সরকার নেতৃত্বাধীন কারিগরি শিক্ষানবিশ প্রশিক্ষণ কর্মসুচি (টিআইটিপি) প্রকল্পের মাধ্যমে জাপানে নিযুক্ত এবং কারিগরি শিক্ষানবিশ হিসেবে কর্মরত ভিয়েতনাম, চীন ও অন্যান্য এশীয় দেশ থেকে আসা অভিবাসী শ্রমিকরা প্রায়ই তাদের কর্মক্ষেত্রে শ্রম সমস্যার সম্মুখীন হয়। শ্রমমান দপ্তরের পরিদর্শনে দেখা গেছে কারিগরি শিক্ষানবিশসহ ৯,৮২৯টি কর্মক্ষেত্রের মধ্যে ৭,২৪৭টি (৭০ শতাংশের বেশি) ২০০৩ সাল থেকে সর্বোচ্চ স্তরে শ্রম বা পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যের মান লঙ্ঘন করেছে, যা ছিল। অপরাধগুলির মধ্যে দুর্বল নিরাপত্তা নির্দেশনা অথবা অধিকাল কর্মের জন্যে অর্থ প্রদান না করা রয়েছে।
লঙ্ঘনের কিছু উদাহরণের মধ্যে রয়েছে একটি কোম্পানির কারিগরি শিক্ষানবিশরা অপারেটর লাইসেন্স ছাড়াই ক্রেন বা ভারী যন্ত্রপাতি চালায়। আরেকটি ক্ষেত্রে একটি কোম্পানি কারিগরি শিক্ষানবিশদের স্বাভাবিক কাজের সময়ের অতিরিক্ত করানো কাজ গড়ে মাসে ১০০ ঘন্টায় পৌঁছেছিল। জাপান সরকার আরো কারিগরি শিক্ষানবিশদের গ্রহণ করতে চায় বলে সুশীল সমাজের সংগঠনগুলি এই সমস্যাটির দ্রুত সংশোধনের আহ্বান জানিয়েছে।
টিআইটিপি ১৯৯৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় যার আনুষ্ঠানিক উদ্দেশ্য কারিগরি শিক্ষানবিশদের মধ্যে পেশাগত দক্ষতার বিকাশকে উন্নীত করে দক্ষতা ও প্রযুক্তিগুলিকে তাদের মূল দেশে স্থানান্তর করা হলেও বাস্তবে টিআইটিপি কার্যত দেশের বয়স্ক জনসংখ্যার কারণে কর্মশক্তির ঘাটতি পূরণে অভিবাসী কর্মীদের নিয়োগের কাজ করে। এদিকে ইন্দোনেশিয়ার মতো “প্রেরণকারী” দেশ এই স্কিমটিকে তরুণ জনগোষ্ঠীর আরো কর্মসংস্থানের একটি সুযোগ হিসেবে দেখে।
বর্তমানে ৩,৪০,০০০ এরও বেশি মানুষ টিআইটিপি’তে নথিভুক্ত। কারিগরি শিক্ষানবিশরা মূলত ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন ও চীনের মতো এশীয় দেশ থেকে এসেছে। প্রকল্পটির অধীনে তারা পাঁচ বছর পর্যন্ত জাপানে বসবাস ও কাজ করতে পারবে। সাধারণত “তত্ত্বাবধানকারী সংস্থা” কারিগরি শিক্ষানবিশদের নিয়োগ করে নিয়োগকারীদের সাথে সংযুক্ত করে। তত্ত্বাবধায়ক সংস্থাগুলি তাদের দৈনন্দিন জীবনের জন্যে সহায়তা প্রদান ও কাজের পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করার জন্যেও দায়ী। ২০২০ সাল পর্যন্ত নির্মাণ শিল্পে (২২.৫ শতাংশ) সবচেয়ে বেশি সংখ্যক কারিগরি শিক্ষানবিশ কাজ করেছে, তারপরে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ (১৯ শতাংশ) এবং যন্ত্রপাতি ও ধাতু শিল্পে (১৪.২ শতাংশ)।
শুরুর পর থেকে ৩০ বছরেরও বেশি সময় অতিবাহিত হলেও কেউ কেউ উল্লেখ করেছে স্কিমটি কারিগরি শিক্ষানবিশদের বিভিন্ন মানবাধিকার ও শ্রম অধিকার লঙ্ঘনে ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে।
