জাপানে মুখে কালো রং মাখার পদ্ধতি বর্ণবৈষম্য না সামাজিক মর্যাদার প্রতীক?

মোমোকুরো। ছবিটি উইকিপিডিয়ার সৌজন্যে পাওয়া।

সম্প্রতি জাপানের বিখ্যাত গানের দল র‌্যাটস অ্যান্ড স্টার এবং মোমোইরো ক্লোভার জেড তাদের মুখে কালো রং মেখে একটি জনপ্রিয় টেলিভিশন অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। আর এই ঘটনা জাপানজুড়ে বর্ণবাদের বিতর্ক উস্কে দিয়েছে।

১৯৭৭ সালে রাটস অ্যান্ড স্টারের প্রতিষ্ঠার শুরুর দিকে মুখে রং মাখার পদ্ধতিটিকে তারা ট্রেডমার্ক গ্রহণ করে। ডু উপ (আফ্রিকান-আমেরিকানদের প্রবর্তিত গানের একটি ধারা) প্রজেক্টের অংশ হিসেবে তারা এটা করে।

র‌্যাটস অ্যান্ড স্টার এবং মোমোইরো ক্লোভার জেড (মোমোকুরো) তাদের আগের কাজের সাথে সম্প্রতি গ্লাম মেটাল (হেভি মেটাল গানের একটি উপধারা) এর সমন্বয় সাধন করেছে। অনেকটা আমেরিকান ব্যান্ড কিস-এর মতো। এই গানের অন্যান্য দলগুলোর মতো তারাও কড়া মেকাপে হাজির হন। তবে র‌্যাটস অ্যান্ড স্টারের সাথে টিভি পর্দায় উপস্থিতিতে মোমোকুরো মেকাপ থিমে নতুনত্ব আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

অবশ্য মুখে কালি মেখে বিনোদন দেয়ার মতো লোক জাপানে খুব কমই আছে। তবে সামাজিক মিডিয়ার এই যুগে নিছক বিনোদনও জাপানের বাইরে কোনো কোনো ক্ষেত্রে জটিল হয়ে উঠতে পারে।

টাইমসের জাপানের সাবেক প্রধান প্রতিনিধি এবং নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর প্রতিবেদক হিরোকো তাবুচি বিনোদনের জন্য মুখে কালি মাখার ব্যাপারটি অনুপযুক্ত এবং বৈষম্যমূলক বলে উল্লেখ করেছেন।

বর্ণবৈষম্য নিয়ে জাপানে আলোচনা কেন জরুরি… আগামী মাসে প্রচারিতব্য টিভি অনুষ্ঠানের প্রিভিউ দেখেন।

তাবুচির মন্তব্য ৭০০ বারের বেশি রিটুইট হয়েছে। সেখানে মুখে কালো রং মাখার বিষয়টি বর্ণবৈষম্য হিসেবে দেখা হবে কিনা তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

টুইটারে কিছু মন্তব্যকারী এই বিষয় থেকে আমেরিকান ব্যাপার-স্যাপার মুছে ফেলে দিতে বলেছেন। কেননা, বর্ণবৈষম্যের অংশ হিসেবে জাপানে মুখে কালি মাখা হয় না। তাছাড়া বর্ণবৈষম্যের নিষ্ঠুর প্রথা সম্পর্কে বেশিরভাগ জাপানিই জানেন না।

তবে অন্য একজন টুইটার ব্যবহারকারী তাবুচির সাথে একমত পোষণ করেছেন। তিনি বলেছেন, জ্ঞাত কিংবা অজ্ঞাতসারে যাই হোক না কেন, জাপানে মুখে কালি মাখা বর্ণবৈষম্য হিসেবেই দেখা হবে।

@হিরোকো তাবুচি, আমি একমত। না জেনে বর্ণবিদ্বেষী আচরণ করা একটি বড় সমস্যা। মানুষ পরিস্থিতির কারণে বর্ণবাদী হয়ে উঠে না…

@হিরোকো তাবুচি, এটা অবশ্য তাদের বিশেষাধিকার খুঁজে দেখার ব্যাপার নয়, এমনকি নিজের জাতি বা সংস্কৃতির বাইরে গিয়ে অভিজ্ঞতা লাভের ব্যাপার নয়।

অন্যরা অবশ্য এর সাথে দ্বিমত পোষণ করেছেন:

@হিরোকো তাবুচি, আমি বুঝতে চেষ্টা করলাম, বিদ্বেষী না হয়েও এটা কীভাবে বর্ণবাদী আচরণ হয়। উদ্ধত, তা অবশ্য ঠিক। বর্ণবিদ্বেষী?…

অন্যরা যুক্তি দেখিয়েছেন যে, জাপানে মুখে কালি মেখে বিনোদন দেয়ার বিষয়টি বর্ণবিদ্বেষী নয়, বরং কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের প্রতি সম্মান দেখানো।

টুইটার ব্যবহারকারী ই=এমসিজেড বলেছেন, জাপানীদের চিন্তাভাবনা অনুসারে নিজের চামড়ায় কালি মাখার বিষয়টি বর্ণবাদী আচরণ নয়। তবে এটাকে বিশুদ্ধ স্তবগীতি হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।

