বাংলাদেশের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা, হুমকির মুখে সুন্দরবন

বাংলাদেশে সুন্দরবনের কাছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত্ নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। সুন্দরবন বিশ্বের সবচেয়ে বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন। বাংলাদেশ ও ভারত জুড়ে এর অবস্থান। বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনায় ক্ষুদ্ধ হয়েছেন অ্যাক্টিভিস্টরা। তারা বলছেন, এতে করে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাবে।

১৩২০ মেগাওয়াটের প্রস্তাবিত এই কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্রটি বাগেরহাট জেলার রামপালে নির্মিত হবে। ২০১১ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ভারত সফরের সময় দুই দেশের মধ্যে একটি সমাঝোতা চুক্তি হয়। বাংলাদেশের পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের পরিবেশগত সমীক্ষা করার আগেই এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।

২০১৩ সালের ২০ এপ্রিল তারিখে বাংলাদেশ বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ড ভারতের ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কর্পোরেশনের মধ্যে আনুষ্ঠানিক ভাবে তিনটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই প্রকল্পে ১.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় হবে। আশা করা হচ্ছে প্রকল্পটি ২০১৮ সালের মধ্যে শেষ হবে।

এই বিদ্যুত কেন্দ্রের চূড়ান্ত পরিবেশগত প্রভাব নিরুপন প্রতিবেদন (এখানে প্রতিবেদনের পিডিএফ ভার্সন ডাউনলোড করা যাবে) সরকার প্রকাশ করলে দেশের পরিবেশবিদরা পরামর্শ সভায় তা প্রত্যাখান করেন। বিদ্যুত বিভাগ গত ১২ এপ্রিল এই পরামর্শ সভার আয়োজন করে। তারা যুক্তি দেখান, পরিবেশগত প্রভাব নিরুপনে সুন্দরবনের বাস্তুসংস্থান, উদ্ভিদজগতসহ অত্র অঞ্চলের স্থানীয় মানুষদের বিবেচনা করা হয়নি।

যদিও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে (২০৮ নং পাতায়) বিদ্যুত কেন্দ্রটি সুন্দরবনের অংশে স্থাপিত হলেও পরবর্তীতে এখানকার অনেক অধিবাসীকে সরিয়ে নেয়া হবে।

বাংলাদেশের বিদ্যুত খাত বেশ ছোট, অপর্যাপ্ত এবং এর ব্যবস্থাপনা বেশ নাজুক। দেশের মোট জনগোষ্ঠীর মাত্র ৪০% বিদ্যুত পান। তাদের বার্ষিক মাথাপিছু বিদ্যুত প্রাপ্তির পরিমাণ ১৩৬ কিলোওয়াট। তাই বিদ্যুতের চাহিদা পূরণে সরকারের ওপর ব্যাপক চাপ রয়েছে।

তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ, বিদ্যুত, বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি তাদের ওয়েবসাইটে এই বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়তে বাংলাদেশ-ভারত উভয় দেশের নাগরিকের প্রতি আহবান জানিয়েছে।

বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন বাঁচাতে পরিবেশবিদ, সমাজকর্মী এবং সাধারণ নাগরিকরা মানববন্ধনে ব্যানার ধরে আছেন। ছবি ফিরোজ আহমেদ। স্বত্ব: ডেমোটিক্স (২১/৩/২০১৩)

আবদুল্লাহ আল ইমরান তার ফেসবুক নোটে উল্লেখ করেছেন, এই বিদ্যুত কেন্দ্রের মধ্যে দিয়ে ভারত প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা করার নিজের আইন-ই ভঙ্গ করছে:

১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার একটা বিদ্যুতকেন্দ্র গড়ে উঠবে বাগেরহাটের রামপালে যা কিনা সুন্দরবন থেকে মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরে। ভারতের ওয়াইল্ড লাইফ প্রটেকশন এ্যাক্ট ১৯৭২ অনুযায়ী বাঘ-হাতি সংরক্ষণ অঞ্চল,জাতীয় উদ্যান এবং জীব বৈচিত্র্যের জন্য গুরূত্বপূর্ণ বনাঞ্চলের১৫ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে কোন বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরী করা যায় না।

