কারাবন্দী সিরীয়- ফিলিস্তিনি বাসেল খারতাবিল-এর উদ্দেশ্যে লেখা এক প্রেমপত্র

Bassel Safadi and his wife Noura. Photo from Noura Ghazi Safadi's Facebook page.

বাসেল সাফাদি এবং তার স্ত্রী নুরা। ছবি নুরা গাজী সাফাদির ফেসবুক পাতা থেকে নেওয়া হয়েছে।

সর্বশেষঃ গত আগস্ট ১, ২০১৭ তারিখে বাসেল খারতাবিলের স্ত্রী নুরা গাজী জেনেছেন যে সিরিয়ার শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক ২০১৫ সালে বাসেলের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল। তিনি এই প্রেমপত্রটি লিখেছিলেন ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, তার স্বামীর মৃত্যুদণ্ড ঘোষণার অসমর্থিত খবর পাবার ৯ মাস আগে। সেই খবর শোনার পর থেকে গত পহেলা আগস্ট পর্যন্ত নুরা বা বাসেলের সমর্থকদের কেউই তার কোন খবর পাননি। গত দুই বছর ধরেই নুরা আশা করে ছিলেন তার স্বামীর সাথে পুনরায় মিলিত হবার।

২০১৫ সালের ১৫ মার্চ তারিখে দামেস্কের বাসেল খারতাবিল-এর কারাগারে আটকের এক বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে। বাসেল সাফাদি নামে পরিচিত এই প্রখ্যাত ব্লগার ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট পেশায় একজন ওপেন সোর্স ডেভলপার। সিরিয়ার একে ক্রিয়েটিভ কমন ডেভলপার এবং মোজিলা ফায়ারফক্স এবং উইকিপিডিয়ায় সক্রিয়, জনতার জন্য সিরিয়ার ইন্টারনেট উন্মুক্ত করা এবং অনলাইন প্রবেশ এবং জ্ঞানকে বিবর্ধিত করার ক্ষেত্রে তার কৃতিত্ব রয়েছে। ইউরোপীয় সংসদের সংবাদ অনুসারে তার এই গ্রেফতার সিরীয় সরকারের অনলাইন সম্প্রদায়ের সেখানে প্রবেশের সুযোগকে সীমাবদ্ধ করার এবং দেশটিতে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে বাকরুদ্ধ করার এক প্রচেষ্টা।

বিয়ের একদিন আগে বাসেলকে গ্রেফতার করা হয়, তার স্ত্রী নুরা তার স্বামীর প্রতি লেখা এই চিঠিকে জনসম্মুখে তুলে ধরার জন্য ভালবাসা দিবস হিসেবে পরিচিত ১৪ ফেব্রুয়ারি তারিখটি বেছে নিয়েছে। :

ভালবাসা দিবসে আমি কোন কবিতা লিখতে পারি না, আমার সত্যি তোমাকে দেখা দরকার, তোমার চোখ থেকে আমার শব্দ চুরি করা দরকার, এখন আমি কেবল তোমার চোখের কথা ভাবতে পারি
আর যখন আমি তোমার চোখের দিকে তাকাই, আমার মাঝে আর কোন ভাষা থাকে না, আমি আর কিছু ভাবতে পারি না, আমি কেবল সিরিয়ার কথা ভাবি, ওহ বাসেল, এটা একটা যন্ত্রণা, সিরিয়া ব্যাথা পাচ্ছে
সিরিয়া, যখন এই নামটি আমি উচ্চারণ করি আমি কাঁদি
আমার সকল ভালবাসা সিরিয়ার জন্য
আমি যদি জানতাম কি ভাবে একে ভালবাসা যায়, যদি আমরা একে ভালবাসতাম তাহলে আমরা আজ যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, কখনো সেখানে আসতাম না …
আমরা ছিলাম
আমি মনে হয় আমরা সকলে একে ভালবাসি, কিন্তু জানি না কিভাবে তাকে ভালবাসতে হবে

এমন কি আমরা জানি না কিভাবে সিরিয়াকে ভালবাসতে হয়
বাসেল আমার খুব ভয় হচ্ছে, যে দেশটা টুকরো টুকরো করা হচ্ছে, তাকে ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে, তার ভেতর থেকে রক্ত ঝরাচ্ছে, তাকে ধ্বংস করা করা হচ্ছে ..
ওহ বাসেল, আমার ভয় হচ্ছে যে আমাদের স্বপ্নগুলো পাল্টে যাচ্ছে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে আমার যে মুক্ত স্বদেশের স্বপ্ন দেখেছি আজ আমরা তার ধ্বংস প্রত্যক্ষ করছি। ওহ বাসেল, আমার ভীষণ ভয় হচ্ছে …
আমি একটা গোলাপ দিতে চাই
লাল নয়, রক্তের মত;
সাদা রঙের মত সাদা নয়, আমরা বিয়েতে সাদা পোষাকে নিজেদের আবৃত করব না;
আমি এক নীল গোলাপ দিতে চাই, আমার বিয়েতে আমি এই পোষাক পড়েছিলাম।
আমার স্কার্টের রঙে ছিল তার রঙ, আমি তা পড়েছিলাম যখন তুমি বলেছিলে আমাকে ভালবাস;
ওহ বাসেল, এই দেশের কাছে আমরা অনেকভাবে ঋণী ;
আমার ক্লান্তিকর প্রতিটি মুহূর্ত
আমার দূর্বল প্রতিটি মুহূর্ত
আমার প্রতিটি কান্নার মুহূর্ত
নিজেকে স্বার্থপর মনে হয়, আর কেবল সিরিয়াকে ঘিরে যত চিন্তা আমার
আমার অনুভূতি বলে আমি আমি একে ছেড়ে এবং বিদায় দিতে চাই আর এরপর আমি ফিরে যাই এবং প্রতিজ্ঞা করি যে আমার সিরিয়া হবে শক্তিশালী
আমি বলতে চাই, সে সুন্দর
আমি বলতে চাই সে এক মানুষ
আমি তার নামের এক উল্কি আমার হাতে আঁকতে চাই
প্রিয় বাসেল, সিরিয়া তার যোগ্য
এবার সিরিয়ার জন্য, আমরা সে চেষ্টা করি
ফিলিস্তিনের জন্য;
যে ফিলিস্তিনে আমি তোমার হয়ে বাস করি
তুমি আমার সুন্দর প্রিয়তম স্বামী আর আমি তোমার মাঝে বাস করি
তুমি আমার সুন্দর ফিলিস্তিনি নামক প্রিয়তম
কল্পনা কর
তোমার মাঝে আমি আমাকে খুঁজছি
তোমার মাঝে যা আছে, আমি তার সবকিছুর অভাব অনুভব
তোমার মাঝে যে সিরিয়া আর ফিলিস্তিন, আমি তার অভাব অনুভব করছি

মার্চের ১৫ তারিখে বাসেলকে গ্রেফতার করার দিনটি একই সাথে ২০১১ সালের সিরিয়ার জনপ্রিয় গণজাগরণ শুরুর দিন হিসেবে স্মরণ করা হয়, যখন দেশটির বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নাগরিকরা স্বাধীনতা, মর্যাদা এবং ন্যায়বিচারের দাবীতে রাস্তায় নেমে আসে, তখন মনে হয়েছিল যে কোন কিছু সম্ভব। কিন্তু চার বছর পরে, বাসেল নুরা এবং অন্য অনেকের স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। সিরিয়া এখন নিয়মিত হুমকির মাঝে রয়েছে, যদিও দেশটির নাগরিকরা যে যন্ত্রণা ভোগ করছে তা এখন আর সংবাদের বিষয় হয়ে উঠে আসে না।

অতি সম্প্রতি সরকারি বাহিনীর বোমা বর্ষণে ১৫০ জন সাধারণ নাগরিকের মৃত্যু ঘটে, যা কোন সংবাদের শিরোনাম হতে পারেনি। আজ দায়েস (আইএসআইএস)–এর দ্বারা সংঘঠিত নৃশংসতা সংবাদের পাতায়, আর সিরীয় নাগরিকরা তাদের বন্দী এবং শিকার।

তারা, যারা সিরিয়াকে জানে এবং ভালবাসে, এই দেশের যদি কিছু হয় তাহলে তা এই সকল মানুষদের গভীর বেদনা প্রদান করে, এবং এমন কি তা বাকী বিশ্বের কাছে ক্রমশ অদৃশ্য হয়ে উঠছে । ২০০,০০০ জন নাগরিকের নিহত হওয়ার ঘটনা আমরা আহত, শত শত হাজার হাজার নাগরিক কারাগারে আটক রয়েছে, উদ্বাস্তু হয়েছে, যারা সরকারের কারাগারে অবর্ণনীয় যন্ত্রণায় দিন কাটাচ্ছে, যারা আইএসআইএস-এর মত অত্যাচারী দলের দ্বারা নির্যাতিত হচ্ছে, আর সে সমস্ত দলের নিজস্ব এজেন্ডা এবং আগ্রহ রয়েছ, এবং যারা সিরিয়ার সমৃদ্ধি এবং বৈচিত্র্যময়তার শত্রু। এই অনন্য এবং অপূরণীয় নাগরিক, তারা সংখ্যা এবং পরিসংখ্যানে পরিণত হয়েছে, আর তার পরিমাণে এত বেশী যে জাতিসংঘ তাদের নাম তালিকাভুক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে।

বিশেষ করে, অভিন্ন ভাবে এই সকল বিষয় এক আঘাত তৈরী করে। এমন এক ছবি যা আর ঘৃণামিশ্রিত ক্রোধ তৈরী করে না, নৃশংসতার যে দলিল তা না দেখা ভিডিও ফাইলের স্তূপে জমা হতে থাকে। তাদের প্রতি সহানুভূতি, যারা এই সকল ঘটনার ব্যক্তিদের সাম্রাজ্যবাদী অথবা সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ঘটনার শিকার হিসেবে শ্রেণীভুক্ত করে, ভূ-কৌশলগত রাজনীতির ভিত্তিতে এর বৈধতা এবং অবৈধতা নির্ধারণ করে এবং যারা যন্ত্রণার যন্ত্রণাকে অস্বীকার করে।

এটা এমন কি প্রিয়জন হারানোর বেদনার চেয়ে আহত করে, কারণ একটা দেশ হারানোর যন্ত্রণা উপশম করার চিকিৎসা নেই। এই ক্ষত কোনদিন সারে না। যারা সিরিয়াকে ভালবাসে, সিরিয়ার জন্য তাদের বেদনা কোনদিন শেষ হবে না।

*এই পোস্টটির কিছু অংশ মূল আরবিতে লিখেছেন লেখিকা লীলা নাচাওয়াতি, আর এর অনুবাদ করেছে ডিয়ানা নাভাররেটে
Exit mobile version