চীনের মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে ২৮,০০০ নদী

চীনের একটি জনপ্রিয় ফোক গানে বলা হয়েছে- “অকূল নদী রে, তোর কতো উঁচু ঢেউ। তীরজুড়ে ধানক্ষেতের মিষ্টি সুঘ্রাণ নিয়ে বইছে বাতাস ওই।”

কিন্তু চীনে ছায়া সুনিবিড় পল্লী মায়ের কোলে এরকম প্রশান্ত নদী দিন দিন অতীত হয়ে যাচ্ছে। এদিকে দেশের দুষিত নদীপথ দেখে জনগণের মধ্যে হতাশা তীব্র হচ্ছে। সম্প্রতি দেশজুড়ে পরিচালিত নদী জরিপে দেখা গেছে, দেশের ২৮ হাজার নদী মানচিত্র থেকে বিলীন হয়ে গেছে।

২০১৩ সালের ২৬ মার্চ তারিখে এই জরিপ তথ্য প্রকাশিত হয়। ২০১০-২০১২, এই তিন বছরে প্রথমবারের মতো নদী জরিপ পরিচালিত হয়। জরিপে বলা হয়েছে, দেশে প্রতি ১০০ বর্গ কিলোমিটারে বর্তমানে ২২ হাজার ৯০৯টি নদী রয়েছে। ১৯৯০ সালে এই সংখ্যা ছিল ৫০ হাজার।
চীনের জলবায়ু পরিস্থিতির অবনতি ঠেকাতে নতুন নেতৃত্বের অঙ্গীকার করার এক সপ্তাহ পরেই এই নদী জরিপ প্রকাশ পেল। নদীর সংখ্যা কমার এই আশংকাজনক হার চীনের বিখ্যাত পরিবেশবিদ মা জুন ছাড়াও আরো অনেকের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। টাইমস অফ ইংল্যান্ডকে দেয়া এক সাক্ষাত্কারে মা জুন নদী হারিয়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে অতিমাত্রায় নদী সম্পদ শোষণকেই দায়ী করেছেন।

মা আরো জানান, থ্রি গর্জেস ড্যামের মতো বিশাল জলবিদ্যুত্ কেন্দ্র নির্মাণ এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখেছে।
যদিও সরকার নদীর কমার কারণ হিসেবে বিভিন্ন রিসার্চ পদ্ধতি এবং জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ী করেছে। চীনের পানিসম্পদ বিষয়ক উপমন্ত্রী জিয়াং ইয়ং উল্লেখ করেছেন, আগের ৫০ হাজার নদীর তথ্যটি সঠিক নয়। কারণ আগের মানচিত্রকারকরা প্রচলিত পদ্ধতিতে নদীর অবস্থান খুঁজতেন। তিনি রাষ্ট্র পরিচালিত সংবাদ টেলিভিশন চায়না সেন্ট্রাল টেলিভিশনকে বলেন:

১৯৯০ সালে আমাদের বিশেষজ্ঞরা পুরোনো মানচিত্র, গণনার জন্য পুরোনো যন্ত্রের উপর নির্ভরশীল ছিলেন। কিন্তু বর্তমানে আমরা ১/৫০০০০ অনুপাতের জাতীয় স্ট্যান্ডার্ডের নতুন মানচিত্র ছাড়াও রিমোট সেনজিং ইমেজ ইকুপমেন্ট ব্যবহার করে একটার পর একটা নদী গণনা করি। তাই বতর্মান পদ্ধতিতে সঠিক সংখ্যা পাবার হার বেশি।

সরকারের ব্যাখ্যায় বেশিরভাগ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী সন্তুষ্ট নন। ইয়ামি লিওলিউ নামের বেইজিংয়ের একজন জনপ্রিয় মাইক্রোব্লগ সাইট সিনা উইবুতে লিখেছেন:

মানচিত্র থেকে ২৮ হাজার নদী হারিয়ে যাওয়ার কথা শুনে আমি বিস্মিত হয়েছি। এটা কী প্রাকৃতিক বিপর্যয়? অথবা মানুষের কোনো ভুল? আমার ধারণা, এতে দুই পক্ষেরই ভুমিকা আছে। তবে মানুষের ভুলের পরিমাণই বেশি। অবস্থা ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে বলার জন্য অনেক উদাহরণ পাওয়া যাবে। বর্তমানে যে পরিমাণ পানি ভুপৃষ্ঠের উপরে এবং নিচে সঞ্চিত আছে তা নিয়ে সবারই উদ্বেগ রয়েছে… খাদ্য ও জ্বালানিতে আমরা অতিমাত্রায় আমদানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি। এর মানে কী আমাদের ভবিষ্যত্ প্রজন্মকেও বিদেশ থেকে পানি আমদানি করে খেতে হবে?

