বাংলাদেশের রেল সেবা উন্নত করতে এগিয়ে এসেছে একটি ফেসবুক গ্রুপ

রেলফ্যান ক্লাবের উদ্দেশ্য সবার রেলযাত্রাকে আরামদায়ক করা
ইতিহাসের এক অংশঃ বাংলাদেশে প্রথম ন্যারোগেজ রেললাইন এর যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৬ এ, রূপসা বাগেরহাট রুটে। ছবি রাজিব হোসেন এর। ছবিটি বাংলাদেশ রেলওয়ে ফ্যান পেজ থেকে নেওয়া ও অনুমতিক্রমে ব্যবহার করা হয়েছে।

ইতিহাসের এক অংশঃ বাংলাদেশে প্রথম ন্যারোগেজ রেললাইন এর যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৬ এ, রূপসা বাগেরহাট রুটে। ছবি রাজিব হোসেন এর। ছবিটি বাংলাদেশ রেলওয়ে ফ্যান পেজ থেকে নেওয়া ও অনুমতিক্রমে ব্যবহার করা হয়েছে।

বাংলাদেশে ভ্রমণের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হচ্ছে রেল। প্রায়শঃ একে “সাধারণ মানুষের এর বাহন” বলে উল্লেখ করা হয় কারণ আম জনতার যাতায়াতের এই বাহনটি তুলনামূলক সবচেয়ে সস্তা, পরিবেশ বান্ধব, আরামদায়ক ও নিরাপদ। বিনিয়োগ বৃদ্ধি সত্ত্বেও সেবার মান কমার কারণে বিগত পাঁচ বছরে রেল বিশাল পরিমাণ লোকসান গুনেছে ।

তবে রেল এর কয়েকজন ভক্ত ফেসবুকে একটি গ্রুপ ও পেজ ব্যবহার এর মাধ্যমে রেল সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য প্রদানের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে এবং এই পরিবহণ খাতে সেবার মান উন্নয়নে বিভিন্ন পরামর্শ প্রদান করছে।

সুন্দরপুর হচ্ছে কালীগঞ্জ ঝিনাইদহর এক নির্জন স্টেশন। ছবি শাহাজাদা ফারহান অধি এর। ফেসবুকে রেলওয়ে ফ্যান গ্রুপে প্রকাশিত এবং অনুমতিক্রমে ব্যবহার করা হয়েছে।

বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্ম ১৮৫৭ সালে, তখন এর নাম ছিল ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে। আর তখন এটি ছিল ব্রিটিশ ভারতের একটি অংশ। বাংলাদেশে মূলত ব্রড গেজ, মিটার গেজ এবং ন্যারো গেজ নামের তিন ধরণের রেল লাইন রয়েছে। থাকলেও, ন্যারো গেজের দৈর্ঘ্য অতি সামান্য এবং এটি বর্তমানে ব্যবহার হয় না। ২০১৮ সালের এক তথ্য অনুসারে বাংলাদেশ রেল এর মোট ২৯৫৫.৫৩ কিলোমিটার দৈর্ঘের লাইন রয়েছে আর এর নিয়মিত কর্মচারীর সংখ্যা ২৫০৮৩ জন।

বাংলাদেশ সরকার রেল এর মান উন্নত করার বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে যার মধ্যে রয়েছে রেললাইন সমূহকে আধুনিক করা, রেলইঞ্জিন ক্রয় করা, অনলাইন যাত্রীদের জন্য ডিজিটাল ইনফরমেশন সিস্টেম এবং অনলাইন এ টিকিট বিক্রির ব্যবস্থা। লোকসান কমিয়ে আনা ছাড়াও সরকারের লক্ষ্য সেই সমস্ত সমস্যার সমাধান করা যা রেল এর সেবার মান ও রেল সময়সূচীতে নানাবিধ বিঘ্ন ঘটাচ্ছে এবং নানাবিধ ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে — যেমন বিনা টিকেটের যাত্রী, ইঞ্জিন এর তেল চুরি, যথাযথ তথ্যের অভাব, রেলের জায়গা অবৈধ ভাবে দখল হয়ে যাওয়া, ঘুষ ও অব্যবস্থাপনা।

রেল “ভক্ত” ফেসবুক গ্রুপ এর উত্থান

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক এর একটি গ্রুপ বাংলাদেশে রেলযাত্রায় ভিন্ন মাত্রা প্রদান করছে। রেলওয়েতে একসময় কর্মরত কর্মকর্তা রোকনুজ্জামান রোকন ২০০৮ সালে বাংলাদেশ রেলওয়ে ফ্যান গ্রুপ এর প্রতিষ্ঠা করেন, আর এখন বেশ কয়েকজন এ্যাডমিন এই গ্রুপের দায়িত্ব পালন করছে। ওয়েব চ্যাট এর মাধ্যমে গ্লোবাল ভয়েসেস রোকন এর সাথে কথা বলেছে এবং তিনি জানিয়েছে প্রথমে রেল সংক্রান্ত আবেগের গল্প বলার মধ্যে দিয়ে এই পেজ যাত্রা শুরু করে, যেখানে রেল এর ছবি, ইতিহাস এবং ভ্রমণ ছিল মূল বিষয়। বর্তমানে এই প্রাইভেট ফেসবুক গ্রুপ এর ১ লক্ষ ৫০ হাজার এর বেশী সদস্য রয়েছে। এছাড়াও এই গ্রুপের একটি পাবলিক পেজ রয়েছে যেখানে ৫৬ হাজারের বেশি সদস্য রয়েছে। সদস্য নন এমন যে কেউ এই পেইজে পোস্ট করতে পারে এবং পেইজ/গ্রুপের যে কোন বিষয়ে সাড়া প্রদান করতে পারে।

