ভারত: মাওবাদী হুমকিকে সামলানো

ছত্তিশগড়ে একটি আদিবাসী গ্রাম। ছবি ফ্লিকার ব্যবহারকারী পিক্সেল মান্কির সৌজন্যে। ক্রিয়েটিভ কমন্স লাইসেন্স বাই-এনসি-এনএ।

ছত্তিশগড়ে একটি আদিবাসী গ্রাম। ছবি ফ্লিকার ব্যবহারকারী পিক্সেল মান্কির সৌজন্যে। ক্রিয়েটিভ কমন্স লাইসেন্স বাই-এনসি-এনএ।

লাগাতার মাওবাদী হামলা ভারতের জন্য সব থেকে বড় নিরাপত্তা হুমকিতে পরিণত হয়েছে বিশেষ করে মাওবাদী বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর উপরে আর একটি মারাত্মক হামলা করার পরে। রিপোর্ট অনুসারে ২৯ শে জুন ২০১০ তারিখে কেন্দ্রীয় রিজার্ভ পুলিশ বাহিনীর (সিআরপিএফ) ২৬ জন সদস্য ছত্তিশগড়ের নারায়ণপূর জেলায় মাওবাদীদের গুপ্ত হামলায় নিহত হয়েছে। মাত্র গত এপ্রিলে ৭৬ জন হালকা অস্ত্রধারী সিআরপিএফ সদস্যকে মাওবাদীরা হত্যা করেছিল। নেট নাগরিকরা মাওবাদী কর্তৃক হত্যার ব্যাপারে তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন আর এই ভীতি থেকে বাঁচার উপায় আলোচনা করেছেন।

মাওদের সমস্যার দীর্ঘ ইতিহাস আছে এবং এর ব্যাখ্যাতে অনেক তত্ত আছে। কেউ কেউ যেমন রওনাক প্রধান মনে করেন যে এটা একটা স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিক, আবার অনেকে মনে করে যে এটা শ্রেনী সংগ্রামের একটা ধরন।

দ্যা ভিউজপেপার এর আজু বাসিল জেমস এই বিচ্ছিন্নতাবাদী মাও হামলার বাড়ার পিছনের কারন আলোচনা করেছেন:

অনেক বিষেশজ্ঞরা দাবী করেন যে মূল সমস্যা হল সনাতন দারিদ্র্য আর চাকুরীহীনতার সমস্যা। মাওবাদীরা ছত্তিশগর, ঝাড়খন্ড আর উড়িষ্যার জঙ্গলে মূলত বেশী থাকে, যেসব এলাকাকে মূলত ‘লাল করিডোর’ বলা হয়। এই সকল এলাকায় মূলত আদিবাসী লোক বাস করে। যখন ভারত উচ্চ মাত্রার সমৃদ্ধির চিত্র দেখাচ্ছে আর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উপরের দিকে উঠছে, এই সকল লোক বড় শহরের কোন অর্থনৈতিক সুবিধার মুখ দেখেনি। এখনো সরকারী লোকেরা তাদের দাবিয়ে রাখে আর রাজনীতিবিদরা শোষণ করে। কোন কিছু হলে তারা কেবল মুক্ত অর্থনীতির খারাপ চেহারাই দেখেছে- ব্যক্তিমালিকানাধীন কোম্পানি ভূমি দখল করছে, প্রাকৃতিক সম্পদের খারাপ ব্যবহার আর সরকার থেকে আরো অবহেলা পেয়েছে।

দ্যা এশিয়া ব্লগে প্রেরণা সুরি রিপোর্ট করেছেন যে মাওবাদী সন্ত্রাসের পিছনে অন্যতম একটা কারন হল অবহেলা:

তারা বলেন যে এইসব আক্রমণ অনেক বছরের অবহেলার ফল। যদিও ছত্তিশগর ভারতের অন্যতম ধনী রাজ্য, যেখানে অনেক বক্সাইট খনিজ আর লোহার খনি আছে, তবুও এই রাজ্যে অনেক বছর ধরে প্রায় কোন উন্নয়ন হয়নি।

