জাপানের ফুকুশিমা শোধিত তেজস্ক্রিয় জল নিষ্কাশনে চীনের পাল্টা জবাব

জাপান ২৪ আগস্ট, ২০২৩ তারিখে সমুদ্রে শোধিত তেজস্ক্রিয় জল নিঃসরণ শুরু করে। এনবিসি সংবাদের ইউটিউব চ্যানেল থেকে নেওয়া পর্দাছবি।

ফুকুশিমা-১ পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে প্রশান্ত মহাসাগরে শোধিত জল নিষ্কাশন শুরু করার পর জাপান সমালোচনা ও বিতর্কের মুখে পড়েছে। এই পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়ায় পুরো অঞ্চল জুড়ে প্রতিবাদ হয়েছে এবং ২৪ আগস্ট, ২০২৩ চীন জাপান থেকে সামুদ্রিক খাবার আমদানির উপর সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।

ফেব্রুয়ারিতে জাপান নিঃসরণ ঘোষণার পর চীন পদক্ষেপটিকে “অত্যন্ত দায়িত্বজ্ঞানহীন” বলে নিন্দা করে দাবি করে আন্তঃসরকারি প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) নিরাপত্তা পর্যালোচনায় শোধিত বর্জ্য জল মানুষ ও পরিবেশের উপর একটি নগণ্য তেজষ্ক্রিয় প্রভাব ফেলায় নিষ্কাশন পরিকল্পনাটি আইএইএ’র নিরাপত্তার মানদণ্ডের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ দেখা গেলেও তারা প্রতিবেশী দেশগুলির কাছ থেকে অনুমোদন চায়।

টুইটার ব্যবহারকারী @মি.শনহেইনেস রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন গণমাধ্যমের উৎস থেকে বর্জ্য জল নিষ্কাশন সম্পর্কে বিভিন্ন ভাষ্য ও রাজনৈতিক কার্টুন সংগ্রহ করেছেন:

আজ গণচীনের অনেক কর্মকর্তা, রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম ফুকুশিমা পারমাণবিক কেন্দ্র মহাসাগরে বর্জ্য জল ছাড়ায় হতাশ।

তারা একটি জিনিস উল্লেখ করতে ভুলে গেছে চীনও করে, ৬ গুণ বেশি।

এছাড়াও জাপান সরকার আইএইএ’কে ১০ লক্ষ ইউরো (প্রায় ১১.৮৮ কোটি টাকা) ঘুষ প্রদানের মিথ্যা দাবি চীনা সামাজিক গণমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে এবং অনেক চীনা নেট-নাগরিক নিঃসৃত জলে তেজস্ক্রিয় অবশিষ্টাংশ মানুষের ডিএনএকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে ও ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াবে বলে ষড়যন্ত্র ছড়াচ্ছে। ভয়কে উস্কে দিতে কেউ কেউ হয়তো ক্যান্সার স্ক্রিনিংয়ের কারণে বেড়ে যাওয়া ফুকুশিমার ক্যান্সারের (২০১২-২০১৭) তথ্যের দিকে ইঙ্গিত করেছে।

ফুকুশিমার পারমাণবিক সংকট দেখা দেয় ২০১১ সালে সুনামি আঘাত হানার ফলে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রে তিনটি পারমাণবিক গলন ও হাইড্রোজেন বিস্ফোরণ ঘটে। এলাকাটি তেজস্ক্রিয় পদার্থে দূষিত হলে প্রায় ১.১ লক্ষ লোককে সরিয়ে নেওয়া হয়।

চুল্লিগুলিকে ঠান্ডা করতে টোকিও বৈদ্যুতিক শক্তি কোম্পানি (টিইপিসি) দৈনিক ১৫০ টন জল পাম্প করে ১,০৬১টি জলের ট্যাঙ্কে দূষিত জল সংরক্ষণ করে। নিঃসৃত জল এসেছে এই ট্যাঙ্কগুলি থেকে। গলিত চুল্লিগুলি সম্পূর্ণরূপে অকার্যকর হতে ৩০-৪০ বছর সময় লাগবে।

বৈজ্ঞানিক তথ্য অনুসারে উন্নত তরল প্রক্রিয়াকরণ ব্যবস্থায় (এএলপিএস) বেশিরভাগ তেজস্ক্রিয় পদার্থ অপসারণ করায় শোধিত নিঃসরণ নিরাপদ। তেজস্ক্রিয় পদার্থগুলির পারমাণবিক ক্ষয়ের জন্যে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে জলের ট্যাঙ্কে সংরক্ষণের পর সমুদ্রে ছাড়ার আগে এএলপিএসে ফিল্টার করা অসম্ভব তেজস্ক্রিয় পদার্থ ট্রিটিয়ামের স্তর কমাতে এতে ১:১০০ অনুপাতে সমুদ্রের জলে মেশানো হয়। ডেটা আরো ইঙ্গিত দেয় ফুকুশিমা নিঃসরণ জলের ট্রিটিয়াম ঘনত্ব চীনের মূল ভূখণ্ডসহ অন্যান্য পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলির তুলনায় অনেক কম

