গত সপ্তাহে ইরানের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভকারীদের ব্যাপক বিক্ষোভ স্বত্ত্বেও কর্তৃপক্ষ টেলিগ্রাম এবং ইন্সটাগ্রামের মতো প্ল্যাটফর্মে যোগাযোগ এবং তথ্য-উপাত্ত ভাগাভাগি শক্ত হাতে দমনের উদ্দেশ্যে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
২ জানুয়ারি তারিখে ইরানের ইন্টারনেট বিনিময় বিন্দুতে কর্মরত একটি সূত্র ইরানের মানবাধিকার কেন্দ্রকে বলেছে যে সরকার তাদেরকে আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট এ প্রবেশাধিকার ব্যাহত করার নির্দেশ দিয়েছে। এর মানে হল নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে ইরানে আন্তর্জাতিক তথ্যে প্রবেশ করা যাবে না।
পূর্বাঞ্চলীয় শহর মাশহাদে বেকারত্ব, ক্রমবর্ধমান খাদ্যের মূল্য, এবং সংস্কারবাদী ও রক্ষণশীল উভয় সরকারী নেতাদের ভুলের অভিযোগ নিয়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়লে ২৮ ডিসেম্বর থেকে এধরনের বিধিনিষেধের এই বৃদ্ধি ঘটেছে। ২৯ ডিসেম্বরের মধ্যে ছোট ছোট এবং প্রধান প্রধান শহরগুলিতেও বিক্ষোভগুলি ছড়িয়ে পড়ে।
৩১ ডিসেম্বর তারিখে ইরানের ইসলামী প্রজাতন্ত্রের সম্প্রচার পরিষেবা ঘোষণা করেছে যে “নাগরিকদের শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার জন্যে” কর্তৃপক্ষ “সাময়িকভাবে” টেলিগ্রাম এবং ইনস্টাগ্রাম স্থগিত করেছে। এটি ইরানে ২০০৯ সালের সবুজ আন্দোলনের বিক্ষোভ পরবর্তী বড় বড় প্ল্যাটফর্ম ফেসবুক এবং টুইটার অবরোধের পরের গুরুতর একটি পদক্ষেপ।
মোবাইল বার্তা আদান-প্রদানের অ্যাপটি দেশের ব্যবহারকারীদের মধ্যে সর্বব্যাপী হওয়ার কারণে টেলিগ্রামের অবরোধ বিশেষ গুরুতর পরিণতি ডেকে এনেছে। অনলাইনে থাকা সাড়ে চার কোটি ইরানীর মধ্যে চার কোটিই পরিবার ও বন্ধুদের সাথে যুক্ত থাকা থেকে শুরু করে সংবাদ পড়া ও ভাগাভাগি করা, বিক্ষোভসহ পাবলিক ইভেন্টগুলির বিষয়ে হালনাগাদ থাকা পর্যন্ত সবকিছুর জন্যেই টেলিগ্রাম ব্যবহার করে থাকে। এধরনের সেন্সরশিপের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। কয়েকটি শহরে বিক্ষোভ সহিংস হওয়ার কারণে রাষ্ট্রীয় প্রচার মাধ্যম সংঘর্ষে ২১ জন নিহতের খবর জানিয়েছে। জনসাধারণের নিরাপত্তা বজায় রাখার জন্যে মুক্ত যোগাযোগের চ্যানেলগুলি ক্রমশঃ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
তাদের ওয়েবসাইটগুলির উপর আপাত বিধিবিষেধের কারণে ডিজিটাল সেন্সরশিপ এড়িয়ে যাওয়ার সরঞ্জামগুলোও ব্যর্থ হচ্ছে। ডিজিটাল ওশানের মতো ইন্টারনেট অবকাঠামো সংস্থার দেয়া লণ্ঠন–এর মতো সেন্সরশিপ এড়িয়ে যাওয়ার সরঞ্জাম গুলিও বিঘ্নতার শিকার হচ্ছে।
