পদ্মা সেতু তৈরি করতে কাটা মাথা লাগবে গুজব ছড়ানোর কারণে ৮ জন গ্রেফতার

গুজব ছড়ানো বাংলাদেশের আইনে একটি অপরাধ
বিশ্বের সবচেয়ে বিশাল এবং প্রমত্তা নদীগুলোর একটি পদ্মা। গঙ্গা আর ব্রহ্মপুত্র- দক্ষিণ এশিয়ার এই দুটি বিশাল এবং দীর্ঘ নদীর অববাহিকার পানি এই পদ্মা দিয়েই বঙ্গোপসাগরে যায়। তার বুকেই চলছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ। ছবি উইকিমিডিয়া কমন্স থেকে আফজাল হোসাইনের। ক্রিয়েটিভ কমন্স লাইসেন্সের আওতায় প্রকাশিত -সিসি বাই ৪.০

বিশ্বের সবচেয়ে বিশাল এবং প্রমত্তা নদীগুলোর একটি পদ্মা। গঙ্গা আর ব্রহ্মপুত্র- দক্ষিণ এশিয়ার এই দুটি বিশাল এবং দীর্ঘ নদীর অববাহিকার পানি এই পদ্মা দিয়েই বঙ্গোপসাগরে যায়। তার বুকেই চলছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ। ছবি উইকিমিডিয়া কমন্স থেকে আফজাল হোসাইনের। ক্রিয়েটিভ কমন্স লাইসেন্সের আওতায় প্রকাশিত -সিসি বাই ৪.০

৬.১ কিমি লম্বা বাংলাদেশের বৃহত্তম সেতু পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ ২০২০ সালের শেষে সম্পন্ন হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এটি প্রমত্ত পদ্মা নদীর উপর দিয়ে বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চলের সাথে উত্তর এবং পূর্বের অঞ্চল এর সাথে সংযোগ করবে। এই সেতুটি বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চলের অর্থনৈতিক চিত্র বদলে দেবে

কিন্তু এতোসব উন্নয়নের গল্পের পেছনে সাম্প্রতিক একটি “গুজব” ছড়িয়ে যাবার কারণে ইতিমধ্যে আটজন গ্রেফতার হয়েছে এবং দুজনের মৃত্যু হয়েছে

‘মানুষের মাথা লাগবে সেতুর জন্যে’ এই গুজব

সম্প্রতি বাংলাদেশে পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজে মানুষের কাটা মাথা লাগবে বলে গুজব ছড়িয়ে পড়েছে।

পাশাপাশি সেতু নির্মাণের জন্য ঐ অঞ্চলের কাছে বেশ কয়েকটি এলাকায় বিভিন্ন বয়সী মানুষ অপহৃত হচ্ছেন বলে গুজব ছড়িয়ে পড়ে। ইতোমধ্যে গুজবকে কেন্দ্র করে ‘ছেলে ধরা’ সন্দেহে ঢাকার মোহাম্মদপুর আর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে দুইজনকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনাও ঘটেছে। এছাড়াও বেশ কিছু জায়গায় ছেলে ধরা সন্দেহে কতিপয় ব্যক্তিকে গণপিটুনি দিয়েছে স্থানীয় জনতা। এক সংবাদ সম্মিলনে লক্ষ্মীপুরের পুলিশ সুপার জানিয়েছেনঃ

যাদেরকে ‘ছেলে ধরা’ সন্দেহে আটক করা হচ্ছে পরবর্তীতে জিজ্ঞাসাবাদে দেখা যায় তারা কেউ মানসিক রোগী বা কেউ ভিখারী। ‘ছেলে ধরা’ খবরটি একটি নিছক গুজব।

বাংলাদেশের ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট ২০১৮ অনুযায়ী ইলেক্ট্রনিক ফর্মে গুজব ছড়ালে ৩ লাখ টাকা জরিমানা বা তিন বছরের জেল বা উভয় দণ্ডেই দণ্ডিত হতে পারে কেউ। এপর্যন্ত ফেসবুকে সেতুর জন্যে “কাটা মাথা” বা “অপহরণ” সংক্রান্ত গুজব ছড়ানোর জন্যে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ৮ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

বাংলাদেশে গুজব নতুন বিষয় নয়, যুগ যুগ ধরে চলে আসা কুসংস্কার

এদিকে এ ধরনের গুজবের পিছনে অনেকেই পদ্মা সেতু নির্মাণের চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের কুসংস্কারকে দায়ী করেছেন। ২০১৫ সালের এক রিপোর্ট অনুযায়ী সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের সময় প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা নদীরে পশুর (গরু ও ছাগল) রক্ত ঢেলেছিলেন। তাদের বিশ্বাস, বড় কাজের শুরুতে পশু উৎসর্গের মাধ্যমে স্রষ্টার সন্তুষ্টি লাভ করা যায়, এড়ানো যায় বড় দুর্ঘটনা। সেই সময়কার পশুর রক্ত ঢালার ছবি দিয়ে রটনাকারীরা মানুষের কাটা মাথার গুজব ছড়াচ্ছেন।

