আফ্রিকা রাইটিং অনলাইনে প্রদান করা এক সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে লাইলা লালামি নামক একজন মরোক্কো-আমেরিকান এক লেখিকা তার শিক্ষা লাভের বিষয়টি বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেন। লালামি মরোক্কোয় প্রচলিত আরবিতে কথা বলে বেড়ে উঠেছেন। তবে কিশোরী অবস্থায় উপনীত হবার পর তিনি মরোক্কোর উপন্যাস পাঠ করা শুরু করে। এই সমস্ত উপন্যাস ছিল মরোক্কোর লেখকদের লেখা এবং সেগুলো মরোক্কোর চরিত্রকে তুলে ধরেছিল। লালামি জানান,“এগুলো ছিল প্রাথমিক পাঠ, কারণ সে শিশু অবস্থায় একটি ফরাসী স্কুলে পড়েছিল”।
“ফরাসী ভাষা ছিল আমার প্রথম সাহিত্য পাঠের মাধ্যম। টিনটিন এবং অ্যাসট্রিক্স নামক কমিক (ছবির মধ্য দিয়ে গল্প) দিয়ে শিশু বয়সে সাহিত্য পাঠ শুরু। কিশোরী বয়সে পড়েছি আলেকজান্ডার দ্যুমার উপন্যাস। পুরো যাত্রায় সাথে ছিল ভিক্টোর হুগোর চিরায়ত উপন্যাস সকল”।
তবে, লালামি তার প্রথম উপন্যাসটি প্রকাশ করেছে। এর নাম সিক্রেট সন (গোপন পুত্র)। এটি লেখা হয়েছে ইংরেজীতে। সে ইউনিভার্সিটি অফ সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া থেকে ভাষাতত্ত্বে পিএইচ.ডি ডিগ্রী অর্জন করার পরই তিনি এই বই প্রকাশ করেন।
লালামির অভিজ্ঞতা মরোক্কোর শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেক সাধারণ এক ঘটনা। মরোক্কোবোর্ড.কমের একজন লেখক সাইদ বেলারি। তিনি ফরাসী ভাষার উপর থেকে ধাপে ধাপে নির্ভরতা কমানোর পক্ষে কথা বলছেন এবং তার বদলে তিনি ইংরেজীকে মরোক্কোর দ্বিতীয় সরকারি ভাষা হিসেবে প্রচলন করার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। তার রচনায় তিনি এক নতুন ধারার এক ধারণা চালু করেন যাকে বলা হচ্ছে “ডিসলিটারেসি” বা ভুল ভাষায় শিক্ষিত হওয়া:
“এর মানে হচ্ছে মরোক্কোয় লোকজন নিজেদের মাঝে এবং বাকী বিশ্বের সাথে কথা বলার সময় ভুল ভাষায় কথা বলছে। এ কারণে আমরা বিশ্ব ধারায় মিশে যেতে ব্যর্থ হচ্ছি এবং এর ফলে দক্ষিণ এশিয়ার মত উন্নয়নের ধারা থেকে নিজেদের ক্রমশই বিচ্ছিন্ন করে ফেলছি। বিষয়টিকে পরিষ্কার করা দরকার; এই ধারণার মধ্য দিয়ে আমি বলতে চাইছি না যে আমরা মরোক্কোয় আরবী ভাষায় কথা বলা বন্ধ করে দেব না। আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুক! (আল্লাহ ইয়াসতারর)! অন্তত এমনটা নয়, তবে হয়ত আমরা তা করব, এমন কি তারচেয়ে বেশি। আমি যা বোঝাতে চাইছি তা হচ্ছে আমাদের লক্ষ্য থাকবে যত দ্রুত সম্ভব ধাপে ধাপে ফরাসী ভাষা ব্যবহার বন্ধ করে দেওয়া।