এই নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ইরানীরা ইন্টারনেট ব্যবহার করে এখনো তাদের অভিজ্ঞতা রিপোর্ট এবং নথিভুক্ত করছে। বন্দর আব্বাসের একটি ভিডিওতে বিক্ষোভকারীরা ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আলি খামেনির ছবিযুক্ত একটি বিলবোর্ডে আগুন দিচ্ছে। গ্লোবাল ভয়েসেসের লেখক ও অভিবাসন আইনজীবী হামিদ ইয়াজদান পানাহ একে “ডিমের মূল্য বা রাজনৈতিক সংস্কারের আকাঙ্ক্ষা অতিক্রম করা ক্ষোভ ও অবাধ্যতা” বলে অভিহিত করেছেন।
৩০ ডিসেম্বর তারিখে কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজতন্ত্রে কর্তৃপক্ষ পরের দিন একাধিক শহরে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভের প্রাক্কালে টেলিযোগাযোগ প্রদানকারীদের ক্ষুদেবার্তা এবং ইন্টারনেটে প্রবেশাধিকার অবরোধের নির্দেশ দিয়েছিল। মূলতঃ গির্জার দলগুলির মধ্যে সংগঠিত এসব বিক্ষোভকারীরা দাবি করছিল কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট জোসেফ কাবিলা যেন রাষ্ট্রপতি পদে তার সাংবিধানিক মেয়াদ পরিবর্তনের প্রচেষ্টা থেকে বিরত থাকেন।
ভারতবর্ষের বিশালাকার জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবস্থা আধার-এ সংরক্ষিত ব্যক্তিগত তথ্য নিরাপত্তা তদন্তের প্রচেষ্টাকালে দি ট্রিবিউন অব ইন্ডিয়ার সাংবাদিকরা শুধু হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে প্রচারিত একটি বিজ্ঞাপনে সাড়া দিয়ে এর বেনামী পোস্টদাতাকে ৫০০ রুপী (প্রায় ৬৫৪ বাংলাদেশী টাকা) দিয়ে পরিশোধ করার মাধ্যমে “ভারতবর্ষে এপর্যন্ত তৈরি শতকোটির বেশি আধার নম্বরের যেকোন তথ্যে অবাধ প্রবেশাধিকার লাভ করতে সক্ষম হয়েছে”। ভারতের ইউনিক আইডেন্টিফিকেশন কর্তৃপক্ষ (ইউআইডিএআই) বলছে যে ট্রিবিউন গল্পটি “ভুলভাবে প্রতিবেদন করেছে”। এখানে ট্রিবিউনের প্রতিক্রিয়াটি পড়ুন।
পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা ইন্টারনেটে ব্লাসফেমি (ধর্মদ্রোহী) এবং অশ্লীলতার অভিব্যক্তি মোকাবেলার বিষয় সম্প্রসারণ করে দেশটির ২০১৬ সালের ইলেক্ট্রনিক অপরাধ আইনের সংশোধনী অনুমোদন করেছে। আইনটি অনুসারে এসব এখন ফৌজদারি অপরাধ হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করা হবে এবং এটি সামাজিক গণমাধ্যমে কারো পোস্ট করা বিষয়বস্তুকে ধর্মদ্রোহী ব্যাখ্যা করার সম্ভাবনা থাকলে তা ঐ ব্যক্তির বিরুদ্ধে ফৌজদারী অভিযোগ দায়েরের পথ তৈরি করতে পারে।