বড় কোনো স্থাপনার নির্মাণের সময় বাংলাদেশে ‘নরবলি’ বা ‘মানুষের কাটা মাথা’ লাগার গুজব নতুন নয়। এ ধরনের গুজব অনেক আগেই এ থেকেই এ অঞ্চলে প্রচলিত আছে। এইচআর সানভি আহমেদ ৭০ দশকের শেষদিকে তার ছোটবেলায় ঢাকার কাছে কাঁচপুর ব্রিজ নির্মাণের সময়কার গুজবের ঘটনা উল্লেখ করেছেন:

স্কুলে পড়তাম তখন।
এক বিকেলে ৪/৫ জন বন্ধু মিলে খুব চিন্তিত। কাঁচপুর ব্রিজ তৈরি হচ্ছে। এখন ব্রিজের জোড়া শক্তপোক্ত করতে মানুষের হাড় প্রয়োজন। যেটা সবসময়ই লাগে বড়বড় সেতু বানাতে। প্রায় ৫০০ মানুষের হাড়। আর এই হাড় সংগ্রহের জন্য মূলত শিশুদেরকেই টার্গেট করা হচ্ছে। স্কুলেস্কুলে কাফনের সাদা কাপড়সহ চিঠি যাচ্ছে। আমাদের স্কুলেও চিঠি এসেছে। শিক্ষকরা প্রতিদিন ২/১ জন করে পাঠিয়ে দিচ্ছে বাচ্চাদেরকে সেতুওয়ালাদের কাছে। এমতাবস্থায় খুব চিন্তিত আমরা। খেলাধুলা বাদ দিয়ে চিন্তা করছি। আমাদেরকেও কিনা পাঠিয়ে দেয়! রাতে ঘুম বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। ছোট মাথা, অনেক বড় দুঃশ্চিন্তা।

২০১০ সালে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর উপর শাহ আমানত ব্রিজের নির্মাণ কাজ সমাপ্তির সময়েও এইরকম গুজব ছড়িয়ে পরেছিল

খরস্রোতা নদীর ওপর বাঁধ ও সেতু নির্মাণের আগে কিংবা ঘরবাড়ি তৈরির আগে অশুভশক্তিকে তুষ্ট করতে ‘নরবলি’ দেয়ার মিথ প্রাগৈতিহাসিক কালের। হিন্দু পুরানেও নরমেধ যজ্ঞের উল্লেখ পাওয়া যায়। ৫ হাজার বছর আগে পূণ্ড্রের কৃষিভিত্তিক সমাজে নরবলির প্রচলন ছিল। সে সময়ে তারা ফসলের দেবীকে তুষ্ট করতে নরবলির রক্ত ছড়িয়ে দিতো ক্ষেতে।

বাংলাদেশের দিনাজপুর জেলায় অবস্থিত রামসাগর দীঘি। ১৭৫০ সালের দিকে এটি খনন করা হয়। কথিত আছে, যুবরাজ রামনাথ দীঘিতে প্রাণ বিসর্জন দিলে তবেই দীঘি পানিতে ভরে যায়। ছবি তুলেছেন সেলিম খন্দকার। সিসি বাই- এসএ ৪.০ লাইসেন্সের আওতায় প্রকাশিত।

বিবিসি বাংলার সাথে এক সাক্ষাৎকারে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের অধ্যাপক সুস্মিতা চক্রবর্তী প্রচলিত এসব কিংবদন্তীর প্রতি ইঙ্গিত করে জানিয়েছেন:

প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে যেসব গল্প শুনে আসে, কোনো ধরণের যাচাই ছাড়া সেগুলো বিশ্বাস করার প্রবণতার কারণেই এই প্রযুক্তির যুগেও সেসব গল্প সত্যি বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে।

বাংলাদেশ সরকার এই গুজব ছড়ানো রোধ করতে বদ্ধপরিকর এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন যারা গুজব ছড়াচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে সরকার কঠোর হবে।

গুজব রোধে সচেতনতা

পদ্মা ব্রিজ কর্তৃপক্ষ গত ৯ই জুলাই একটি বার্তা প্রকাশ করে এই সব গুজব ভিত্তিহীন বলে জানিয়েছে। তারা বলেছে স্বার্থান্বেষী মহল এইসব মিথ্যা গুজব প্রচার করে যাচ্ছে এবং বিজ্ঞজনেরা জনগণকে গুজবে কান না দিয়ে সঠিক তথ্য সম্পর্কে অবগত থাকতে বলেছে।

Exit mobile version