পুরোনো ছবিতে ফিরে এলো ঢাকা’র মজার সব স্মৃতি

Topkhana Road, Press Club Area, Dhaka (1965). Photographer- Roger Gwynn. Photo courtesy: Bangladesh Old Photo Archive.

তোপখানা রোড, প্রেসক্লাব এলাকা। ছবি তুলেছেন রজার গোয়েইন। বাংলাদেশ ওল্ড ফটো আর্কাইভের ফেসবুক পেইজ থেকে নেয়া হয়েছে।

একটি শহর ৫০ বছরের মধ্যে অবিশ্বাস্যভাবে কতটা পরিবর্তন হতে পারে! উদাহরণ হিসেবে আমাদের ঢাকা শহরের কথাই ধরুন। বর্তমানে এটি পৃথিবীর বৃহত্তম শহরগুলোর মধ্যে একটি। কিন্তু ৫০ বছর আগের শহরের ছবি দেখলে আপনার বিশ্বাসই হবে না!

ষাটের দশকে ব্রিটিশ চিত্রগ্রাহক রজার গোয়েইন বাংলাদেশে এসেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল দাতব্য প্রতিষ্ঠান সার্ভিস সিভিল ইন্টারন্যাশনালের হয়ে স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করা। সেই কাজ করতে গিয়ে তিনি দেশটির বিভিন্ন প্রান্তে সফর করেন। তিনি যেখানে যেখানে গেছেন, সেখানকার ছবি তুলেছেন। তার তোলা সেই সময়কার কিছু ছবি সম্প্রতি বাংলাদেশ ওল্ড ফটো আর্কাইভ নামের একটি ফেইসবুক পেইজে পুনর্প্রকাশিত হয়েছে। আর প্রকাশ হওয়ার পরেই ছবিগুলো ব্যাপক ভাইরাল হয়।

বাংলাদেশ ওল্ড ফটো আর্কাইভ ফেসবুক পেইজের যাত্রা শুরু হয় ২৪ আগস্ট ২০১১ সালে। বর্তমানে ফ্যান সংখ্যা ১৭১,০০০ এর বেশি। পেইজটিতে ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে ৯০’র দশক পর্যন্ত সময়ের অসংখ্য ছবি আপলোড করা হয়েছে। এই আর্কাইভের মাধ্যমে চোখের সামনে ঢাকার ইতিহাস, ঐতিহ্য আর ১৩০ বছরের চলমান জীবনের প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে যেন।

ফেইসবুকে রজার গোয়েইনের তোলা ছবিগুলো দেখে ঢাকাবাসী অনেকেই স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েছেন। তারা সবাই সেই সময়ের স্মৃতি রোমন্থন করেছেন। কেউ কেউ সেই সময়ে ফিরে যাওয়ার আকুতি প্রকাশ করেছেন।

ভিক্টোরিয়া পার্ক এলাকা। সদরঘাট, ঢাকা (১৯৬৭)। ছবি তুলেছেন রজার গোয়েইন। বাংলাদেশ ওল্ড ফটো আর্কাইভের ফেসবুক পেইজ থেকে নেয়া হয়েছে।

ষাটের দশকের ভিক্টোরিয়া পার্কের ছবি দেখে ওমর সেলিম শের লিখেছেন:

Very nostalgic. I was a student in old Dhaka school and used to visit this park in mid 60s. In 1967 I was 17 years old, when this photograph was taken. Vivid memory of Victoria Park.

পুরোনো দিনের স্মৃতি খুব মনে পড়লো! আমি তখন ঢাকা স্কুলে পড়তাম। ষাটের দশকের মাঝামাঝিতে প্রায়ই পার্কটিতে বেড়াতে যেতাম। পার্কের ছবিটি তোলা হয়েছে ১৯৬৭ সালে। আমার বয়স তখন ১৭। সেই সময়ের ভিক্টোরিয়া পার্কের ছবি স্মৃতিতে উজ্জ্বল।

নিউমার্কেটের ঠেলাগাড়ির চালকেরা। ঢাকা (১৯৬৫)।ছবি তুলেছেন রজার গোয়েইন। বাংলাদেশ ওল্ড ফটো আর্কাইভের ফেসবুক পেইজ থেকে নেয়া হয়েছে।

নিউমার্কেটের সামনের রাস্তার ছবি যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ওয়াজির সাত্তারকে নিয়ে গেছে সেই স্বর্ণালি সময়ে। তিনি তখনকার সময়ের খাবারের সস্তা দামের স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন:

And one of the restaurants there used to serve special malai cha (Creamed Tea). We the students of Dacca College used to visit this restaurant in 1967-69 for that cha and special gosht-porota (Meat Paratha), The name of the eatery was Chittagong Restaurant. A cup of malai cha was 4 anas (25 Poishas).