২০১৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর তারিখে লিপজিগের কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক আদালত জার্মানির বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা বুন্দেস নাখ্রিস্টেন দিয়েনস্ত (বিএনডি)-এর বিপক্ষে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স-এর দাখিল করা একটি অভিযোগের পক্ষে রায় দিয়েছে। সিদ্ধান্তটিতে বলা হয়েছে যে বিএনডি গোয়েন্দা বিশ্লেষণের উদ্দেশ্যে মেটাডাটা যেমনঃ আন্তর্জাতিক কলগুলির ফোন নম্বর এবং কলের সময় ও তারিখ সংরক্ষণ করতে পারবে না। এতে প্রতিদিন গড়ে ২২০ কোটি মেটাডাটা সংগ্রহকারী বিএনডি’র উপর একটি বড় প্রভাব পড়বে। ২০১৫ সালে সাইট (সময়) অনলাইন–এ উন্মোচিত নথির একটি ধারাবাহিককে ধন্যবাদ।
ফেসবুকের ৯০০ ব্যবহারকারীর ঘৃণাত্মক বক্তব্যের পর্যালোচনা করার পর অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার সংস্থা প্রোপাব্লিকা জানিয়েছে যে ব্যবহারকারীদের অভিযোগের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ফেসবুকের প্রায় দুই ডজন ঘৃণাত্মক পোস্ট অপসারণ করা হয়নি। প্রোপাব্লিকা আরও জানিয়েছে যে সারা বিশ্বের আনুমানিক ২২০ কোটি সক্রিয় ব্যবহারকারীর ঘৃণাত্মক বক্তব্য পর্যালোচনা করার জন্যে ফেসবুক মোটামুটি ৭,৫০০ জন লোক নিয়োগ করেছে। প্রতিবেদনটিতে ব্যাখ্যা করা হয়েছে:
২২টি ক্ষেত্রে ফেসবুক বলেছে তার পর্যালোচকরা ভুল করেছে। ১৯টিতে রায়ের পক্ষাবলম্বন করা হয়েছে। ছয়টি ক্ষেত্রে ফেসবুক বলেছে যে বিষয়বস্তুটি তার নিয়ম লঙ্ঘন করলেও ব্যবহারকারীরা এটিকে সঠিকভাবে চিহ্নিত না করায় অথবা লেখক সেটা মুছে ফেলায় তার পর্যালোচকরা এটিকে আসলে কোনভাবে বিচার করেনি। অন্য দুটি ক্ষেত্রে এটি বলেছে যে এতে উত্তর দেওয়ার জন্যে যথেষ্ট তথ্য ছিল না।
২০১৮ সালের শুরুতে নেটজডিজি নামে পরিচিত জার্মানির বিতর্কিত ঘৃণাত্মক বক্তব্য আইন নেটজুয়ের্ক-দুর্জেটজুংস-গেজেটজ (নেটওয়ার্ক প্রয়োগ আইন)-এর পরিপূর্ণ কার্যকারিতা আরম্ভ হয়েছে। আইনটি অনুসারে সামাজিক গণমাধ্যম কোম্পানীগুলিকে ঘৃণাত্মক বক্তব্য এবং তথাকথিত “নকল সংবাদ”সহ অবৈধ বিষয়বস্তু সরিয়ে নেওয়ার সরকারি অনুরোধ প্রাপ্তির ২৪ ঘন্টার মধ্যে অবশ্যই সাড়া দিতে হবে। আরো দ্ব্যর্থবোধক বিষয়বস্তু অপসারণ বিবেচনা করার জন্যে কোম্পানিগুলো সাত দিন পর্যন্ত সময় পাবে। ফেসবুক, টুইটার এবং গুগল/ইউটিউব হবে আইনটি প্রয়োগের প্রাথমিক ক্ষেত্র।
নতুন দণ্ড বা সংজ্ঞা তৈরি যেন না হয় সেজন্যে জার্মানির দণ্ডবিধি ইতোমধ্যে ঘৃণাত্মক বক্তব্যকে সংজ্ঞায়িত করেছে। পরিবর্তে, এটি কোম্পানিগুলিকে ঘৃণাত্মক বক্তব্য শৃঙ্খলায় আনতে জোর অথবা অকল্পনীয় জরিমানা করছে। বৈশ্বিক স্তরে এই আইনটি অভূতপূর্ব এবং বিশ্বব্যাপী পরিবর্তনশীল তরঙ্গ সৃষ্টি করতে পারে।
মাহসা আলিমার্দানি, এলেরি রবার্টস বিডল, নেভিন থম্পসন, মোহামেদ এলগোহারি, জেমস লসি, বিশাল মানভে, জর্জিয়া পপলেওয়েল, তালাল রাজা, জ্যুক ক্যারোলিনা রুমুয়াত এবং সারাহ মায়ার্স ওয়েস্ট এই প্রতিবেদনে অবদান রেখেছেন।