অপ্রগতিশীল চর্চা আমদানি: গণমাধ্যম, সাংবাদিক ও ব্লগারদের উপর কিরগিজ রাষ্ট্রের আক্রমণ

সাংবাদিকরা অসংখ্য অভিযোগ, লাঞ্ছনা ও আইনি প্রক্রিয়ার সম্মুখীন হয়েছে

তেমিরভ লাইভ অনুসন্ধানী গণমাধ্যম চ্যানেলের প্রধান বোলত তেমিরভের (বামে) বিচার চলছে। আযাত্তিকের ইউটিউব চ্যানেল থেকে নেওয়া পর্দাছবি। ন্যায্য ব্যবহার

কিরগিজ সরকারের রাশিয়া থেকে আমদানি করা অপ্রগতিশীল চর্চায় সৃষ্ট পরিবর্তনগুলি জনজীবনসহ গণমাধ্যম, সাংবাদিক ও ব্লগারদের কর্মকাণ্ডকে প্রভাবিত করেছে।

কিরগিজস্তানে ২০২০ সালের ৫ অক্টোবর তারিখে আগের দিনের সংসদীয় নির্বাচনের অন্যায্য বিবেচিত ফলাফলের প্রতিক্রিয়ায় বিক্ষোভ শুরু হওয়ার ফলে নতুন সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়ে সাদির জাপারভ ক্ষমতায় আসেন। বিশেষ করে গণমাধ্যম, ব্লগার ও সাংবাদিকদের উপর রাষ্ট্রীয় আক্রমণের পর কঠোর স্বৈরাচারী পদক্ষেপ নেওয়া হয় যা কয়েক দশক ধরে মধ্য এশিয়ার গণতন্ত্রের “দ্বীপ” দেশটিতে বরং অস্বাভাবিক ঘটনা।

কপি ও পেস্ট: মিথ্যা তথ্য থেকে সুরক্ষার আইন

রাশিয়ার সাংবাদিকরা যেমন উল্লেখ করেছে ভ্লাদিমির পুতিন ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে গণমাধ্যমের ওপর চাপ ক্রমাগত বেড়েছে। গত তিন বছরে রাশিয়ায় সরকার বা রাষ্ট্রপতি পুতিনের সমালোচনাকারী সাংবাদিকদের নির্বিচারে আটক করা হয়েছে এবং সমালোচনাকারী সকল গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলিকে বিদেশী চর চিহ্নিত করে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

কিরগিজ সরকার বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং বিদেশী গণমাধ্য্মের কার্যক্রম সীমিত করার এই রুশ মডে্লে অনুপ্রাণিত হয়ে বিদেশী চরদের নিয়ে একটি আইনের প্রস্তাব করলেও সেটা গৃহীত হয়নি। কিরগিজ সরকারও ২০২১ সালের আগস্টে নতুন মিথ্যা তথ্য থেকে সুরক্ষার একটি আইন (নকলবিরোধী আইন নামেও পরিচিত) প্রবর্তন করে অনলাইন ক্ষেত্রকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। রাষ্ট্রপতির প্রশাসন ২০২২ সালের নভেম্বরে জনসাধারণের আলোচনার জন্যে “অ-রাষ্ট্রীয় অ-বাণিজ্যিক সংস্থা” বিষয়ক খসড়া আইন জারি করেছে। আইনটির উদ্দেশ্য হলো অ-রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের অবৈধ কার্যকলাপ থেকে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ রক্ষা করা। আইনটি গৃহীত হলে প্রসিকিউটর জেনারেলের কার্যালয় ও বিচার মন্ত্রণালয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের অর্থায়ন, ব্যয় ও অন্যান্য তথ্যের উৎস সম্পর্কিত অভ্যন্তরীণ নথিগুলিতে প্রবেশাধিকার লাভ করবে যা এই তথ্যের ভিত্তিতে তাদের আরো লক্ষ্যবস্তু করার সুযোগ দেবে।

