মালয়েশীয় একটিভিস্ট আইরিন ফার্নান্দেজ-এর প্রতি শ্রদ্ধা

বিশ্ব মানবাধিকার সম্প্রদায় মালয়েশিয়ার প্রবাদ প্রতীম একটিভিস্ট আইরিন ফার্নান্দেজ-এর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করছে। হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে আইরিন ৩১ মার্চ ২০১৪ তারিখে মৃত্যুবরণ করেন।

আইরিন ছিলেন তেনাগানিতা নামক প্রতিষ্ঠানের একজন প্রতিষ্ঠাতা, যেটি অভিবাসী এবং উদ্বাস্তুদের নিরাপত্তায় সোচ্চার। তিনি ছিলেন একজন অভিজ্ঞ একটিভিস্ট, যে নিয়মিত এবং সাহসিকতার সাথে নারী, শ্রমিক এবং সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দাবীর বিষয়ে সোচ্চার ছিলেন। তিনি ২০০৫ সালে নোবেল সমমানের এক পুরস্কার লাইভলিহুড অর্জন করেন।

১৯৯৬ সালে আইরিনকে গ্রেফতার করা হয় এবং আটক কেন্দ্রে অভিবাসীদের উপর নির্যাতনের বিষয় উন্মোচিত করার ঘটনার সাথে তার যুক্ত থাকার কারণে তার বিরুদ্ধে “অশুভ উদ্দেশ্যে মিথ্যা সংবাদ প্রকাশ করার” অভিযোগ আনা হয়। তার বিরুদ্ধে ১৩ বছর ধরে মামলা চলেছিল যা মালয়েশিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে চলা মামলা।

দি অলইরান মানবাধিকার দল আইরিনের সাহসিকতাকে চিহ্নিত করেছে, যার সাথে সরকার অসৎ আচরণ করেছিল:

মানবাধিকার–এর ভিত্তি, তার এক একনিষ্ঠ যোদ্ধাকে হারাল যে সাহসিকতার সাথে ন্যায় প্রতিষ্ঠার এবং দুর্ভাগা অভিবাসী শ্রমিকদের সঠিক ব্যবহারের জন্য উঠে দাঁড়িয়েছেন, যারা প্রায়শ অসৎ নিয়োগ কর্তা এবং প্রতিষ্ঠানের দ্বারা শোষিত এবং বাজে আচরণের শিকার হত।

যারা নির্যাতিত, তাদের কল্যাণের জন্য আইরিন নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন এবং এই বিষয়ে তিনি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন। আর তিনি সকল ক্ষেত্রে সকল প্রকার মানবাধিকারে প্রবক্তা ছিলেন, যিনি এমন এক সরকারের বাজে আচরণের শিকার হয়েছিলেন, যে সরকার ন্যায়বিচারের দাবী জানানোর ক্ষেত্রে, যারা তা দাবী করে, তাদের কোন ধরনের বিরুদ্ধতা সহ্য করে না।

স্টিভ ওহ, আইরিনকে মালয়েশিয়ায় দুর্ব্যবহারের শিকার অভিবাসীদের জোয়ান অফ আর্ক হিসেবে অভিহিত করেছে:

রাজনৈতিক স্বৈরশাসকেরা মালয়েশিয়ার বাজে আচরণের শিকার অভিবাসী এবং নিপীড়নের শিকার উদ্বাস্তুদের “জোয়ান অফ আর্ক”-এর জীবন অনৈতিকভাবে কঠিন করে তুলেছিল, যে ছিল সাহসী, অদম্য, এবং বিনয়ী।

আইরিন সম্বন্ধে এই কথাটি না বলা অন্যায় হবে যে, এমন এক বিরূপ পরিবেশ, যেখানে কর্তৃপক্ষ ঘটনাবলী যাচাই করে দেখতে অনিচ্ছুক এবং তাদের দুষ্কর্মের জন্য মানবাধিকার কর্মীদের দায়বদ্ধ করে। তিনি অবর্ণনীয় কষ্টের সময় পার হয়ে এসেছেন, যে যন্ত্রণা তিনি ভোগ করেন বাড়াবাড়ি করা এক কর্তৃপক্ষের হাতে, যাদের হাতে তিনি হয়রানির শিকার হয়েছিলেন।

যেমনটা আমি লিখেছি, আমি এই অসাধারণ রমণীর মানসিক শক্তির বিষয়টি স্মরণ করতে পারি, তারা একটা সন্ত নারীকে যন্ত্রণা প্রদান করেছে। আইরিনের এই যন্ত্রণা লাভ, তার ব্যক্তিগত কাজের কারণে নয়,বরঞ্চ অসহায়দের প্রচণ্ড দুর্দশায় তাদের সাহায্য করার জন্য।

বিরোধী দলীয় নেতা আনোয়ার ইব্রাহিমও তার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছেন:

…দুর্বল, দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মাঝে তিনি ছিলেন শিরোপাধারী এবং কর্তৃপক্ষের দুর্ব্যবহারের ও ক্রমাগত হয়রানির মাঝেও আইরিন ছিল এক সত্যিকারের লড়াকু যোদ্ধা।

কেবল তাই নয়, তার মৃত্যু আমার জন্য এক ব্যক্তিগত বেদনাদায়ক ক্ষতি কারণ আমাদের মালয়েশিয়ান ইয়ুথ কাউন্সিলের দিন থেকে তিনি ছিলেন আমাদের পরিবারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও আমার সহকর্মী।।

কালাং-এর সংসদ সদস্য চার্লস সান্তিয়াগো আইরিনের কাজ থেকে প্রাপ্ত চেতনার সারাংশ করেছেন:

