মায়ানমারঃ শরণার্থী শিবিরের জীবন

নয় মাস ধরে মায়ানমার সেনাবাহিনী ও কোচিন ইনডিপেন্ডেন্স অরগানাইজেশনের (কিও) মধ্যে যুদ্ধ অব্যাহত রয়েছে। কোচিনের অন্যান্য এলাকায়, চীন সীমান্তের নিকটবর্তী গ্রামগুলোতে হাজারো মানুষ পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছে।

সরকার নিয়ন্ত্রিত এলাকায় কমপক্ষে ৬৬ টি শরণার্থী শিবির এবং কোচিন ইন্ডিপেন্ডেন্স নিয়ন্ত্রিত এলাকা ও অপরপ্রান্তের চীন সীমান্তবর্তী এলাকায় আরও অনেক শরণার্থী শিবির রয়েছে।

মধ্য ফেব্রুয়ারিতে ইয়াঙ্গন ভিত্তিক বার্মিজ ব্লগার ন্যাং নেওয়াই এবং তার বন্ধু চীন সীমান্তে অবস্থিত শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন এবং তিনি, তার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। তিনি, তার একটি ব্লগের লেখা শুরু করেন এভাবে:

সবাই আমাকে যেমন জানে ঠিক সে রকম আমি একজন সাধারণ মেয়ে। আমি রাজনীতির সাথে জড়িতও না, রাজনীতি আমি বুঝিও না। আমি কোন রাজনৈতিক দল, সংগঠন অথবা কোন মতাদর্শের অনুসারীও না। আমি শুধু স্বাধীনতা, ন্যায় বিচার আর মানবতাবাদে বিশ্বাসী। কাজেই আমি আমার দেখার অভিজ্ঞতা ও বিষয়টিকে যেভাবে উপলব্ধি করেছি সেভাবেই আমি আপনাদের জানাতে চাই।

এ ভ্রমণে সঙ্গী হিসেবে তার আরও চারজন বন্ধু ছিলেন। তারা ইয়াঙ্গন থেকে মান্দালয় এবং এরপর শান রাজ্যের মুসে ভ্রমণ করেন। পরবর্তীতে তারা সীমান্ত অতিক্রম করে চীনা সীমান্তের শহর শাও লি তে গিয়ে শরণার্থীদের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনেন। পরবর্তী দিন তারা শরণার্থী শিবিরে যান:

ন্যাং নেওয়াই ও তার বন্ধুদের ভ্রমণ মানচিত্র

কোচিন রাজ্যে যুদ্ধ শুরু হলে শরণার্থীরা নিকটবর্তী সীমান্তে পালিয়ে যায়। লইযার শরণার্থী শিবির একটি প্রসিদ্ধ শরণার্থী শিবির কিন্তু আমরা লিও জে সীমান্তের নিকটবর্তী শিবিরে গিয়েছিলাম। চীনা অঞ্চলের লিউ জে-এর পরে লাই ইন – এ শিবিরগুলো অবস্থিত। লাই ইনের নিকটবর্তী শরণার্থী শিবিরগুলো উনপাং নিংথই (ডব্লিউ পি এন) নামক কোচিন গ্রুপ পরিচালনা করছে। কোচিন ভাষায় “উনপাং” মানে “ নিখিল কোচিন” এবং “নিংথই” মানে “ আলো”। কাজেই এ দলটিকে আপনি “ কোচিনের আলো” বলতে পারেন।

শরণার্থী শিবিরে প্রবেশের সময় তিনি অনেক শিশু দেখেন কিন্তু শিশুরা তাকে দেখে ভয় পাচ্ছিল:

এক কোচিন শিশু (ছবি ন্যাং নেওয়াই-এর)

এতিমখানায় এবং বৌদ্ধ ধর্ম শিক্ষা কেন্দ্রগুলোতে আমি স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেছি। কাজেই শিশুদের দেখে আমি আনন্দিত হই এবং তাদের উচ্ছসিত ভাবে সম্ভাষণ করি। কিন্তু সেখানে আমরা শিশুদের কাছেই যাতে পারি নি। আমরা দুঃখিত যে আমাদের দেখে শিশুরা পালিয়ে যায় কারন আমরা তাদের কাছে অপরিচিত আর আমাদের চেহারা বার্মার অধিবাসীদের মত।

শরণার্থী শিবিরের অবস্থা নিয়েও তিনি মন্তব্য করেন:

শরণার্থী শিবিরের তাবু (ছবি ন্যাং নেওয়াই-এর)