গণমাধ্যম, সাংবাদিক ও ব্লগারদের ওপর আক্রমণ

সংস্কৃতি, তথ্য, খেলাধুলা ও যুব মন্ত্রণালয় (সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়) ২০২২ সালের অক্টোবরে আযাত্তিক বাটকেনে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে তাজিক ও কিরগিজ সংঘর্ষের বিষয়ে ইউরোপের অধিভুক্ত নাস্তোয়াশি ভ্রেম্যা থেকে অনিরপেক্ষ ও প্রতিবেদনে তাজিকদের পক্ষ নেওয়া অনিশ্চিত তথ্য পুনঃপ্রচার করেছে দাবি করে রেডিও মুক্ত ইউরোপ অধিভুক্ত আযাত্তিকের ওয়েবসাইট বন্ধ করে দেয়। অনেকেই বিশ্বাস করে যে বন্ধের আসল কারণ ছিল বিতর্কিত কেম্পির-আবাদ জলাধার বিষয়ে আযাত্তিকের একটি তদন্ত। জলাধার সম্পর্কে বিশদ তথ্যসহ তাদের দৈনন্দিন জীবনে সিদ্ধান্তের প্রভাব সম্পর্কে স্থানীয় উদ্বেগগুলি ভাগাভাগি করায় তদন্তটি সময়োপযোগী ও সমালোচনামূলক ছিল। কয়েক দিন পরে কিরগিজ প্রজাতন্ত্রের জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক রাষ্ট্রীয় কমিটির আদেশে আযাত্তিকের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়। প্রকাশনা হিসেবে আযাত্তিক আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ হয়ে যায়।

সরকারের আযাত্তিকের ওয়েবসাইট বন্ধ করার সিদ্ধান্ত ঘোষণার কিছুক্ষণ আগে সরকার সমর্থিত “সক্রিয় কর্মীদের” একটি গোষ্ঠী ১৩ অক্টোবর বিশকেকে আযাত্তিকের কার্যালয়ের কাছে একটি বিক্ষোভ করে। মুখ ঢাকা বিক্ষোভকারীরা ব্যানার নিয়ে অন্যান্য স্বাধীন গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান ক্লুপ ও ক্যাকটাসের মতো আযাত্তিকের অফিস বন্ধ করার দাবি জানায়। তারা ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে কিরগিজস্তানে তাজিক আক্রমণ এবং ২০১০ সালে কিরগিজস্তানের দক্ষিণে জুনের সংঘর্ষের সময় ভুল তথ্যের জন্যে আযাত্তিক, ক্লুপ ও ক্যাকটাসকে দায়ী করে। এছাড়াও, বিক্ষোভকারীরা এলজিবিটিকিউ+ পজিটিভ হওয়ার মতো অপ্রচলিত মূল্যবোধের প্রচারের বিষয়ে তাদের “নীতিমালা” নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল। কিরগিজ পার্লামেন্ট বিদেশী চরদের বিষয়ে আইন প্রণয়ন না করলে আযাত্তিকের ভবনটি পুড়িয়ে ফেলা হবে বলে বিক্ষোভের নেতা ইলিমবেক ইসরাইলভ হুমকি দেন। এছাড়াও ভাড়াটে ট্রলের সাহায্যে আযাত্তিককে অভিযুক্ত ও মানহানি করার চেষ্টা করা হয়। এই ব্যবহারকারীরা আযাত্তিকের সামাজিক গণমাধ্যমের পৃষ্ঠাগুলিতে (ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম এবং ইউটিউব) সংবাদ পোস্টে নেতিবাচক মন্তব্য করে।

এর আগে কর্তৃপক্ষ ২০২২ সালের আগস্টে গণমাধ্যম সংস্থা ২৪ কেজি’র ওয়েবসাইট দুই মাসের জন্যে অবরোধের চেষ্টা করে। ইন্টারনেট সরবরাহকারীদের কাছে তাদের চিঠিতে কর্তৃপক্ষ যে উপাদানটির ভিত্তিতে সংস্থাটির ওয়েবসাইট স্থগিত করা হয়েছে তা নির্দিষ্ট করেনি। শীঘ্রই ২৪ কেজি আনুষ্ঠানিক মন্তব্যের জন্যে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের কাছে গেলে তারা সরকারের এই সিদ্ধান্তটি বাতিলের কথা জানতে পারে।

