বাংলাদেশের বেশিরভাগ গার্মেন্টস কর্মী নারী, তবে তাদের ইউনিয়নের নেতারা নন

Garment workers at Alif Embroidery Village, a garment factory in Dhaka, Bangladesh. Credit: Amy Yee. Used with PRI's permission

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার আলিফ অ্যাম্বডারি ভিলেজের গার্মেন্টস কর্মীরা। ছবি তুলেছেন এমি ইউইই। অনুমতি নিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে।

দ্য ওয়ার্ল্ড অনুষ্ঠানের জন্য এই প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন ব্রুস ওয়ালেস। প্রথম প্রকাশিত হয়েছে পিআরআই ডট অর্গে, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫-এ। কনটেন্ট শেয়ারিং চুক্তির আওতায় এখানে প্রকাশ করা হলো।

ইঁট-পাথরের ঘরটিতে মোটে ১৫ জন লোক ধরে। কিন্তু লোক আছে আরো বেশি। তারা বাইরে দাঁড়িয়ে কথা শুনছেন। উপস্থিত সবাই বাংলাদেশের রাজধানীতে অবস্থিত ঢাকা ডাইং নামের একটি কারখানায় কাজ করেন। এরা গ্যাপ, টার্গেট এর মতো নামকরা প্রতিষ্ঠানের পোশাক তৈরি করেন। তারা সবাই একটি শ্রমিক ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করতে চান।

পিআরআই ডট অর্গের প্রতিবেদন শুনুন এখানে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প বেশি কয়েকটি দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয়েছে। ২০১২ সালের নভেম্বর মাসে তাজরিন গার্মেন্টসে অগ্নিকাণ্ড; এরপরে ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে রানা প্লাজা ধসের ঘটনা ঘটে। এতে করে বাংলাদেশের পোশাকশিল্প আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পড়ে। এর পরিপ্রেক্ষিতে পোশাকশিল্পে নানামুখী সংস্কার হাতে নেয়া হয়েছে। পোশাকশিল্পে কর্মরত শ্রমিকরাও সংগঠিত হচ্ছে। যেমন একদল কর্মী এখানে জড়ো হয়েছেন, যাদের বেশিরভাগ আবার নারী, তারা কীভাবে ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করা যায় সেটা নিয়ে আলোচনা করছেন। যদিও বাংলাদেশে এটা একটি বিপজ্জনক পদক্ষেপ।

মাগরিবের নামাজ শেষে স্মৃতি রাণী সমবেত শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন। তিনি গার্মেন্টস ওয়ার্কার সলিডারিটি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক। নেতৃত্ব দেয়ার আগে তিনি সাধারণ নারী পোশাক শ্রমিক ছিলেন।

বাংলাদেশ তৈরি পোশাক ও শিল্প শ্রমিক ফেডারেশনরে একজন সংগঠক শামীমা আক্তার। শ্রমিক সংগঠন করতে গিয়ে কী ধরনের হুমকি পেয়েছেন, সেটা নিয়ে বলছেন। ছবি তুলেছেন ব্রুস ওয়ালেস। অনুমতি নিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে।

সে তার বক্তব্যে জানায়, ১৯৯৪ সালে মাসে তার বেতন ছিল মাত্র ২৫০ টাকা। এরপর থেকেই সে শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করছে। এজন্য দুবার জেলও খেটেছেন।

তিনি বলেন, আমি সাধারণ পোশাক শ্রমিক ছিলাম। কোনো নেতা ছিলাম না। আমি কখনোই নেতা হতে চাইনি। হ্যাঁ, আমি আপনাদের চাইতে হয়তো অল্প একটু বেশি জানি। তবে আপনারা এমন অনেক কিছুই জানেন, যা আমি জানি না।

বাংলাদেশে শ্রমিক ইউনিয়ন করা অবৈধ নয়। তবুও শ্রমিকরা গোপনে মিলিত হয়। প্রকাশ্যে একসাথে বসতে অসুবিধা মনে করে। সম্প্রতি তারা এখানে মিটিংয়ের স্থান ঠিক করেছে। কারণ এর আগে যেখানে ছিল, সেখানে স্থানীয় একজন তাদের কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছিল। আক্তার উপস্থিত সবাইকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, মিটিং করার ব্যাপারে তাদের মালিকরা যদি জানতে পারে, তাহলে মালিক কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের একে অপরের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিতে পারে। চাকরিচ্যুতও করতে পারে। তারা সহিংসও হয়ে উঠতে পারে।