সেখানে গিয়ে আমরা যা দেখতে পাই তা হল প্রয়োজনের তুলনায় কম শৌচাগার। একটি শরণার্থী শিবিরে যেখানে ১০০০ এরও বেশি লোক বাস করে সেখানে শৌচাগার মাত্র ১১ টি। প্রায় এক মাইল দূরে প্রায় শুকনো একটি নালা থেকে শৌচাগারের জন্য পানি তোলা হয়। পুরো শিবিরে একটিমাত্র কুয়া। সেই কুয়ার পানি তারা খাবারের কাজে ব্যবহার করে। চীনা গ্রামের বাইরে আঁখ ক্ষেত আর পুরোনো বাধের মধ্যে এ শিবিরটি অবস্থিত। এলাকাটির মধ্যে বড় কোন গাছ নেই, কাজেই দিনের বেলায় এলাকাটি ধুলোময় থাকে গরম হাওয়া বয়, রাতে শীতের ঠাণ্ডা বাতাস জল নিরোধক ক্যানভাসের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে খুব কনকনে ঠাণ্ডা হয়।

তার ব্লগের দ্বিতীয় পর্বে তিনি পুরনো মিল অথবা কয়লা কারখানায় তাদের চাহিদা মেটানোর বিষয়ে লিখেন। তিনি তার পোস্টে এ বিষয়ে বিস্তারিত লিখেন:

শরণার্থী শিবিরে শিশুদের খেলা (ছবি ন্যাং নেওয়াই-এর)

যে সব শরণার্থী শিবিরে তারা বাস করেছেন তার মধ্যে অনেকগুলোর খুব কাছেই গোলাগুলি চলত। আমরা এমন একটি জায়গার সন্ধান পাই যে জায়গাটি সম্পর্কে তারা বলে যে ভুট্টা ক্ষেতের পর আখ ক্ষেত পার হলেই তারা তাদের পুরনো গ্রামে ফিরে যেতে পারবেন। এ ধরণের শিবিরগুলোর ক্ষেত্রে পানীয় জলের জন্য তারা পুরনো গ্রামগুলোতে ফিরে যান। এ ক্ষেত্রে তাদের পরিস্থিতি সম্পর্কে সজাগ থাকতে হয় এবং গোলাগুলি এড়িয়ে চলতে হয়। আমরা যে সকালে চলে আসছিলাম সে সকালে আখ ক্ষেত থেকে আখ তুলতে গিয়ে বোমা বিস্ফোরণে একজন নিহত হন। শিবিরগুলোর অনেকেই ডায়রিয়ায় মারা যায়।

তার ভ্রমণের দ্বিতীয় দিনে তারা এবং শিবিরের দায়িত্বপ্রাপ্তরা মিলে শরণার্থীদের চাহিদা এবং তারা প্রতিদানে কি দিতে পারবেন সে বিষয়ে ছোট একটা সভা করেন:

এ মহিলা চীনা বাজারে ঝাড়ু বিক্রি করেন (ছবি ন্যাং নেওয়াই )

তাদের মূল চাহিদা হল পানীয় জল আর রান্না, শৌচাগারের জন্য পানি। এরপর ঔষধ এবং খাবার। কাপড়, রান্নাঘরের জিনিষপত্র, কম্বল, বালিশ রয়েছে পর্যাপ্ত কারন চীনা গ্রামগুলো থেকে অনুদান হিসেবে ওইগুলো পেয়ে থাকে। কিন্তু তারা কেবল আমাদের সোয়েটার আর প্যান্ট দেয়, মেয়েদের এখনও লুঙ্গির প্রয়োজন রয়েছে। কাজেই আমরা আমাদের বাকি টাকাগুলো তাদের দান করলাম যাতে তারা একটি কুয়া স্থাপন করতে পারে।

লেখার তৃতীয় পর্যায়ে ন্যাং নেওয়াই, কোচিন গ্রামবাসীরা যে ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হয় সে বিষয়ে লিখেন:

গ্রামবাসীরা যেখানে পালিয়ে ছিল সেখানে একদিন বিকেলে সেনাবাহিনী (বার্মার) এসে গোলাগুলি করে। গ্রামে আর ঝর্ণার পাশে খেলা করা শিশুদেরকে তুলে নিয়ে গ্রামবাসীরা পালাতে চেষ্টা করে, কিন্তু সদ্য সন্তান প্রসবকারী একজন মহিলা তার সাত দিন বয়সী শিশু, চার বছর বয়সের আরেকটি শিশু এবং মা গ্রামে আটকা পরে।