আযাত্তিকের ওয়েবসাইট বন্ধ করা অনলাইন গণমাধ্যমের স্থান নিয়ন্ত্রণ এবং কিরগিজস্তানে স্বাধীন সাংবাদিকতাকে (বিশেষত, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা) আক্রমণ করার একটি প্রচেষ্টা। অতীতে কিরগিজ কর পরিষেবার প্রাক্তন উপ-প্রধান রাইমবেক মাত্রাইমভ সম্পর্কিত রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের স্কিমগুলির বিষয়ে (ওসিসিআরপি এবং ক্লুপের সাথে একত্রে পরিচালিত) আযাত্তিকের অনুসন্ধানী অংশগুলি সম্প্রদায়গুলির মধ্যে যে বিশাল অনুরণন তৈরি করে তা ২০২০ সালের অক্টোবরের বিক্ষোভে অবদান রেখে ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটায়।

আজ কিরগিজস্তানে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি এবং কিছু সাংবাদিক অসংখ্য অভিযোগ, হামলাআইনি প্রক্রিয়ার মুখোমুখি হয়েছে। একটি বিশিষ্ট সাম্প্রতিক মামলা তেমিরভ লাইভ অনুসন্ধানী গণমাধ্যম চ্যানেলের প্রধানের সাথে সম্পর্কিত। বোলত তেমিরভের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে মাদকদ্রব্য রাখার, কিরগিজ পাসপোর্ট অর্জন ও সীমান্ত অতিক্রমের অভিযোগ আনা হলেও জনসাধারণের চাপের মুখে তিনি বিচারে নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে মুক্তি পান। তবে নভেম্বরের শুরুতে রাষ্ট্রীয় কৌঁসুলি আদালতের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আবেদন করেছে। জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক রাষ্ট্রীয় কমিটির প্রধান কামচিবেক তাসিয়েভ এবং তার পরিবারের বিরুদ্ধে – বিশেষ করে তাদের দুর্নীতির পরিকল্পনা, রাষ্ট্রীয় ক্রয়ে তার কোম্পানির অংশগ্রহণ এবং অন্যান্য সম্পর্কে তদন্ত প্রকাশ করলে তেমিরভের নিপীড়ন শুরু হয়। আদালতের শুনানির অব্যবহিত পরে ২৩ নভেম্বরে বলত তেমিরভকে জোরপূর্বক কিরগিজস্তান থেকে রাশিয়ায় বহিষ্কার করা হয়

রাষ্ট্রপতি ও বর্তমান সরকারের সমালোচনার জন্যে বিভিন্ন কিরগিজ নিরাপত্তা বাহিনীর সেন্সর ও জিজ্ঞাসাবাদ করা ফেসবুক ও অন্যান্য সামাজিক গণমাধ্যম ব্যবহারকারীদের সংখ্যা আকাশচুম্বী। শুধু ২০২২ সালের শুরু থেকে সমালোচনামূলক গণমাধ্যম চ্যানেলগুলির সাথে সম্পর্কিতরাসহ সাতজন ব্লগারকে নিরাপত্তা বাহিনীগুলি সেন্সর ও জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। কিরগিজস্তানে ২০২২ সালের ২৩ থেকে ২৭ অক্টোবরের মধ্যে সুশীল সমাজের কর্মী, প্রাক্তন রাজনীতিবিদ ও ভারপ্রাপ্ত রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে আরেক দফা গ্রেপ্তার পরিচালনা করা হয়৷ ছয়জন নারীসহ মোট ২৭ জনকে তাদের বিচারের আগে দুই মাস ধরে গ্রেপ্তার করে রাখা হয়। সমালোচকরা তাদের সামাজিক গণমাধ্যম চ্যানেল এবং ১৫ অক্টোবর উজজেনে প্রকাশ্য সমাবেশ (কুরলতাই) আয়োজনের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত চুক্তি চুক্তি হিসেবে উজবেকিস্তানের কাছে কেম্পির-আবাদ জলাধার হস্তান্তরের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কথা বলে। প্রকাশনার সময় ১৬ জন বন্দী কারা্ন্তরালে ছিল। ফৌজদারি বিধি অনুযায়ী তাদের ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডাদেশ হতে পারে। এভাবে কিরগিজ সরকার ক্রমবর্ধমানভাবে মুক্ত গণমাধ্যমের উপর আক্রমণ এবং তার নিজস্ব জনগণের সামাজিক গণমাধ্যমের পোস্টগুলিকে সেন্সর, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের অধিকারকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে।

পরাধীনতা পর্যবেক্ষক থেকে আরো কিছুর জন্যে দয়া করে প্রকল্প পৃষ্ঠা দেখুন

 

 

Exit mobile version