বাংলাদেশের ঢাকার ভারটেক্স কারখানা। এখানে প্রায় ৪,৫০০ জন পোশাক শ্রমিক কাজ করেন। কারখানাটির উন্নয়নে ব্যয় হয়েছে ১.২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ছবি তুলেছেন এমি ইউইই। অনুমতি নিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে।

পাশের বসে ছিল রহিমা নামের একজন নারী পোশাক কর্মী। আক্তার তাকে দেখিয়ে বলে, তারা একদিন রহিমাকে আক্রমণ করেতে পারে। অন্যদিন হয়তো অন্য কাউকে আঘাত করবে। আপনি যদি তাদের দুর্ব্যবহারের বিরুদ্ধে কথা বলেন, তারা কোনো শ্রমিককে পুনরায় আঘাত করতে কসুর করবে না।

২ বছর আগে বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি পেয়েছে। তাদের ন্যূনতম মজুরি দ্বিগুণ হয়েছে। এখন মাসে সেটা ৬৮ ডলার (প্রায় ৫,৫০০ টাকা)। আক্তার জানান, ইউনিয়নগুলো চেষ্টা করছে আগামী ৫ বছরের মধ্যে এই পরিমাণটা দ্বিগুণ করতে। তাছাড়া নতুন শ্রমিক আইন হয়েছে, সেখানে নারী শ্রমিকদের সন্তান প্রসবের সময়কালের ছুটি বাড়ানো হয়েছে। আবার শ্রমিকদের লাভের অংশও দেয়ার কথাও বলা হয়েছে। তবে আক্তার জানান, শুধুমাত্র ইউনিয়নই পারে এগুলো কাগজকলম থেকে বাস্তবে নিয়ে আসতে।

তিনি অন্যান্য শ্রমিকদের উদ্দেশ্য করে বলেন, ইউনিয়ন অনেকটা ছাতার মতো। আমরা যেমন বৃষ্টি ছাড়া কাদা পাবো না, তেমনি সূর্য ছাড়া গরমও পাবো না।

দেড় ঘণ্টার আলোচনা শেষে শ্রমিকরা ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার জন্য একটি ফরম পূরণ করে। অন্যদিকে আক্তার কথা বলে যাচ্ছে।

উপরের ভবনের ছবিটি বাংলাদেশ তৈরি পোশাক উৎপাদনকারী ও রপ্তানিকারক সংগঠন বিজিএমইএর। ভবনটি যথাযথ অনুমোদন ছাড়াই নির্মিত হয়েছে বলে দেশটির উচ্চ আদালত চার বছর আগে রায় দেয়। উচ্চ আদালত ভবন ভেঙে ফেলার নির্দেশও দিয়েছিল। কিন্তু এখানো সেটা বহাল তবিয়তে আছেন। ছবি তুলেছেন ব্রুস ওয়ালেস। অনুমতি নিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে।

এর কয়েকদিন পরে আমার দোভাষী এবং আক্তারকে সাথে নিয়ে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক উৎপাদনকারী ও রপ্তানিকারক সংগঠন বিজিএমইএর অফিসে যাই। গত বছরে তৈরি পোশাক শিল্প ২৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে। যা দেশটির মোট রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশ। আর এই রপ্তানির পুরোটা সুবিধা ভোগ করেন দেশটির নির্বাচিত নেতারা। এজন্য আক্তারের মতো শ্রমিক নেতারা বিজিএমইএর বিরুদ্ধে কথা বলছেন।