সাংবাদিক কল্লোল মুস্তফা ফেসবুকে পরিবেশগত প্রভাব নিরুপণ প্রতিবেদনের সার-সংক্ষেপ করে ভবিষ্যদ্বাণী করেন:

বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের মালামাল ও যন্ত্রপাতি সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নদী পথে পরিবহন করা হবে। এর ফলে বাড়তি নৌযান চলাচল, তেল নি:সরণ, শব্দদূষণ, আলো, বর্জ্য নি:সরণ ইত্যাদি পরিবেশ আইন অনুসারে নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে সুন্দরবনের ইকো সিস্টেম বিশেষ করে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হরিণ, ডলফিন, ম্যানগ্রোভ বন ইত্যাদির উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে বলে ইআইএ রিপোর্টে আশংকা করা হয়েছে।

ওয়াটার রিসোর্স ইঞ্জিনিয়ার্স ফোরাম ব্লগে ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ শাহাদদ হোসেন লিখেন:

প্রস্তাবিত রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ইআইএ রিপোর্টের এই সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা থেকে স্পষ্ট যে, [..] সুন্দরবনের পাশে ১৩২০ মেগাওয়াটের এই কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে জায়েজ করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা স্বত্ত্বেও, এরপরও খোদ ইআইএ রিপোর্টে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ, পরিচালানা ও কয়লা পরিবহনের ফলে সুন্দরবনের উপর সম্ভাব্য ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে এমন সব তথ্য বেরিয়ে এসেছে যা প্রস্তাবিত কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পকে পরিবেশগত বিবেচনায় অগ্রহণযোগ্য বিবেচনা করার জন্য যথেষ্ট।

জেলেরা সুন্দরবনে মাছ ধরার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ছবি ফিরোজ আহমেদ। স্বত্ব: ডেমোটিক্স (২৬/১১/২০১২)

সুন্দরবন আমাদের প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করে। তাই সুন্দরবনে বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনের মতো সিদ্ধান্তের দূরদর্শিতা নিয়ে কমিউনিটি ব্লগ ইস্টিশনে প্রশ্ন তোলেন ব্লগার মাহবুব সুমন:

প্রথমত – ঝড় ঝাপটা প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে থেকে বুক পেতে বাংলাদেশ রক্ষাকারী এই বনের মধ্যে বা কাছা কাছি ক্ষতিকর দূরত্বে এমন কোন প্রকল্প করা উচিৎ কিনা যা জীব – বইচিত্রের আধার এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষাকারী, সর্বোপরি দুর্যোগ থেকে রক্ষাকারী এই প্রাকৃতিক দেয়াল ধ্বংস করে দিবে? সচেতন মানুষ মাত্রেই একমত হবেন নাবোধক উত্তরে। এমন বিদ্যুৎ আমাদের দরকার নাই যে বিদ্যুতের জন্য আমাদের দেশটাই ধ্বংস হয়ে যাবে।

দ্বিতীয় জরুরী প্রশ্ন হল- অন্য কোথাও বিদ্যুৎ প্রকল্প করা হলেও আমরা কি কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের ক্ষতি সামাল দিতে পারব?

ব্লগার বাংলার হাসান পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দেন, পরিবেশ ছাড়পত্র না পাওয়ায় এই একই প্রজেক্ট ভারতের ওড়িষ্যা রাজ্যে বাতিল হয়েছে

ফয়সাল কায়সার প্রশ্ন তোলেন:

যে বিবেচনায় এনটিপিসি নিজের দেশে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করতে পারেনি সেই একই বিবেচনায় বাংলাদেশে কী তাদের প্রকল্প বাতিল হতে পারে না?

সুন্দরবন বাঁচাতে ফেসবুক ইভেন্ট। ছবি অমি হাসানের সৌজন্যে।

এই বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনের বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরি করতে ফেসবুক ইভেন্ট তৈরি করা হয়েছে। এখান থেকে খুব শিগগিরই রাজপথে আন্দোলনের কর্মসুচী ঘোষণা করা হবে।

Exit mobile version