টিআইটিপি কর্মসুচিগুলির পরিকল্পনা থেকে উদ্ভূত নিয়মাবলীতে কারিগরি শিক্ষানবিশদের নিয়োগকর্তা ও তত্ত্বাবধানকারী সংস্থাগুলির দুর্বল তত্ত্বাবধান পরিবর্তন নিষিদ্ধ। প্রকৃতপক্ষে এটি তাদের শারীরিক বা মানসিক নির্যাতনের পাশাপাশি পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত ও নিয়োগকর্তাদের মজুরি চুরিসহ দুর্ব্যবহারের কিছু গুরুতর ঘটনা ঘটায় যা এই ধরনের কর্মক্ষেত্র থেকে পালানো কঠিন করে তোলে।
টিআইটিপি’র অধীনে মানব পাচারের ঘটনাও অভিযুক্ত। আরো খারাপ ব্যাপারটি হলো দালালরা কারিগরি শিক্ষানবিশদের কাছ থেকে অতিরিক্ত নিয়োগ ফি নেওয়ার ফলে তারা প্রায়শই জাপানে যাওয়ার সময়ই ঋণগ্রস্ত হয়ে যায়। একটি প্রতিবেদন জানিয়েছে অর্ধেকেরও বেশি কারিগরি শিক্ষানবিশ নিয়োগ প্রক্রিয়া চলাকালীন মধ্যস্থতাকারী সংস্থাগুলিকে অর্থ প্রদান করতে গড়ে ৩,৬০০ ডলার (প্রায় ৪ লক্ষ টাকা) ঋণ কর্তে হয়৷ এধরনের পরিস্থিতিতে, বরখাস্ত বা নির্বাসনের ভয়ে তাদের নিয়োগকর্তাদের অন্যায় আচরণ সহ্য করা ছাড়া তাদের আর কোন গত্যন্তর থাকে না।
কর্মক্ষেত্রে গুরুতর আহত হওয়ার পরে ২০২১ সালে একজন ফিলিপিনো শিক্ষানবিশকে অন্যায়ভাবে বরখাস্ত করে বাড়িতে ফিরে যাওয়ার জন্যে চাপ দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে কোম্পানিটিকে শ্রমের মান মেনে না চলা বা কাজ থেকে অনুপস্থিত থাকাকালীন তার জন্যে প্রয়োজনীয় সুবিধার ব্যবস্থা না করতেও দেখা গেছে। একটি ট্রেড ইউনিয়নের সাহায্যে তিনি কোম্পানির কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ পেতে সক্ষম হন।
ত্রুটিপূর্ণ সুরক্ষা
জাপানের যথাযথ কারিগরি শিক্ষানবিশ প্রশিক্ষণ ও কারিগরি শিক্ষানবিশ প্রশিক্ষণার্থীদের সুরক্ষা আইনে শ্রম বা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে কারিগরি শিক্ষানবিশদের সুরক্ষার কথা বলে শ্রমমান লঙ্ঘন করা ব্যবসাগুলিকে কর্মসুচি থেকে বাদ দেওয়া বা তাদের লাইসেন্স বাতিল করে ভবিষ্যতে কারিগরি শিক্ষানবিশ গ্রহণ অক্ষম করার শর্ত দেওয়া হয়েছে। এই আইন অনুসারে কারিগরি শিক্ষানবিশদের তাদের নিয়োগকর্তাদের সম্ভাব্য অসদাচরণ সম্পর্কে কর্মসুচি পরিচালনাকারী সত্তা কারিগরি শিক্ষানবিশ প্রশিক্ষণ সংস্থার (ওটিআইটি) কাছে অভিযোগের সুযোগ দিতে হবে।
জাপান সরকার ২০১৭ সালে কারিগরি শিক্ষানবিশদের “প্রেরক” দেশগুলির একটি ভিয়েতনামের সরকারের সাথে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করেছে। স্মারকে উভয় সরকারই স্কিম থেকে দুষ্ট দালালদের নির্মূলে সহযোগিতা এবং তত্ত্বাবধানকারী সংস্থা, উদ্যোক্তা ও দালালদের সংশ্লিষ্ট আইনের লঙ্ঘন তদন্ত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এছাড়াও সম্প্রতি ভিয়েতনামের শ্রম, অক্ষম ও সামাজিক বিষয়ক মন্ত্রণালয় ভিয়েতনামের কর্মীদের গর্ভাবস্থায় দেশে ফিরে যেতে বাধ্য না করার ব্যাপারে জাপানি কর্তৃপক্ষের কাছে একটি অনুরোধ করেছে। বাড়িতে পাঠানো বা বরখাস্তের ঝুঁকি এড়াতে প্রকল্প চলাকালীন কারিগরি শিক্ষানবিশদের গর্ভবতী না হতে বলার অনেক ঘটনা ঘটেছে।