সেন্সর ও ভীতি ব্যবস্থাপনা

তবুও বেশিরভাগ মূল ভূখণ্ডের চীনা গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান ও প্রভাবশালীরা বৈজ্ঞানিক তথ্য উপেক্ষা করে যুক্তি দিচ্ছে চুল্লির গলন ঠান্ডা করতে ব্যবহৃত হয়েছে বলে ফুকুশিমার জল অন্যান্য পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তুলনায় বেশি তেজস্ক্রিয়। সমস্ত চীনা সামাজিক নেটওয়ার্কগুলিতে ভিন্নমত সেন্সর করা হয়েছে।

চীনা ডিজিটাল টাইমসের সেন্সর সংগ্রহ অনুসারে আইএইএ’র নিরাপত্তা মান, এএলপিএস জল শোধন ব্যবস্থা, ও বৈজ্ঞানিক কোণ থেকে অন্যান্য বিকল্পগুলির উপর নিঃসরণ পরিকল্পনার পিছনে্র যুক্তি ব্যাখ্যাকারী নিবন্ধগুলি অফলাইনে সরিয়ে নেওয়া হয়৷

অন্যদিকে জাপানি সামুদ্রিক খাবারের ওপর চীনা সরকারের সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা জনসমর্থন পেয়েছে। চীনে জাপান-বিরোধী মনোভাব বাড়ছে, এবং চীনা সামাজিক গণমাধ্যমে অনেক অনলাইন মন্তব্য এই কাজটিকে একটি মানবতাবিরোধী “অপরাধ” হিসেবে বর্ণনা করেছে।

চীনের সামুদ্রিক খাবারের নিষেধাজ্ঞা জাপানের মাছ ধরার শিল্পকে আঘাত করলেও অনেক পর্যবেক্ষক উল্লেখ করেছেন এই পদক্ষেপটি তার নিজস্ব অর্থনীতিরও ক্ষতি করতে পারে। প্রথমত, খাদ্য নিষেধাজ্ঞা ও জাপান বিরোধী মনোভাব বৃদ্ধির কারণে চীনের মূল ভূখণ্ডের হাজার হাজার জাপানি রেস্তোরাঁ মেনু পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়ে সম্ভবত তাদের গ্রাহক হারাবে

দ্বিতীয়ত, কয়েক মাস ধরে “পারমাণবিক নিঃসরণ বিপর্যয়” সম্পর্কে রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদনের পরে অনেক মূল ভূখণ্ডের চীনারা দৃঢ়ভাবে সমুদ্র দূষিত মনে করার ফলে চীনা মৎস্য ও জলজ খাতের সমান্তরাল ক্ষতি হয়েছে। হোয়াটস_অন_ওয়েইবো থেকে মান্যা কোয়েতসে ২৪ আগস্ট চীনা মাছের বাজার থেকে নেওয়া ক্লিপগুলি পুনরায় পোস্ট করেছেন:

চীনের মাছের বাজারের জন্যে এটি একটি কঠিন সময়। কিছু বিক্রেতা এই সপ্তাহে ই-কমার্স লাইভস্ট্রিমের সময় জাপান প্রশান্ত মহাসাগরে ফুকুশিমার শীতল জল নিঃসরণ শুরুর পরে তাদের মাছ অবশ্যই দূষিত হবে বারবার এমন মন্তব্য দেখে দৃশ্যত বিরক্ত হয়।

রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন গ্লোবাল টাইমসের শীর্ষ ভাষ্যকার হু জিজুন ওয়েইবোতে ভীতি সৃষ্টি করে উদ্বেগ প্রকাশ করেন:

在情况有些混沌的时候,我们应保护好儿童,有生育计划和可能性的年轻人也要多注意,可采取安全的高标准。无生育计划的壮年人,还有老年人,我觉得可以放开些。低剂量核辐射经过鱼类的消化,再转到人的身上,我相信产生作用的过程会非常缓慢,壮年以上的人(我是指40岁以上且不再有生育计划的人)无需过度担心。老胡本人会继续吃国家检测部门肯定的所有国产海产品,日本货从此拜拜了,但中国渔民和养殖户是无辜的,我愿意与他们共渡难关。