জঙ্গলে আশ্রয় নেওয়া গ্রামবাসীরা সারা রাত শিশুদের কান্না শুনতে পায় কিন্তু তারা সাহস করে গ্রামে যেতে পারেনি। তারা বেশি দূর যেতে না পেরে রাতভর সেখানেই অপেক্ষা করেছে । খুব ভোরে সৈন্যরা চলে গেলে সাত-দিন বয়সী শিশুর বাবা এবং চার বছর বয়সী শিশুর দাদা গ্রামে ফেরত যান। সারা রাত কাঁদার জন্য শিশু দুটি কান্নার আর কোন শক্তি ছিল না। ৭ দিন বয়সী শিশুটির মায়ের মরদেহ পাওয়া যায় একটি পাথরের পেছনে। তার শরীরে বুকের বাম পাঁজর থেকে ডান পাঁজর বরাবর বেয়নেটের ক্ষত ছিল। গ্রামবাসীরা তাকে সমাহিত করতে কিংবা সরিয়ে নিতেও সক্ষম ছিল না, তারা শুধু শিশুটিকে তুলে নিয়ে চলে আসে। ৪-বছর বয়সী শিশুর মাকে সৈন্যরা বন্দি করে নিয়ে যায় এবং এখন পর্যন্ত তার কোন খোজ পাওয়া যায় নি।

সভার সময় কোচিন গ্রামবাসীরা তাকে কি বলেছিল সে বিষয়েও তিনি লিখেছেনঃ

কোচিনের এক শরণার্থী একটি লেখা লিখেছে, যেখানে সে বলছেঃ “ আমরা সবাই তোমাকে ভালোবাসি। যখন তুমি ইয়াঙ্গনে ফিরে যাবে, তুমি কি আমাদের সেখানকার টেলিফোন নাম্বার দেবে? কখন তুমি ইয়াঙ্গনে ফিরে যাবে, তুমি কি আমাদের কাছে আমাদের ছবি পাঠাবে? আমরা সকলে তোমাকে ভালোবাসি?


আমি এত আনন্দিত যে বামারের-এর শিশুরা আমাদের সাথে দেখা করেছে। আমরাও বামারের জনতাকে ভালোবাসি। সর্বোপরি আমরা সকলে মানুষ, কাজে আমরা আনন্দিত এবং আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞ যে আপনারা আমাদের কাছে এসেছেন এবং যেটুকু পেরেছেন আমাদের সাহায্য করছেন। আপনারা যা দান করেছেন তার কারণে নয়, আপনাদের সহৃদয়তার জন্য আপনাদেরকে ধন্যবাদ প্রদান করেছি। আমরা আনন্দিত এই কারণে যে আমাদের যা প্রয়োজন তা দিয়ে আপনারা আমাদের সাহায্য করবেন, কিন্তু সত্যিকার অর্থে আমাদের এ সবের প্রয়োজন নেই। আমরা শান্তি চাই, আমরা, আমাদের ঘরে ফিরে যেতে চাই। আমরা আমাদের নিজেদের জমিতে, আমাদের নিজ গৃহে, নিজেদের পরিবারের সাথে শান্তিতে বাস করতে চাই। দয়া করে আমাদের এই কাজে সাহায্য করুন- অশ্রু সজল চোখে গ্রামবাসীরা আমাদের এই কথা গুলো বলল।

যখন ন্যাং নেওয়াই এবং তার বন্ধুরা শিবির ত্যাগ করছিল, তখন গ্রামবাসীরা তাদের গাড়ির সাথে সাথে আসছিল। তিনি গ্রামবাসীদের বিদায় বার্তা সম্বন্ধে লিখেছেন:

শরণার্থী শিবিরের গ্রামবাসীদের একটি দলগত ছবি (ছবি ন্যাং নেওয়াই -এর)

আমরা তাদের বললাম, “আপনাদের সাথে আবার দেখা হবে, কিন্তু এখানে নয়, কোচিন প্রদেশে”। তারা যখন এই কথাটি শুনল, সাথে সাথে তারা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। তারা উত্তর করল, “হ্যাঁ আমাদেরও আবার আপনাদের সাথে দেখা হবে, তবে এখানে নয়। আপনাদের আমরা আমাদের গ্রামে স্বাগত জানাবো।”

তবে কোচিন-এর শরণার্থীদের এই চাওয়া মনে হচ্ছে পুরণ হতে আর খুব বেশী দেরী নেই। এ সপ্তাহে কিও আর্মি এবং বার্মার [মায়ানমারের সরকার] প্রতিনিধিদের মধ্যে রুলি নামক এলাকায় যুদ্ধ বিরতি নিয়ে তৃতীয়বারের মত বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। রুলির পথে রওনা হবার আগে কোচিন বাহিনীর প্রধান সামলাত গাম বলেনঃ :

আমি আশাবাদী যে, সব কিছু আগের চেয়ে ভালো হয়ে উঠবে

 

Exit mobile version