বাংলাদেশ রেলওয়ে ফ্যান গ্রুপ । বাংলাদেশ রেলওয়ে ফ্যান গ্রুপ এর ফেসবুক পাতার স্ক্রিনশট ।

এই পেজ রেলওয়ের নিজস্ব পেজ না হলেও রেলযাত্রা সম্বন্ধে বিভিন্ন ধরণের অনুসন্ধান এর একটি নির্ভরযোগ সুত্র হয়ে উঠেছে এই পাতা। এখানে যে জানতে পারবে ট্রেন দেরিতে আসছে কিনা, এখানে সেবার মান ও বিভিন্ন অনিয়ম নিয়ে অভিযোগ করে অনেকে। এখানে রেলযাত্রার বিভিন্ন টিপস জানতে চায় কেউ কেউ, আবার অনেকে ছবি শেয়ার করে। কেউ আবার ভিন্ন ধরনের প্রশ্ন করে যেমন ট্রেন অমুক ট্রেন এখন কোথায় অবস্থান করছে, টিকেট অনুযায়ী অমুক ট্রেনের অমুক বগি কোন দিকে?

বাংলাদেশ সরকার একটি এ্যাপ চালু করেছে যার নাম হচ্ছে বিডি ট্রেন ট্র্যাকার এবং রেল এর নিজস্ব এক ফেসবুক পাতা রয়েছে যেখানে রেল সংক্রান্ত বিভিন্ন অফিশিয়াল তথ্য তুলে ধরা হয়। তবে অনেক ফেসবুক ব্যবহারকারী বাংলাদেশ রেলওয়ে ফ্যান গ্রুপে রেল সংক্রান্ত প্রশ্ন করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। এই গ্রুপের অন্যতম এ্যাডমিন শাহাবুদ্দিন আহমেদ জানান, এখানে প্রশ্ন করলে সাথে সাথে সে প্রশ্নের উত্তর এবং হালনাগাদ তথ্য প্রদান করার চেষ্টা করা হয়।

বাংলাদেশ রেলওয়ের ওয়েবসাইট সবসময় রেল এর গুরুত্বপূর্ণ ও হালনাগাদ সংবাদ প্রদান করে না। তবে রেলফ্যান গ্রুপ সবসময় সেটি করার চেষ্টা করে যেমন ফ্যান গ্রুপে এ্যাডমিন শাহাবুদ্দিন আহমেদ এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরেছেনঃ

ক্যান্সার রোগী রেলওয়ে তে ভ্রমণের সময় বিশেষ রেয়াতী ভাড়ায় টিকেট পেতে পারেন। শুধু তিনি নন, তার সঙ্গে একজন এ্যাটেন্ডেন্ট ও নিতে পারবেন বিশেষ রেয়াতী ভাড়ায়। প্রয়োজনে আপনার নিকটস্থ স্টেশন মাস্টার এর সাথে যোগাযোগ করতে হবে।
তথ্যসূত্র সহায়তা: Maksudul Alam ভাই।

পাথর ছোঁড়া নামের মৃত্যুর খেলা

এই গ্রুপের কিছু তথ্য বেশ কিছু ভয়াবহ দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সাহায্য করছে বিশেষ করে তারা বেশ কিছু সমসাময়িক বিষয় তুলে ধরেছে। এর এক উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হচ্ছে ট্রেনে পাথর ছোড়ার মত ঘটনা যা বিগত দশকে রেলের জন্য ভীতিকর ও ভীষণ ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুসারে বাংলাদেশে রেল দেশের ২০ টি স্পটকে চিহ্নিত করেছে যেখানে বছরে গড়ে ১৫০টির মত পাথর ছোড়ার ঘটনা ঘটে, আর এই সকল পাথরের আঘাতে অনেক যাত্রীর আহত এমনকি নিহত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। প্রতি বছর রেলওয়ে পাথরের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া বগির দরজা ও জানালা মেরামতে বিশাল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে।

এটা কোন ছেলেখেলা নয়। এটি নিছক এক হত্যাকাণ্ড। চলন্ত ট্রেনে পাথর ছোঁড়ার বিরুদ্ধে প্রচারণায় এই পোস্টার ব্যবহার করা হয়েছে। ছবি মোহাম্মদ রাগিব জামান এর। রেলওয়ে ফ্যান গ্রুপে পোস্ট করা এই ছবিটি অনুমতিক্রমে ব্যবহার করা হয়েছে।