ডিস্প্যাচেস এন্ড ফাইল নোটিংস ব্লগে রয়ডেন ডিসুজা মাওবাদীদের কৌশল বিশ্লেষণ করেছেন:

গত ৪০ বছরে মাওবাদীরা ২০০টির বেশী জেলাতে আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হয়েছে, তেল ছড়ান কৌশলের মাধ্যমে। তাদের কৌশল ছিল ছোট একটা এলাকার উপরে দখল করে পরে আশেপাশের এলাকায় নিয়ন্ত্রণ নেয়া যেমন পানির উপরে তেলের ফোটা ক্রমাগত ছড়িয়ে পড়ে।

ভারতীয় দার্শনিক বিশাল মঙ্গল বাদীর মতে মাওবাদীদের যুদ্ধ ভারতের অপরাধী পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে:

হিন্দু পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে মাওবাদীদের অভিযোগ সরল: আমাদের বেশ কিছু সংখ্যক খনির মালিক, ব্যবসায়ী, গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত রাজনীতিবিদ, গেজেটভুক্ত অফিসার (প্রশাসন আর পুলিশ), আর তাদের অ-‘পবিত্র’ ধর্মগুরুরা একসাথে হাত মিলিয়েছেন অপরাধীদের গডফাদার হওয়ার জন্য। তাদের ক্ষমতা শক্তিশালি করছে সরকারী মিলিশিয়া যাদেরকে ‘বিশেষ বাহিনী’ বলা হয় আর বেসরকারী মিলিশিয়া যেমন সেলভা জুদুম যারা বর্তমানের দু:খজনক সংঘর্ষের শুরু করেছে।

আর মাওবাদ কেন বিস্তার লাভ করছে? তাদের একটা শ্রেণী বিহীন শোষণমুক্ত সমাজের আশা গরিবদের প্রভূত সমবেদনা পায়। শান্তনু দত্ত বিশাল মঙ্গল বাদীর উদ্ধৃতি দিয়েছেন মাওবাদীদের জনপ্রিয়তা বুঝতে গিয়ে। মাওবাদীরা পছন্দ করে “ভূমিহীন, স্থানচ্যুত আর কোনায় পড়ে থাকা আদিবাসীদের সাথে নিজেদের এক কাতারে মেলাতে”। তাই দরিদ্র আর শোষিতের মধ্যে তাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়।

কলকাতা থেকে নীলকণ্ঠ চন্দ্র তার ব্লগ কুকুস কল এ লিখেছেন:

কলকাতায় বাস করে আমি আমার চারিদিকে যা দেখি, মনে হয় বাড়তে থাকা সংঘর্ষের ছায়ায় আমরা বাস করছি। এটি একটি গৃহযুদ্ধ যেখানে না পাওয়ার দল পাওয়ার দলের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। একবার এমন কিছু ফেটে পড়লে, তখন আমাদের লাগাতার রক্তক্ষয়ী এমন ঘটনা দেখতে হবে। এর মধ্যে থেকে ভালো কিছু বের হবে না, আর বহুমুখী গণতন্ত্র হিসাবে ভারতের ভবিষ্যৎ ভয়ঙ্কর বিপদের মধ্যে থাকবে। ভারতের মানুষের জীবন হবে ইরাক আর আফগানিস্তানের মানুষের মতো।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ভারতে প্রযোজনীয় যে পরিবর্তন দরকার, যা ভারতের স্বাধীনতার ৬৩ বছরে হয়নি, এমন পরিবর্তন কি হতে পারে, ধ্বংসকারী সংঘর্ষের আগে? সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থান সত্ত্বেও সকলের জন্য সমান সুযোগ থাকবে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, পানীয় জল, শৌচ নিষ্কাশন, যোগাযোগ ব্যবস্থার মতো জিনিষে।

আমি এটা দেখতে পাচ্ছি না, আসলে এর উল্টোটাই দেখছি। সরকার বা ব্যক্তিগত ব্যবসা সংস্থার এমন কোন পরিকল্পনা নেই। সুধী সমাজ দুর্বল আর ভঙ্গুর, আর ধর্ম ও গোত্রের ভিত্তিতে বিভক্ত।