২০০৭ সালে সেনা শাসিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বাংলাদেশে ইউনিয়ন করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। তখন শ্রমিক সংগঠনগুলো এর প্রতিবাদ করে। ২০১৩ সালে নতুন শ্রমিক আইন পাস হয়। এএফএল-সিআইওর সলিডারিটি সেন্টার ঢাকার তথ্য মতো, সে সময়ে দেশে ৪০০ এর বেশি শ্রমিক সংগঠনকে অনুমোদন দেয়া হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে ১৫০,০০০ তৈরি পোশাক শ্রমিক সংগঠনগুলোর ছায়ায় রয়েছে। যদিও দেশটির তৈরি পোশাক শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকের সংখ্যা ৪ মিলিয়ন। এদের আবার ৮০ শতাংশই নারী। যদিও সংগঠনগুলোর নেতৃত্বে তাদের খুব একটা দেখা যায় না।

ইউসি বার্কলের চৌধুরী সেন্টার ফর বাংলাদেশ স্টাডিজের পরিচালক সঞ্চিতা সাক্সেনা বলেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ইউনিয়নগুলোতে শ্রেণিবিভাগ দেখা যায়। আর সেখানকার পদগুলোতে বেশিরভাগই পুরুষরা অধিকৃত করে আছেন। প্রায় সময়ই দেখা যায় ইউনিয়নের প্রধান একজন পেশাদার ইউনিয়ন কর্মী। তারা নিজেরা কখনো গার্মেন্টস শিল্পে কাজ করেননি।

তবে ইউনিয়নগুলোতে নারী নেতৃত্ব দিন দিন বাড়ছে। দেশটির সবচে’ পরিচিত দু’জন গার্মেন্টস শ্রমিক নেতা হলের নারী। (নাজমা এবং কল্পনা আক্তার। তবে স্মৃতি আক্তারের সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই।)। এএফএল-সিআইওর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে দুই-তৃতীয়াংশ গার্মেন্টস কারখানা পর্যায়ে নারী নেতৃত্ব রয়েছে।

এটা ইউনিয়নগুলোর জন্য ভালো খবর যে, গার্মেন্টস শ্রমিকরা ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার জন্য নিবন্ধন করতে উত্সাহিত হচ্ছে। সংগঠক হিসেবে স্মৃতি আক্তার জানেন, কীভাবে শ্রমিকদের সাথে কথা বলতে হয়। উদাহরণ হিসেবে তিনি গ্রাম বাংলার কিছু রূপক তুলে ধরেন, যার ফলে তাদের বুঝতে আরো সুবিধা হয়।

কাজ শেষে গার্মেন্টস শ্রমিকরা একটি উইমেন ক্যাফেতে বসে খেলছে। পাশাপাশি তারা শ্রমিকদের অধিকার ও কর্তব্যের বিষয়ে জানছে। ছবি তুলেছেন এমি ইউইই। অনুমতি নিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে।

সে জানায়, মালিকরা হলো পিচ্ছিল মাছের মতো। তাই পিচ্ছিল মাছকে কীভাবে ধরতে হয়, সেটা আমরা সবাই জানি।

একজন শ্রমিক জানায়, ছাই দিয়ে ধরতে হয়।

আক্তার জানান, হ্যাঁ, ছাই! ইউনিয়নগুলো হলো ছাই। তাই সব শ্রমিকদের একত্রিত হতে হবে।

ঢাকা ডাইং কোম্পানির কর্মীদের সাথে আক্তারের বৈঠকের কয়েক মাস পরের আপডেট নিয়েছি। সে আমাকে বলেছে, সরকার দু’বার তাদের ইউনিয়নের জন্য আবেদন প্রত্যাখান করেছে। প্রত্যেকবারই তাদের বক্তব্য ছিল, ইউনিয়ন গঠনের জন্য ৩০ শতাংশ শ্রমিকের স্বাক্ষর নেয়া হয়নি।

তবে আক্তার দমবার পাত্র নন। তিনি জানিয়েছেন, তারা আবার আবেদন করবেন। পরের বার তারা ৭০ শতাংশ শ্রমিকের স্বাক্ষর-সহ আবেদনপত্র দাখিল করবেন। ঢাকা ডাইংয়ের কর্মীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আপনারা শুধু মাথা ঢেকে বসে থাকতে পারেন না। আপনাদের অধিকার যা আছে, সেগুলোর দাবি জানাতে হবে।

Exit mobile version