রেল মন্ত্রনালয় এর এক কর্মকর্তার মতে বলা কঠিন কেন চলন্ত রেলে পাথর মারা হয়, তবে অনেক সময় দুষ্টু ছেলেরা রেলে পাথর ছোড়ে আবার অনেক সময় অনেক বাস কর্মচারীরা রেলে পাথর ছুড়ে থাকে, যারা মনে করে রেলের কারনে বাস এর যাত্রী কমে যাচ্ছে। উল্লেখ্য, রেলওয়ের রুট বৃদ্ধি ও সেবার মান বৃদ্ধির কারণে অনেকেই আরামদায়ক যাত্রার জন্য রেলকে বেছে নিচ্ছে।

শাহাজাদা ফারহান অধি ১৩ ফেব্রিয়ারি,২০২১ তারিখে এ রকম একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেন সাথে প্রামাণ্য ছবিও যুক্ত করেনঃ

ট্রেনের ছাদ থেকে পাথর। নিক্ষেপ অল্পের জন্য রক্ষা পেলো ড্রাইভার
আজ দুপুর ১২:০৬ ছয় মিনিটে কিশোরগঞ্জ এক্সপ্রেস এর ছাদ থেকে পাথর নিক্ষেপ করে দুইটি ছেলে,
স্থান নিমতলী রেলগেট টঙ্গী।
[..]
রেলপুলিশ চাইলে ইমিডিয়েড তাদের এখন কিশোরগঞ্জ স্টেশন থেকে আটক করতে পারেন।

রেলওয়ে ফ্যান ক্লাব শিশু ও কিশোরদের মাঝে রেল এ পাথর নিক্ষেপের কুফল সম্বন্ধে এক প্রচারণা চালায়। ছবি শোভন হোসেন এর। বাংলাদেশ রেলওয়ে ফ্যান গ্রুপে পোস্ট করা এই ছবিটি অনুমতিক্রমে ব্যবহার করা হয়েছে।

এই ফ্যান গ্রুপ চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাচ্ছে। এই গ্রুপের অন্যতম সদস্য শোভন হোসেন এ রকম এক প্রচারণা সম্বন্ধে লেখা ও ছবির এ্যালবাম পোস্ট করে, যেখানে গ্রুপের কার্যক্রম উঠে এসেছেঃ

সামাজিক দায়বদ্ধতা হতে আমরা গিয়েছি গতকাল ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায়, দুপুর হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত পাথর নিক্ষেপের কুফল সম্পর্কে প্রচারণা চালাই,আমরা ২টি আলাদা টিমে বিভক্ত হয়ে প্রচারণা শুরু করি।

এই প্রথমবারের মত আমরা শিশু বাচ্চা, উঠতি বয়সী ছেলে মেয়েদের সাথে খুব ই বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণে কথা বলে তাদের মোটিভেট করি,তারাও আমাদের কথা দেয় কখনো ই ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ করবে না এবং তাদের বন্ধুবান্ধব সহ যাকেই দেখবে তাকেই তারা বিরত করবে এই খারাপ কাজ হতে।

গ্রুপের সদস্যরা যে সব ছবি পোস্ট করে তার উদাহরণস্বরূপ কয়েকটি নীচে তুলে ধরা হয়েছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি শাটল ট্রেনে ছাত্রছাত্রীরা গ্রাফিতি এঁকেছেন। ছবি জামান মুহাম্মদ এর। রেলওয়ে ফ্যান গ্রুপ হতে পাওয়া এই ছবিটি অনুমতিক্রমে ব্যবহার করা হয়েছে।

নরসিংদী জেলার খানাবাড়ি রেলস্টেশন এক আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এই রেলস্টেশনে সন্ধ্যায় নিয়মিত গানের আসর বসে। ছবি মোঃ কামরুজ্জামান সোহেল এর। বাংলাদেশ রেলওয়ে ফ্যান গ্রুপ এ পোস্ট করা ছবিটি অনুমতিক্রমে ব্যবহার করা হয়েছে।

বাংলাদেশ রেলওয়ের রয়েছে নিজস্ব ফেরি, তবে অনেক বেশী রেলব্রীজ তৈরি হওয়ার ফলে ফেরি দিয়ে যাত্রী পারাপারের আর প্রয়োজন হয় না বললেই চলে। ছবি আকিবুল হাসান নিজাম এর। বাংলাদেশ রেলওয়ে ফ্যান গ্রুপে পোস্ট করা এই ছবিটি অনুমতিক্রমে ব্যবহার করা হয়েছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শাটল ট্রেনটিতে আর যাত্রী ধারনের জায়গা নেই, এমন কী এর রেল ইঞ্জিনও যাত্রীতে ভরে গেছে। ছবি মোমিনুল ইসলাম শিমুলের। বাংলাদেশ রেলওয়ে ফ্যান গ্রুপে পোস্ট করা এই ছবিটি অনুমতিক্রমে ব্যবহার করা হয়েছে।

Exit mobile version