এখানে একটি খাবারের দোকানে স্পেশাল মালাই চা পাওয়া যেত। ১৯৬৭-১৯৬৯ সালে আমরা ঢাকা কলেজের ছাত্র’রা চা আর গোস্ত-পরোটা খেতে সেখানে প্রায়ই যেতাম। খাবারের দোকানটির নাম ছিল চিটাগং রেস্টুরেন্ট। এক কাপ মালাই চা’র দাম ছিল চার আনা মাত্র!

মিরপুর রোড, নিউমার্কেট। ঢাকা (১৯৬৫)।ছবি তুলেছেন রজার গোয়েইন। বাংলাদেশ ওল্ড ফটো আর্কাইভের ফেসবুক পেইজ থেকে নেয়া হয়েছে।

এই ছবি বাদল হক-কে ছেলেবেলায় নিয়ে গেছে:

I use to walk these streets holding my father's hand to pick up his laundry from Lifa and have Kalojam (a type of sweet) from Moron Chand when I was a Todler. But some how I remember all those moments. I miss my father every second and praying for him.

ছোট্টবেলায় আমি আব্বার হাত ধরে এই রাস্তা দিয়ে প্রায়ই যেতাম। যাওয়ার পথে লিফা নামের একটি ধোপা’র দোকান থেকে ইস্ত্রি করা কাপড় নিতাম। আর মরণ চাঁদ থেকে নিতাম কালোজাম। সেই দিনগুলোর কথা আমার খুব মনে আছে। আব্বাকে খুব মিস করি। তার জন্য প্রার্থনা করি।

ডেমরা রোডের হরদেও গ্লাস ফ্যাক্টরি। ঢাকা (১৯৬৫)। ছবি তুলেছেন রজার গোয়েইন। বাংলাদেশ ওল্ড ফটো আর্কাইভের ফেসবুক পেইজ থেকে নেয়া হয়েছে।

হরদেও গ্লাস ফ্যাক্টরির ছবি দেখে রানাজয় গুপ্ত নস্টালজিক হয়ে পড়েছেন:

Interesting. Hardeo Glass Factory came up on land originally owned by my family at Tikatuli. I believe there was a ‘samadhimandir’ (memorial shrine) for my great-grandparents Sarat Chandra Gupta (after whom Sarat Gupta Road is named) and Manorama Gupta at a corner of the land. I am told the Rajdhani Supermarket later came up on the land; someone told me the samadhimandir still exists at a corner of the market.

চমৎকার। আমাদের পরিবারের হাত ধরে টিকাতুলিতে হরদেও গ্লাস ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আমার বিশ্বাস, ফ্যাক্টরির একপাশে আমার দাদা-দাদী শরৎ চন্দ্র গুপ্ত ও মনোরমা গুপ্তের সমাধি মন্দির রয়েছে। পরে এখানে রাজধানী সুপার মার্কেট প্রতিষ্ঠিত হয়। কেউ একজন আমাকে বলেছিলেন, মার্কেটের একপাশে এখনো সমাধি মন্দির রয়েছে।

শিশুরা বায়োস্কোপ দেখছে। পুরান ঢাকা, বাংলাদেশ (১৯৬০)। ছবি তুলেছেন রজার গোয়েইন। বাংলাদেশ ওল্ড ফটো আর্কাইভের ফেসবুক পেইজ থেকে নেয়া হয়েছে।

একসময় বায়োস্কোপ ছিল বিনোদনের মাধ্যম। এটি এখন হারিয়ে গেছে। বায়োস্কোপের ছবি দেখে সৈয়দ হারুন রশীদ লিখেছেন:

The nostalgic time of bygone era! … I could very much relate to these boys. The sight n thought of being able to enjoy this, out of heaven, thing called Bioscope. I wonder the intense feeling of euphoria this seemingly negligible thing could produced in us will ever part from our memory….

আহ্, কী চমৎকার সময়ই না ছিল তখন!… এই শিশুদের সাথে আমি খুব একাত্মতা অনুভব করি। সেই শব্দ, ছবি এখনো মনে গেঁথে আছে। আমরা একে বায়োস্কোপ বলতাম। আপাতদৃষ্টিতে এটিকে তুচ্ছ মনে হলেও এটি ছিল তীব্র আনন্দের একটি বস্তু। এটি আমাদের স্মৃতিময় জীবনের একটি অংশ…

ঢাকাকে এখন যানজটের শহর বলা হয়। কিন্তু ষাটের দশকে ঢাকা ছিল ছিমছাম একটি শহর। রুমি আফতাব লিখেছেন:

So beautiful that period was! now it's always remaining over crowded and loaded with so many different types vehicles gives us discomfort feelings, time consuming too!