ভারতীয় সরকার মাওবাদীদের শান্ত করার কৌশল খুঁজছে। সরকার মাওবাদীদের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক অবস্থান নিয়েছে পুলিশ আর বিশেষ বাহিনী ব্যবহার করে যার ফলে ক্ষুদ্রই সাফল্য পেয়েছে। কথা চলছে মাওবাদীদের এলাকায় সেনা মোতায়েনের। ব্ল্যাকবেরিতে পাঠানো বার্তা পড়তে বা স্কাইপে করা ফোনের বার্তা আড়ি পেতে শুনতে ভারতের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা ব্যর্থ হচ্ছে। এ কারনে এইসব সেবাকে নিষিদ্ধ করার চিন্তা অনেকটা মাথা কেটে মাথা ব্যাথা সারানোর মতো ব্যাপার মনে হচ্ছে।

মাই কান্ট্রি মাই ভিউজ ব্লগে নাভিন জেমস এর আলোচনা করেছেন কে এইসব অযাচিত হত্যার দায়িত্ব নেবে আর কিভাবে এটাকে থামান যায়:

এক রাত্রে নক্সাল আর মাওবাদীদের মূল উৎপাটন করা যাবে না। এটাকে অনেক চিন্তা করে আর দৃঢ় নীতির মাধ্যমে করতে হবে। এখন পর্যন্ত এটা নিয়ে কাজ করার জন্য কোন সরকার বড় ধরনের ইচ্ছা দেখায় নি আর এখন মনে হচ্ছে এটা দেশের সব থেকে বড় অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। শক্ত রাজনৈতিক ইচ্ছার অভাব শত শত নিরাপরাধ জওয়ানদের জীবন বিপদের মুখে ফেলছে। এই ধরনের আরও হত্যাকান্ডে আমরা এতো জওয়ান/সেনাকে হারাতে পারিনা। আমাদেরকে এটাও নিশ্চিত করতে হবে যে আদিবাসীদের ধোঁকা দেয়া যাতে বন্ধ হয় আর সেখানে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটে।

সরকার যথেষ্ট করছে না আর এর জন্য কাকে দোষ দেয়া যাবে? “আমরা জনগণরা’ এই দোষ নেবো। আমরা এই সরকারকে নির্বাচন করেছি কাজ করার জন্য আর তা যদি তারা না করে তাহলে এটা আমাদের দায়িত্ব তারা যাতে কাজ করে সেটা দেখা বা তাদের সরিয়ে দেয়া। মিডিয়া এই ক্ষেত্রে খুব বড় ভূমিকা পালন করতে পারে জনগণের কণ্ঠ হয়ে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত মিডিয়া চেষ্টা করে শুধু মূল সংবাদের পিছনে না গিয়ে অন্য কিছুর পিছু নিতে যা আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারে যা তাদের দিকে মানুষের দৃষ্টি ফিরবে আর দর্শকপ্রিয়তা সৃষ্টি করবে। মানুষ, মিডিয়া, বুদ্ধিজীবী, প্রশাসন আর দেশের বিশিষ্টজনেরা এক সাথে হাত মিলিয়ে সরকারকে কাজ করতে বাধ্য করানো উচিৎ। কোন দেশ পারে না তার নিবেদিত বাহিনীর এই পরিমাণ ক্ষতি সহ্য করতে।

উপরের মতো পদক্ষেপ না নেয়া হলে ভারতের উপরে আরও বিপদ ঘনিয়ে আসবে বিশাল মঙ্গল বাদীর বক্তব্য অনুসারে:

ভারতের বিরুদ্ধে কেবলমাত্র মাওবাদীরা একত্র হচ্ছে না। বেশীরভাগ দরিদ্রদের চরমপন্থী করা হচ্ছে, সে মুসলমান, হিন্দু ধর্মান্ধ আর মাওবাদী গেরিলা হোক।

ভারত সরকার বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছে মাওবাদীদের বিরুদ্ধে সেনা না পাঠিয়ে। কারন শীঘ্র সেনাবাহিনীর প্রয়োজন হতে পারে আমাদের শহরকে দরিদ্রদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য যারা অবশেষে ভারতের অপরাধী পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জেগে উঠতে শুরু করেছে।

Exit mobile version