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক মুখপাত্র ওয়াং শিউমিং উইবুতে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-কে কিছু গতানুগতিক প্রস্তাব দিয়েছেন:

শি স্যারের জন্য কিছু পরামর্শ: গত ৩০ বছরে প্রতি ১০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় ২৭ হাজার নদী হারিয়ে গেছে। যখন আমাদের চারপাশ থেকে পানি সরে বা কমে যাচ্ছে, ঠিক সেই সময়ে আমাদের পকেটে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা আসছে। পরিবেশ খাতে চীনের বিনিয়োগ বেড়েছে ১৮.৮%। যা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হারের দ্বিগুণেরও বেশি (চীনের জিডিপি ৮% এর কাছাকাছি)। আমি সরকারকে পরামর্শ দিবো, অতি শিগগিরই সকল ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি কমিয়ে দিন। পরিবেশ রক্ষার কাজকে সর্বাগ্রাধিকার দিন। এছাড়া সরকারি কর্মকর্তারা এগুলো মূল্যায়ন করবে না। সুন্দর চীনের সাথে সমৃদ্ধ চীনও গড়ে তুলুন।

চীনের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রদেশ লিয়োনিংয়ের শেনইয়াং শহরের অধিবাসী প্যান ওয়েন্ডা সবার কাছে আর্জি জানিয়েছেন, সবাই যেন নিজ নিজ শহরের নদীর অবস্থার কথা মন্তব্যে জানিয়ে দেন:

গত ২০ বছরে আমাদের দেশের বহমান নদী থেকে ২৭ হাজার নদী হারিয়ে গেছে। বিষয়টা বেশ উদ্বেগজনক। পানি আমাদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎস। পানি ছাড়া আমাদের জীবন কী তাহলে শেষ হয়ে যাবে! মানুষের অপরিণামদর্শী কারণে নদীর মৃত্যু ঠেকাতে, আমাদের ছেলেমেয়েদের স্বাস্থ্য সচল রাখতে, সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হবে। সকলের কাছে অনুরোধ করছি, আপনার এলাকার নদীগুলোর কী অবস্থা তা দয়া করে জানান।

এমনকি রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত ট্যাবলয়েড পত্রিকা গ্লোবাল টাইমস তাদের উইবু পেজে ‘একটা দীর্ঘশ্বাস খোঁজা যাক’ বলে সম্পাদকীয়ও লিখেছে:

প্রতিবছরই চীন থেকে অসংখ্য নদী হারিয়ে যাচ্ছে। এটা আমাদের মনে করিয়ে দেয় গত বছরে ইউনানয়ের বন ধ্বংসের কথা, বেয়ার পর্বতগুলোর কথা: জিসুয়ানবান্নায় পর্বতের মূল গাছগুলো উপড়ে ফেলে সেখানে রাবার গাছ লাগানো হয়েছে। একই প্রজাতির গাছ বনের বাস্তুসংস্থানের পক্ষে ক্ষতিকর। একটি উন্নয়ন পরিকল্পনা নেয়া হলে, তার ক্ষতিকর দিকও দিন দিন স্পষ্ট হয়ে উঠে। এবং ক্রমেই তা গতিবৃদ্ধি পায়। কিন্তু মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের কর্মকাণ্ডকে দোষারোপ করতে পারেন কে? যদি উন্নয়ন-আচ্ছন্ন বিলিয়ন মানুষের বিশ্বাস এবং প্রকৃতিকে ভয় পাবার বিষয়টির অভাব ঘটে, তাহলে এর চেয়ে ভয়ংকর শক্তি আর কী হকে পারে!

Exit mobile version