তিনি যে নির্যাতন এবং হয়রানির মুখোমুখি হয়েছেন তার কোনটাই তার লড়াইয়ের চেতনাকে বাঁধাগ্রস্থ করতে পারেনি। ঘটনা হচ্ছে তিনি এক যুদ্ধ চালিয়ে গেছে যা তরুণ প্রজন্মকে সত্যিকারের অনুপ্রাণিত করছে। মানবাধিকার এবং ন্যায়বিচারের প্রতি তার প্রতিশ্রুতি প্রবাদ প্রতীম।

আমাদের সকলের লক্ষ্য পৃথিবীতে আমাদের শেষ যাত্রার আগে সেখানে চিহ্ন রেখে যাওয়া। আইরিন আমাদের জন্য উত্তরাধিকার সুত্রে এক চেতনা রেখে গেছে, যা কেবল শোষিত এবং বঞ্চিতদের অধিকারের জন্য লড়াই করার ক্ষেত্রে নয় একই সাথে তা ক্রমাগত কঠিন পরিস্থিতি মুখোমুখি হবার সাহস যোগাতে উৎসাহ দেয় এবং তারা যে বিশ্বাস করে সে বিষয়ে লড়াই করতে সবাইকে একত্রিত হতে সাহায্য করে।

আইরিন ছিলেন এশিয়ার বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার বন্ধু এবং অংশীদার। যাদের মধ্যে একটি হচ্ছে ফিলিপাইন ভিত্তিক সেন্টার ফর ওমেন্স রিসোর্স:

সেন্টার ফর ওমেন্স রিসোর্স এমন একদল কর্মীর প্রতিষ্ঠান, যারা আইরিন ফার্নান্দেজের মৃত্যুতে গভীরভাবে শোকাহত। আমরা এক অসাধারণ নারীর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদান করছি যিনি আমাদের এই সংগ্রামে দারুণ ভাবে সমর্থন যুগিয়ে গেছেন এবং তার প্রবক্তা হয়ে ছিলেন। তিনি ছিলেন এক বিশ্ব নাগরিক, সীমান্তহীন এক একটিভিস্ট, সত্যিকারের একজন আন্তর্জাতিক নাগরিক ।

ফেসবুকে ভিক্টর শাং খাম বিল আইরিনকে স্মরণ করছে যে কিনা মালয়েশিয়ার চিন জনগোষ্ঠীর জন্য লড়াই করেছে:

আমি কেবল এই কথা বলতে পারি, মৃত্যু জীবনের ইতি ঘটায়, সম্পর্কের নয়, মানবাধিকার রক্ষায় অসাধারণ একজন হিসেবে কেবল আইরিন ফার্নান্দেজ মালয়েশিয়ার এক ইতিহাস বই নয়, একই সাথে তিনি চিন জনগোষ্ঠীর হৃদয়ও চিরতরে বাস করবেন। বিদায় আমার বন্ধু, আপনার প্রতি আমার শেষ বাক্য “ আপনার কোনদিন মৃত্যু হবে না, কারণ এক সাহসী নারীর জীবন্ত প্রতীক”।

এশিয়ান পেজেন্ট কোয়ালিশন আইরিনকে কৃষি সংস্কারের এক প্রবক্তা হিসেবে উল্লেখ করেছে:

আইরিনের এই অকস্মাৎ মৃত্যু আমাদের জন্য এক আঘাত, আর এই মৃত্যুতে আমরা খুবই বেদনার্ত। তবে আমাদের প্রিয় আইরিন সব সময় আমাদের অনুপ্রাণিত করবে। আমরা নাগরিকদের অনুরোধ জানাই যারা তার নিষ্ঠাপূর্ণ কাজের দ্বারা আইরিনের মাধ্যমে অনুপ্রাণিত হয়েছে, তারা যেন তাদের কাজের মাধ্যমে সহানুভূতি প্রকাশ করে, বিশেষ করে সেই সব কাজের দ্বারা, যার মাধ্যমে নিপীড়িত মানুষদের সেবা করা যায়। আমরা তার কাজ চালিয়ে যাব। আমরা সত্যিকারের কৃষি সংস্কার এবং খাদ্য স্বনির্ভরতার জন্য আমাদের সংগ্রাম চালিয়ে যাব

কয়েক বছর আগে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আইরিনকে বিশ্বের অন্যতম এক নেতৃস্থানীয় একটিভিস্ট হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেছে যে আধুনিক দাসত্ব নির্মূলে কঠোর এক সংগ্রাম চালিয়ে গেছে। রাষ্ট্রদূত জোসেফ ইয়া ইয়ুন পৃথিবী থেকে আইরিনের বিদায় নেওয়ার শোক প্রকাশ করেছে। :

দীর্ঘ সময় ধরে দরিদ্র এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য তার দীর্ঘ সময় ধরে করা লড়াই-এর কারণে তিনি মালয়েশিয়া এবং সারা বিশ্বের মানুষের কাছে আইরিন অসাধারণ এক শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি ছিলেন। কয়েক বছর আগে, যুক্তরাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আধুনিক দাসত্ব মোচনে অবদান রাখার জন্য বিশ্বের সেরা দশ একটিভিস্টের একজন হিসেবে আইরিনকে স্বীকৃতি প্রদান করেছে। এই সম্মান জানানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সরকার আইরিনের চেয়ে আর উপযুক্ত কাউকে পায়নি। তার নিষ্ঠা এবং মালয়েশিয়ায় মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা তুলে ধরার নিরলস প্রচেষ্টার কারণে আমরা সকলে মুগ্ধ। নিঃসন্দেহে আমরা আইরিনের আগ্রহ, একাগ্রতা, এবং সর্বোপরি তার বন্ধুত্বের অভাব অনুভব করতে থাকব।

Exit mobile version