বাংলাদেশঃ বাংলা ব্লগ রাহেলাকে জীবিত রেখেছে

২০০৪ সালের ১৯শে আগষ্ট ঢাকার সাভারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের ঘন ঝোপ-ঝাড়ের মধ্যে গার্মেন্টসের ১৯ বছর বয়সী একজন শ্রমিকের উপর নির্দয়ভাবে ঝাপিয়ে গণধর্ষন ও পাশবিক নির্যাতন করা হয় এবং তাকে মৃত্যুর মুখে ফেলে রাখা হয়। মেয়েটির নাম রাহেলা লিমা আখতার। সেখানে সে গাছাপালার পুরু পাতারাশির মধ্যে নিরুদ্দেশ তিন দিন পড়ে ছিল। এরপরে নির্যাতকরা সেখানে ফিরে তাকে জীবিত দেখে চেহারায় এসিড মেরে ঝলসে এবং চুলে আগুণ ধরিয়ে দেয় যেন দেহ খুঁজে পাওয়া গেলেও তার পরিচয় শনাক্ত করা না যায়। অবশ্য সেই দিনই, ২২শে আগস্ট ২০০৪, একজন বাগান পরিচর্যাকারী তার অস্পষ্ট চিৎকার শুনতে পায়, “আমি মৃত নই, দয়া করে আমাকে বাচান”। এভাবে মৃত্যুকে অস্বীকারকারী রাহেলাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ এবং হাসপাতালে ভর্তি করা হয় যেখানে সে জীবনের জন্য যুদ্ধ করতে থাকে। অবশেষে ২৪শে আগস্ট রাহেলা জীবনযুদ্ধে পরাজিত হয়, তবে মৃত্যুর আগে নির্যাতকদের নাম বলে যেতে পারে।


রাহেলার মৃতদেহ: আলোকচিত্রের কৃতিত্ব ফয়সাল নোই এর

কেউ হয়তো ভেবে থাকবেন যে এহেন ঘটনার ন্যয় বিচার দ্রুতই হয়ে থাকবে। কিন্তু সেরকম হয়নি। প্রথমদিকে প্রধান প্রচারমাধ্যমগুলোতে জোরালো প্রতিবাদ পরিলক্ষিত হলেও একসময়ে তা থেমে যায়। মামলাটি ২০০৬ সালে শুনানীর জন্য উপস্থাপিত হয় এবং তখন প্রকাশ হয়ে পড়ে যে মামলা সংশ্লিষ্ট জরুরী নথিপত্র খোয়া গেছে। ইতোমধ্যে প্রধান আসামী বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে এবং অন্যরা মুক্ত হয়ে ঘুরে বেড়াতে থাকে। রাহেলার স্বামী পুনরায় বিবাহ করেছে। প্রায় দুই বৎসর অতিবাহিত হয়। মামলাটি হয়তো মানুষের স্মৃতি থেকে হারিয়ে যেত যদি না কতিপয় নারী অধিকার কর্মী এবং বাংলা ব্লগাররা সোচ্চার হতেন। নেতৃস্থানীয় বাংলা ব্লগ প্লাটফর্ম সামহোয়ারইনের মানবী সর্বপ্রথম রাহেলার মামলাটি গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরে। এর অব্যাবহিতপরেই সমমনস্ক ব্লগার যেমন ফয়সাল নোই, শুভ, পথিক !!!!!!, জিনের বাদশা (আরেকটা বাংলা ব্লগিং প্লাটফর্ম, সচলায়তনের) এবং আরো অনেকে যোগ দেয়, এবং রাহেলার জন্য ন্যায় বিচার এর ধ্বনি উচ্চকিত হয়ে ওঠে। ব্লগ, ফেসবুক গ্রুপ এবং আই-পিটিশন ইত্যাদি সংশ্লিষ্ট করে অনলাইন একটা ক্যাম্পেইন সংগঠিত হতে থাকে। অফলাইনে এ বিষয়ে জনগণের সচেতনতা জাগ্রত করার জন্য প্রতিবাদ বিক্ষোভ এবং মানব বন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।

গ্লোবাল ভয়েসেসেও আমরা রাহেলার মামলাটিকে জোরালোভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছি। বাংলাদেশে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে রেজওয়ান, এই পোস্টে রাহেলার মামলার বিষয়টি তুলে ধরেছেন। রাইজিং ভয়েসের একটা প্রকল্পের অংশ বাংলাদেশের চমৎকার একটা টিম “নারীজীবন“ও এ বিষয়টি তুলে ধরে

মামলাটিকে সামনে এগিয়ে নিতে আদালতের উপরে চাপ প্রয়োগ করার জন্য বাংলা ব্লগারদের এই চলমান প্রচেষ্টা প্রচার মাধ্যমের নজর কাড়ে এবং ক্রমশ: প্রতিবেদন এবং টিভি রিপোর্ট প্রচার হতে থাকে। শেষপর্যন্ত ২০০৮ এর জানুয়ারী মাসে মামলাটি পুনরায় চালু হয় এবং এপ্রিল মাসে হারিয়ে যাওয়া নথিপত্র আশ্চর্য্যজনকভাবে খুঁজে পাওয়া যায়। ব্লগার, এমএসএম, রাজনৈতিক কর্মী এবং বুদ্ধিজীবিদের অভিনন্দন। তদন্তকারী কর্মকর্তারা পরবর্তীতে দাবী করেছেন যে নথিপত্র ‘সবসময় সেখানে ছিল'। বলার অপেক্ষা রাখে না যে বিচারের জন্য যুদ্ধ এখনও একটা দীর্ঘমেয়াদী সংগ্রাম। গুজব শোনা যাচ্ছে যে এই মামলা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এবং মুখ্য প্রত্যক্ষদর্শীরা অসহযোগিতা করছে। মিডিয়া প্রতিবেদনে [বাংলাতে] দেখুন প্রমাণ সংক্রান্ত নথিপত্র খুঁজে পাওয়া নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ।

কিন্তু ব্লগাররা ছেড়ে দিচ্ছেন না। মানুষের স্মৃতিতে রাহেলাকে সজীব রাখার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে, যেন অন্যায়কারীকে আইন ও বিচারের সম্মুখীন করা যায়, যদিও দেরী হয়ে গেছে, কিন্তু রাহেলা লিমা আখতারকে বঞ্চিত করা হয় নাই। সাম্প্রতিক একটা টিভি সাক্ষাৎকারে সামহোয়ারইনের আরিল্ড ক্লোকারহাগ এবং বাংলাদেশের একজন সম্মানিত শিক্ষাবিদ ও লেখক প্রফেসর মুহাম্মদ জাফর ইকবাল বিষয়টির কথা বারবার উল্লেখ করেন।

Exit mobile version