জাপানি কনটেক্সটে আপনি “মুখে কালি মাখার বিষয়টিকে বর্ণবিদ্বেষ” বলতে পারেন না। আমরা ককেসিয়ান নই। এশিয়ানরা যখন সানটানের (গৌরবর্ণের) মতো হয়, তখন আমরা তাদের মতো গৌর রূপ লাভ করি (শেইগেরু মাটসুজাকি অথবা ইয়ামানবা মেয়ের কথা চিন্তা করুন)। তাই জাপানিরা যখন কোনো কৃষ্ণাঙ্গদের গান পরিবেশন করতে চায়, তখন তারা বাইরে যায়, সূর্যের সাথে থাকে। রাটস অ্যান্ড স্টার এবং মোমোকুরো কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনপূর্বক এটাই করেছে। (একইভাবে) ১৯৯০ সাল থেকে গানগুরো প্রবণতাও চলে আসছে, যা কখনো বর্ণবিদ্বেষ হিসেবে বিবেচিত হয়নি।

গানগুরো। ছবিটি ফ্লিকার ব্যবহারকারী ট্রেইটলিন বুর্কির সৌজন্যে পাওয়া। সিসি বিওয়াই ২.০

অন্য একজন টুইটার ব্যবহারকারী খুব যৌক্তিকভাবেই মুখে কালি মাখার ব্যাপারটিকে শ্রদ্ধাঞ্জলী হিসেবে দেখার সমালোচনা করেছেন:

মুখে কালি মাখার কারণে মোমোকুরো বর্ণবিদ্বেষী হয়ে গেছে! তারা যদি জ্ঞাতসারে এই কাজ করে নাও থাকেন, তাহলেও এটা কোনো পার্থক্য তৈরি করে না। এটা সবসময়ে শ্রদ্ধার ব্যাপার নয়। একটা উদাহরণ দিই, যদি একজন শ্বেতাঙ্গ কিংবা কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ মুখে হলুদ রং মেখে এনকা [জাপানিজ কান্ট্রি এবং পশ্চিমা সংগীত] গাইতে শুরু করে, আপনি তাকে “শিল্প” হিসেবে মেনে নিবেন না।

এর উত্তরে টুইটার ব্যবহারকারী মাইকেল এ বলেছেন, মুখে কালি মাখার ব্যাপারটি জাপানের বাইরে বর্ণবিদ্বেষ হিসেবে দেখা হলে কিচ্ছু করার নেই।

আপনি যদি তাদের সংগীত পরিবেশনের শৈলী পুরোটা দেখে থাকেন, আমার ধারনা, আপনার কাছে এটা কপট মনে হবে না। বরং র‌্যাটস অ্যান্ড স্টারের মুখে কালি মাখার পদ্ধতিটিকে কৃষ্ণাঙ্গ বিনোদন দানকারীদের প্রতি শ্রদ্ধা হিসেবেই মনে হবে।

মোমোকুরো সম্প্রতি মুখে পেইন্ট করা নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে। তারা যখন মুখে কালি মেখে র‌্যাটস অ্যান্ড স্টারের সাথে উপস্থিত হলো, তখন তারা কস্টিউমপ্লে’র সাথেই জুড়ে গেল।

এটি যে বর্ণবিদ্বেষী হতে পারে, তা নিয়ে তাদের কোনো ধারনাই ছিল না। তবে আপনাকে এটা বিবেচনা করতে হবে যে, তারা এটা জাপানে করেছে। তারা বর্ণবাদী ছিল কিনা তা নিয়েও যথেষ্ট চিন্তাভাবনা করতে হবে।

জাপানি একটি সংবাদ প্রতিবেদনের নিচে একজন মন্তব্য করে জাপানে বসবাসকারী কৃষ্ণাঙ্গদের কাছে এই বিষয়ে জানতে চেয়ে বলেছেন:

黒塗りが人種差別という経緯調べてもあんまりないんだけど、ミンストレルショーがそれであれば悪いのはその認識を定着させたショーであって、黒塗りしても差別と思わない世界を作ったほうが幸せな気はするよなあ

যদিও মুখে কালি মাখার বর্ণবিদ্বেষী পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে আমার কাছে বিস্তারিত তথ্য নেই। তবে মিনস্ট্রেল অনুষ্ঠানে মুখে কালি মাখার ব্যাপারটিকে ইচ্ছাকৃতভাবে বাজে প্রভাব হিসেবে দেখানো হয়। আমাদের এমন একটি পৃথিবী তৈরি করতে হবে যেখানে মুখে কালি মাখার সাথে বর্ণবিদ্বেষের কোনো ছাপ থাকবে না।

একটি প্রতিবেদনের জন্য সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে আফ্রিকান-আমেরিকান ছাত্র ডায়ানা পাওয়েল বলেছেন, কৃষ্ণাঙ্গদের প্রথমদিকে যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল, তা জাপানকে বুঝতে হবে:

黒人文化に憧れ、リスペクトするのは構わないが、黒人文化の背景にある歴史も理解すべきだ

যদি জাপানের মানুষ কৃষ্ণাঙ্গ সংস্কৃতির প্রতি সম্মান বা শ্রদ্ধা জানাতে চায়, তাহলে তাদের উচিত হবে, প্রথমে কৃষ্ণাঙ্গদের ইতিহাসকে বোঝা।

Exit mobile version