বর্তমান বিশৃঙ্খলার মধ্যে আমাদের উচিত শিশু ও যুবকদের জন্ম পরিকল্পনা সুরক্ষা দেওয়া। তারা একটি উচ্চতর খাদ্য নিরাপত্তা মান গ্রহণ করতে পারে। প্রাইম টাইমে যাদের কোনো জন্ম পরিকল্পনা নেই এবং বয়স্করা কম কঠোর হতে পারে।কম ঘনত্বের বিকিরণটি মাছদের হজম এবং মানুষের মধ্যে স্থানান্তরের পরে, [বিকিরণ] কার্যকরের প্রক্রিয়াটি খুব ধীর হবে বলে জন্ম পরিকল্পনাহীন চল্লিশোর্ধদের খুব বেশি চিন্তা করার দরকার নেই। আমি নিজে রাষ্ট্রের গুণমান তত্ত্বাবধান কর্তৃপক্ষ অনুমোদিত সব দেশীয় সামুদ্রিক ও জলজ চাষের খাবার চালিয়ে যাবো। আর জাপানি সামুদ্রিক খাবার নয়, তবে চীনা জেলে ও জলজ চাষীরা নির্দোষ বলে কঠিন সময়ে আমি তাদের পাশে দাঁড়াতে চাই।

চীনা মৎস্য ও জলজ চাষের মোট উৎপাদন মূল্য ২০২১ সালে ছিল ১.৪৫ লক্ষ কোটি ইউয়ান (প্রায় ২১.৯২ লক্ষ কোটি টাকা)।

জাপান বিরোধী মনোভাব চীনে অবস্থিত জাপানি ব্যবসার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ বা এমনকি দাঙ্গায় পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে কেউ কেউ চিন্তিত। চীনা বর্তমান ঘটনাবলী ব্লগার কাই শেনকুন এক্সে (পূর্বের টুইটার) লিখেছেন:

ক্রমবর্ধমান জাপানি বিরোধী মনোভাব মূলত অনলাইন অভিব্যক্তি হলেও এটা একবার বেড়ে গেলে নিঃসরণের বিরুদ্ধে আরো সরকারি নিষেধাজ্ঞার দাবিতে জাপানি রেস্তোরাঁ বা যানবাহনে বিক্ষোভ বা হামলা হতে পারে। জাপানি পণ্য বয়কট করার পাশাপাশি তারা জাপানি ব্যবসাগুলোকে বের করে দিতে চাইতে পারে। জনপ্রিয়তাবাদী মনোভাবকে উস্কে দেওয়া সহজ হলেও আগুন তাকেও আঘাত করবে… অতীতে ঘরোয়া সমস্যাগুলি থেকে বিভ্রান্ত করতে মতামতের কারসাজি করে সকল জাপানি-বিরোধী বিক্ষোভ উস্কে দেওয়া হয়। বর্তমানে দেশটি গুরুতর যুব বেকারত্ব ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার বলে একটি জাপানবিরোধী ঝড় আসন্ন। [দীর্ঘ পোস্টের সংযোগ।]

সর্বশেষ বড় জাপানবিরোধী বিক্ষোভে ২০১২ সালে চীনের কিছু শহরে বিক্ষোভকারীরা সহিংসভাবে জাপানি গাড়ি, রেস্তোঁরা ও দোকান ভাংচুর করে।

চীন ছাড়াও, দক্ষিণ কোরিয়া ও ফিজিসহ অন্যান্য দেশও জাপানিদের শোধিত জল নিষ্কাশনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে।

প্রতিক্রিয়া হিসেবে অনেক সরকার ফুকুশিমা নিষ্কাশন পরিকল্পনা নিয়ে জনগণের উদ্বেগ কমানোর চেষ্টা করে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন জল নিষ্কাশনের এক মাস আগে ফুকুশিমার খাদ্য আমদানি নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। অস্ট্রেলীয় সরকার তার নিষ্কাশন পরিকল্পনায় জাপানের স্বচ্ছতা ও আন্তর্জাতিক নিযুক্তির প্রশংসা করে পরিশোধিত জলের নিরাপত্তার মান নিশ্চিত করেছে। দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রপতি ইউন সুক ইওল স্থানীয় মাছের পণ্যের নিরাপত্তা নিয়ে জনসাধারণের উদ্বেগ দূর করতে ২৮ আগস্ট সামুদ্রিক খাবার খেয়েছেন

আইএইএ ফুকুশিমার শোধিত জলের মুক্তির বিষয়ে জাপান থেকে সরেজমিন ডেটা সরবরাহের একটি ওয়েবসাইটও স্থাপন করেছে।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .