংলাদেশের ক্ষুদ্র আদিবাসী জনগোষ্ঠী ম্রো-দের মায়ের ভাষায় বই পড়ার আনন্দ উপহার দিলো বিদ্যানন্দ নামের একটি প্রকাশনী।

বাংলাদেশে ম্রো জনগোষ্ঠীর অবস্থান। ছবি উইকিপিডিয়া থেকে ক্রিয়েটিভ কমন্স লাইসেন্সের আওতায় প্রকাশিত।

ম্রো জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবন জেলায় বসবাস করেন। ১৯৯১ সালে আদমশুমারি অনুযায়ী তাদের সংখ্যা ২২ হাজার ১৭৮ জন। তাদের ভাষা তিব্বতি-বর্মি ভাষা পরিবারের কুকি-চিন গোত্রভুক্ত।

ম্রো আদিবাসীদের জনজীবনে প্রচলিত বিশ্বাস, রূপক, রীতিনীতি এইসব নিয়েই লেখা হয়েছে গল্পের বই ‘ম্রো রূপকথা'। দুই ভাষাভাষীর জনগোষ্ঠী যাতে একই বই পড়তে পারে, সেজন্য এই গল্পের বইটি একই সাথে বাংলা ভাষা ও ম্রো ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে। বইটি লিখেছেন ইয়াংঙান ম্রো। এটিই ম্রো-দের নিজস্ব বর্ণমালায় প্রকাশিত প্রথম কোনো গল্পের বই। ম্রো ভাষায় এর আগেও বই প্রকাশিত হয়েছে। তবে সেগুলো প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণির বাচ্চাদের বই। বইটি ইতোমধ্যে ম্রো-দের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছে।

পৃথিবীর সকল ভাষা সংরক্ষণ করা জরুরি, সেদিকে ইঙ্গিত করে নিয়াজ মোর্শেদ লিখেছেন:

ম্রো ভাষায় প্রথম ছাপানো বই !!! এটাই হচ্ছে আমাদের একুশে ফেব্রুয়ারির উদযাপন।

যে দেশের মানুষ মাতৃভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে, সে দেশের কিছু মানুষ মাতৃভাষা হারাচ্ছে যুগে যুগে। এগুলো সংরক্ষণের কোন কার্যকর পদক্ষেপ চোখে পড়ে না।

বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন-এর একজন স্বেচ্ছাসেবী ম্রো নৃগোষ্ঠীর মানুষের হাতে বই তুলে দিচ্ছেন। ছবি অনুমতি নিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে।

বাংলাদেশের সমাজের অনগ্রসর শ্রেণি বিশেষ করে চরম দরিদ্র, গৃহহীন ও অনাথ শিশুদেরকে শিক্ষা, পুষ্টি ও আশ্রয় দিয়ে তাদেরকে জাতির সম্পদে পরিণত করতে কাজ করছে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান। এর আটটি শাখা চালান ৪০ জনের একটি কর্মীবাহিনী এবং অগুনতি স্বেচ্ছাসেবক। তাদেরই সহযোগী প্রতিষ্ঠান বিদ্যানন্দ প্রকাশনী। ম্রো ভাষায় বই প্রকাশের কারণ প্রসঙ্গে ফেইসবুক মেসেঞ্জারে আলাপচারিতায় প্রতিষ্ঠানটির পক্ষে কিশোর কুমার দাস গ্লোবাল ভয়েসসকে বলেন:

আমাদের একাধিক আদিবাসী এতিমখানায় কয়েকশ’ শিশু থাকে। তাঁদের মাতৃভাষায় বই উপহার দিতেই কাজটি করা। আর কাজটি করতে গিয়ে প্রথম সমস্যা ছিল ম্রো ভাষায় লেখক খুঁজে বের করা। এজন্য আমরা ফেইসবুকে বিজ্ঞাপন দিই।পরে আমাদের এক স্বেচ্ছাসেবকের মাধ্যমে এই লেখককে খুঁজে পাই। আর একটা সমস্যার ছিল ফন্ট।এসব ফন্টে কাজ হয় নি কোনদিন বাংলাবাজারে(বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বই প্রকাশনী কেন্দ্র)।আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষায় বই পড়ার আনন্দ উপহার দেয়ার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ছিল বলেই আমরা কাজটি করতে পেরেছি।

আগামী বছর আমরা আরো কয়েকটি ভাষায় বই প্রকাশ করার পরিকল্পনা করছি। এছাড়া আমরা আদিবাসী শিশুদের জন্য ভিডিও টিউটোরিয়াল তৈরির কাজ শুরু করেছি। সেটাও মাঝপথে থেমে গেছে স্বেচ্ছাসেবকের অভাবে।

বাংলাদেশের ভাষা চিত্র। ছবি উইকিপিডিয়ার সৌজন্যে প্রাপ্ত। সিসি বাই ৩.০

বাংলাদেশ মূলত বাংলা ভাষাভাষীদের দেশ। এখানে ৯৮ শতাংশ মানুষই বাংলায় কথা বলেন। বাংলা ছাড়াও ৩৯টি ভাষা প্রচলিত রয়েছে। তবে এর মধ্যে বেশ কয়েকটি ভাষা প্রায় হারিয়ে যাওয়ার পথে। আদিবাসী গবেষক সালেক খোকন এক লেখায় কুড়ুখ ও নাগরি ভাষা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন। তাছাড়া কোচ ও রাজবংশীদের ভাষা বিলুপ্তি দ্বারপ্রান্তে বলে উল্লেখ করেছেন।

পাহাড়ি এলাকার অনেক ভাষা সংরক্ষণে মূল সমস্যা হচ্ছে যে এগুলো কথ্য ভাষা – লেখার সময় এরা বাংলা বর্ণেই লিখে। তবে বেশ কিছু নবীন আদিবাসী যুবারা আধুনিক ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে তাদের নিজস্ব ভাষা ও ফন্টকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।

২০১৪ সাল থেকে ৫টি আদিবাসী ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা দেবার একটি সরকারী উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। তবে অনেকের মতে এটা এখনো ভালুভাবে শুরু হতে পারেনি।

ভাষা সংরক্ষণে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট নামে একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশে বিদ্যমান সবক’টি মাতৃভাষাকে টিকিয়ে রাখতে কাজ করছে। সরকারের এইসব উদ্যোগ এবং বিদ্যানন্দের মত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ভাষায় বই প্রকাশ আশা যোগায় যে ভবিষ্যতে এইসব সংখ্যালঘু ভাষাগুলো বেঁচে থাকবে।

Exit mobile version