একই সাথে মরোক্কো সমাজের সকল স্তরে ইংরেজী বলাকে এক নতুন উদ্দীপনা প্রদান করব এবং ইংরেজিকে মরোক্কোর দ্বিতীয় ভাষার মর্যাদা প্রদান করব। এ ক্ষেত্রে ফরাসী ভাষাকে তৃতীয় বা চতুর্থ স্তরে রাখা হবে না। ফরাসী ভাষাভাষী এলাকা থেকে “আরব-ইংরেজিভাষী” অঞ্চলে পরিণত হবার মধ্যে দিয়ে দেশটি দ্বিতীয় এক স্বাধীনতার যুগে প্রবেশ করবে (ইসতেকলাল)”।
ভাষা সমাজ গঠনের এক অন্যতম মাধ্যম। সমাজ বিকশিত হবার জন্য সাধারণ মূল্যবোধ এবং একটি উদ্দেশ্য গঠিত হয় যাতে তারা একে অন্যের সাথে যোগাযোগ তৈরি করতে পারে। বেলারি লিখেছে যে মরোক্কোর সমাজের জন্য এটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হবে যদি তারা ফরাসীকে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে চালু রাখে:
“মরোক্কোর প্রতিটি শিক্ষাবিদ, বৈজ্ঞানিক, ব্যাবসায়ী, শিল্পী, লেখক, ডাক্তার, রাজনীতিবীদ অথবা যে কোন প্রধান সামাজিক চরিত্র সহজেই স্বীকার করবে যে মরোক্কোর সমাজে ফরাসী ভাষাই প্রধান। পঞ্চাশ বছরের বেশী সময় ধরে ফ্রান্স সফলভাবে মরোক্কোয় এই ভ্রান্তি জীবিত এবং সচল রাখতে সমর্থ হয়েছে যে, আমাদের এই ভাষার সাথে ঐতিহাসিক এবং সংস্কৃতিক বন্ধন বজায় রাখা প্রয়োজন”।
যদিও মরোক্কোর স্বাধীনতা লাভের পর ৫৫ বছর পার হয়ে গেছে, তারপরেও এখনো এখানে ফরাসী প্রভাব বেশ দৃশ্যমান। সামাজিক পরিচয় প্রকাশের জন্য ভাষায় নিজেই একটা মাধ্যম। প্রত্যেকটি ভাষা তার নিজস্ব স্বর, শারিরীক ভঙ্গি, মুখের প্রকাশভঙ্গি এবং উচ্চারণ বৈশিষ্ট্য প্রদান করে। এটি একই সাথে এক গভীর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের মধ্যে দিয়ে আসে। এই ক্ষেত্রে বেলরি বলছে:
“অবশিষ্ট অংশের ক্ষেত্রে বলা যায় মরোক্কোর সমাজে ফরাসী ভাষা এক সবার যোগাযোগের জন্য সাধারণ এক ভাষা (লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা)। সচেতনভাবেই তা বলা হয়। তবে অবচেতনে তা আমাদের স্বাধীনতা লাভের পরই দাস হিসেবে থেকে যাওয়া, নির্ভরশীল হয়ে থাকা, পিছিয়ে থাকা, যোগ্য না হয়ে ওঠা এবং সেই সকল বিষয় ধারণ করা, যা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকরা করে তার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, অথবা আরো ভালো কোন শব্দে বলা যায়: বর্ণবাদী লোকজন যে ভাবে চায় আপনি নিজেকে ভাববেন, অথবা দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষ হয়ে থাকা: আমি কম যোগ্য, কম দক্ষ সে ভাবে ভাবা”।
জাতীয় পরিচয়কে সুস্পষ্ট করা ছাড়াও ইংরেজির ব্যবহার বাড়ানোর মাধ্যমে তা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্বের দ্বার খুলে দেবে। ব্লা ফ্রাঙ্কিয়ার একজন ব্লগার হিশাম বৈজ্ঞানিক স্তরে অগ্রগামিতার অভাব, ফরাসী ভাষার উপর নির্ভরতা, বিশেষ করে বিজ্ঞান শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ার বিষয়টি সম্বন্ধে বর্ণনা করেছেন, ফরাসী ভাষা মরোক্কোর জন্য যথেষ্ট সুবিধা বয়ে আনেনি। হিশাম নীচের পরিসংখ্যান সমূহ তালিকা বদ্ধ করেছে:
যদিও লেখাপড়ার খরচ অনেক বেশি হবার কারণে স্নাতক ডিগ্রী অর্জনের হার কম, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে:
মরোক্কোতে তুলনামূলকভাবে ফরাসী ভাষা প্রচলিত, কিন্তু বেশির ভাগ ছাত্র এই ভাষার মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক বিশ্বের সাথে যুক্ত হবার ক্ষেত্রে ততটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না, যেখানে ফরাসী ভাষা প্রাথমিক ভাষা হিসেবে বিবেচিত হয়। এই পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানোর জন্য ব্লগার খালেদ সামির একটি গবেষণা থেকে উদ্ধৃতি প্রদান করছে, যেখানে খালেদ আরবি ভাষায় বৈজ্ঞানিক ই-ডকুমেন্ট (ইলেকট্রনিক্স কাগজপত্র) এর প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। তিনি পরামর্শ প্রদান করছেন:
.
তবে এই প্রক্রিয়া, বাস্তবে প্রয়োগ করা বেশ কঠিন, কারণ শিক্ষার ব্যয় অনেক বেশি, যথেষ্ট পরিমাণ যোগ্য শিক্ষক পাওয়ার বিষয়টি অনেকটাই বিস্মৃতির এক বিষয়, এর সাথে চার মাসে ভাষা শিক্ষার মত বাস্তবতার কথা নাই বা উল্লেখ করা হল।
নিবিড় ভাবে ফরাসী ভাষা শিক্ষা পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করার একটি মাধ্যম হতে পারে, কিন্তু হিশাম এই বিষয়টির উপর উৎসাহ প্রদান করে যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের ছাত্রদের বৈজ্ঞানিক বিশ্বকে নিজেদের ভাষায় জানবে, যে ভাষাটি হচ্ছে আরবি। এটি বিশাল সংখ্যায় প্রকাশিত প্রকাশনাকে কমিয়ে আনবে না এবং ইন্টারনেট উল্লেখ করা সংবাদ যা ইংরেজী ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক ফোরাম এবং সংগঠন নিজেদের মধ্যে আরবী বা ফরাসী ভাষার চেয়ে ইংরেজীতে যোগাযোগ করতে ভালবাসে।
বেলারি ক্রমাগত তার প্রবন্ধে বলে চলছে যে ইংরেজী ভাষাকে দ্বিতীয় ভাষার জায়গা প্রদান করলে তা আমাদের নিয়ে যাবে:
“মাঠ পর্যায় থেকে সৃষ্টি করা এক যৌথ উদ্যোগ যা দৃঢ় ইচ্ছা, আত্মশক্তি, আত্মপ্রকাশ এবং নতুন আস্থা, আশা এবং ভবিষ্যৎ-এর জন্য একটা আশাবাদ সৃষ্টি করবে। এটা যৌথ জনতার এক প্রচেষ্টা, মরোক্কোর কাঙ্খিত গন্তব্যে এগিয়ে যাবার. এমন এক সময়, যখন থেমে যাওয়া এক দুর্লভ আয়নায় সব সময় দেখতে থাকা এবং সম্মুখের জানলা দিয়ে সামনের দিকে তাকাতে থাকা, ২০৫০ সাল বা তারও সামনের দিকে, আমাদের সন্তান এবং তাদের সন্তানদের জন্য”।
যদি ইংরেজী আনুষ্ঠানিকভাবে মরোক্কোর দ্বিতীয় ভাষার মর্যাদা লাভ করে, তাহলে মরোক্কোর বাসিন্দারা দেখতে পাবে সম্পূর্ণ এক নতুন অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সুযোগ তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।