জাতিসংঘের বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ ও মার্কিন সরকার অপরাধীদের অপর্যাপ্ত শাস্তি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিটি তাদের পর্যায়ক্রমিক প্রতিবেদন পর্যালোচনার সময় ২০২২ সালে মানব পাচারের জন্যে টিআইটিপি ব্যবহারকারীদের যথেষ্ট নিষেধাজ্ঞা না দেওয়া ও অনেকক্ষেত্রে দোষী সাব্যস্তদের শুধু স্থগিত সাজা বা সামান্য জরিমানার কথা উল্লেখ করেছে। একইভাবে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ব্যক্তি পাচার প্রতিবেদনে নাগরিক সমাজের সংস্থাগুলিকে উদ্ধৃত করে, টিআইটিপি সম্পর্কিত সম্ভাব্য পাচারের ঘটনাগুলি সক্রিয়ভাবে তদন্ত করতে জাপানি কর্তৃপক্ষের অনীহার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
টিআইটিপি আইন অনুসারে উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান ও তত্ত্বাবধায়ক সংস্থাগুলির সংশ্লিষ্ট শ্রম আইন লঙ্ঘন করলে প্রশাসনিক নিষেধাজ্ঞা পাবে৷ ওটিআইটি নিয়মিতভাবে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ পাওয়া বা লাইসেন্স প্রত্যাহৃত উদ্যোগসমূহের একটি তালিকা প্রকাশ করে। শ্রমের মান লঙ্ঘনের ব্যাপকতা থাকা সত্ত্বেও ২০২২ সালে মাত্র ১২০টি প্রতিষ্ঠান তাদের কারিগরি শিক্ষানবিশ গ্রহণের অনুমতি হারিয়েছে। একই বছরে মাত্র একটি কোম্পানি পরিস্থিতি সংশোধনের একটি প্রশাসনিক সতর্কতা পেয়েছে বলে জানা গেছে। ওটিআইটি বলেছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় প্রতিটি পৃথক মামলার ভিত্তিতে শাস্তির ধরন নির্ধারণ করে।
এই পরিস্থিতিতে সরকার একাধিক ভাষায় শিক্ষাগত নথি প্রচার, তাদের কর্মক্ষেত্র পরিবর্তনের ব্যবস্থা এবং বহুভাষিক হটলাইনের মাধ্যমে তাদের শ্রম অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে কারিগরি শিক্ষানবিশদের সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে এই সমস্যাটির সমাধানের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
বিচার মন্ত্রণালয় ২০২২ সালের নভেম্বরে একটি বিশেষজ্ঞ প্যানেল গঠন করে যা এখন বিদ্যমান ব্যবস্থা সংস্কারের কথা বিবেচনা করছে। জারিকৃত অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে ২০২৩ সালের মে মাসে জানানো হয়েছে সরকার বর্তমান টিআইটিপি বাতিল করে একটি নতুন ব্যবস্থার মাধ্যমে এটিকে প্রতিস্থাপিত করতে চাইছে। এটি নিয়োগকর্তা পরিবর্তনের বিধিনিষেধ শিথিলের পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে শ্রম ও মানবাধিকার লঙ্ঘন থেকে কারিগরি শিক্ষানবিশদের রক্ষা করতে ব্যর্থ তত্ত্বাবধায়ক সংস্থাগুলির উপর প্রবিধান বাড়ানোর গুরুত্বও তুলে ধরেছে।
তবুও কর্মসংস্থান পরিবর্তনের স্বাধীনতা নিশ্চিত, অত্যধিক নিয়োগ ফি ও পরবর্তী দাসত্বমূলক শ্রম নিষিদ্ধ করে ভবিষ্যতে সমঝোতার সম্ভাবনাকে অনুমতি দেওয়া না হলে এই সংস্কার পরিকল্পনাটি অকার্যকরের আশংকায় সুশীল সমাজের সংগঠনগুলি এখনো উদ্বিগ্ন। প্যানেলটির থেকে চূড়ান্ত প্রতিবেদন ২০২৩ সালের শরৎকালে প্রত্যাশিত।