কী সময়টাই না ছিল তখন! আর এখন চারদিকে এতো ভিড়-বাট্টা, এতো গাড়ি-ঘোড়া আমাদের অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই যানজটে অযথা সময় নষ্ট হয় শুধু।

ধানমন্ডি ২ নং রোড, ঢাকা (১৯৬৫)। ছবি তুলেছেন রজার গোয়েইন। বাংলাদেশ ওল্ড ফটো আর্কাইভের ফেসবুক পেইজ থেকে নেয়া হয়েছে।

ঢাকা শহরের চেহারা এখন অনেক বদলে গেছে। আগের সাথে মিলানো যায় না কিছুতেই। স্বর্গীয় জীবন লিখেছেন:

Hard to believe there was a big riverview. I grew up in rayer Bazar n mohammadpur area. Saw rayer Bazar and all the way Mohammadpur surrounded by extended burigongha river. There was a village used to call bochila,so much fun to go there by boat. It was a memory hardly I could remember fr 1982-86, left that area in 1987 and after 15 yrs later once I visited there was very shocking.. 15 yrs changes were huge, landmarks turned into different shapes couldn't even believe there was a river we were playing, swimming.. even all the way hazaribugh to kamrangir chor went by car.. unbelievable…

বিশ্বাস করাই যায় না এখান থেকে নদী দেখা যেত। রায়েরবাজার আর মোহাম্মদপুর এলাকায় আমি বড় হয়েছি। রায়েরবাজার আর মোহাম্মদপুর এলাকার চারদিকেই বুড়িগঙ্গা নদী ছিল। পাশেই একটা গ্রাম ছিল। আমরা বসিলা বলতাম। নৌকায় চড়ে সেখানে যেতে কী মজাটাই না হতো! আমি যে সময়টার কথা বলছি, সেটা ছিল ১৯৮২-৮৬ সাল। ১৯৮৭ সালে আমরা এই এলাকা ছেড়ে যাই। এর ১৫ বছর পরে আমি একবার সেখানে গিয়ে পুরোই অবাক হই। অনেক পরিবর্তন হয়েছে সেখানে। চেনা দৃশ্যপট বদলে গেছে। এখন কেউ বিশ্বাসই করবে না এখানে একসময় একটি নদী ছিল। আমরা নদীতে খেলতাম, গোসল করতাম। এমনকি এখন হাজারিবাগ থেকে কামরাঙ্গীচরে গাড়িতে করে যাওয়া যায়। অবিশ্বাস্য!

ঢাকার বর্তমান রূপ একটুও পছন্দ নয় সাঈদ রহমানের:

That's where I grew up and miss my childhood and feel like how good days were those. Those were the golden days of my loving city of Dacca not Dhaka.

এখানেই আমি বেড়ে উঠেছি। সেই সময়ের কথা খুব মনে পড়ে। আগে কী সুন্দর দিন না-ই ছিল! সেই সময়ের ঢাকা-ই আমার পছন্দ, এখনকার ঢাকা নয়।

ঢাকার আরো কিছু ছবি:

ভিস্তিওয়ালা, ওয়ারি, ঢাকা (১৯৬৫)। ছবি তুলেছেন রজার গোয়েইন। বাংলাদেশ ওল্ড ফটো আর্কাইভের ফেসবুক পেইজ থেকে নেয়া হয়েছে।

ভোরবেলার বাজার। তাজা মাছ বিক্রি হচ্ছে। ঢাকা (১৯৬০)। ছবি তুলেছেন রজার গোয়েইন। বাংলাদেশ ওল্ড ফটো আর্কাইভের ফেসবুক পেইজ থেকে নেয়া হয়েছে।

চায়ের দোকানে পত্রিকা পড়ছেন একজন। ঢাকা, বাংলাদেশ (১৯৬৫)। ছবি তুলেছেন রজার গোয়েইন। বাংলাদেশ ওল্ড ফটো আর্কাইভের ফেসবুক পেইজ থেকে নেয়া হয়েছে।

মেয়েরা মক্তব্যে কোরআন পাঠ করছে। ঢাকা (১৯৬০)। ছবি তুলেছেন রজার গোয়েইন। বাংলাদেশ ওল্ড ফটো আর্কাইভের ফেসবুক পেইজ থেকে নেয়া হয়েছে।

পুরো অ্যালবাম দেখুন এখানে।

রজার গোয়েইনের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে ছবিগুলো প্রকাশিত হয়েছে।
Exit mobile version