বাংলাদেশ: শাহবাগ আন্দোলনে জড়িত ব্লগারকে খুন করা হয়েছে

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় ১৫ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার রাতে আহমেদ রাজীব হায়দার নামে এক ব্লগার খুন হয়েছেন। তিনি থাবা বাবা নামে বিভিন্ন ব্লগে লিখতেন। নিজ বাসার কাছে তার ক্ষতবিক্ষত লাশ পাওয়া যায়। উনিশ শ’ একাত্তর সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনী ত্রিশ লক্ষ বাঙালিকে হত্যা করে, ২ লক্ষ ৫০ হাজারের বেশি নারীকে ধর্ষণ করে। এদের সহযোগিতা করে রাজাকার, আলবদর বাহিনী। একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী রাজাকার, আলবদরদের ফাঁসির দাবিতে বাংলাদেশে যে শাহবাগ আন্দোলন চলছে, এই আন্দোলনের সাথে ব্লগার রাজীব হায়দার শুরু থেকেই জড়িত ছিলেন। তাছাড়া তিনি দীর্ঘদিন ধরেই অনলাইনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে লেখালিখি করে আসছিলেন।

ব্লগার রাজীব হায়দার। ছবিটি তার ফেসবুক থেকে নেয়া।

ব্লগার রাজীব হায়দার। ছবিটি তার ফেসবুক থেকে নেয়া।

ব্লগার রাজীব হায়দারের মৃত্যুর সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ব্লগার রণদীপম বসু তার ফেসবুকে রাজীব হায়দারের সাথে ব্যক্তিগত স্মৃতি স্মরণ করে স্ট্যাটাস দেন:

রাজীব হায়দার, ভাই আমার, তোমার স্মৃতির ভার বইতে পারছি না আমি…!

রাজীব হায়দারের হত্যাকাণ্ডের পরদিন টুইটারে তার শাহবাগ আন্দোলনের সঙ্গী রাসেল জন টুইট করেন:

@Ekushey (একুশে) আজ নতুন একটি দিন। আমরা সবাই আছি। শুধু নেই থাবা বাবা। আমি উনাকে কোলা বাবা বলে ডাকতাম। প্রিয় থাবা বাবা আমরা আপনাকে মিস করছি। #শাহবাগ

সচলায়তনের একটি পোস্টে মৃত্যুময় ঈষৎ মন্তব্য করেন:

নিজের গায়ে আগুন লাগায় দিতে ইচ্ছে করছে আমার। কোন প্রগতিশীল ব্লগারকে খুন হতে দেখতে পারি না। কিছুতেই না।

ব্লগার রাজীব হায়দারের খুনের কারণ প্রসঙ্গে হাসিব তার নীড়পাতা ব্লগে লিখেন:

খুন করার জন্য থাবাবাবাকে বেছে নেবার কারণ পরিষ্কার। থাবাবাবা ধর্মবিশ্বাসের নাস্তিক ছিলেন এবং সেটা তিনি উচ্চস্বরে জানানও দিতেন। জামাতের উদ্দেশ্য এখানে এই ধর্মবিশ্বাসকে আশ্রয় করে একটা বিভক্তি টানা। তারা এই বিভক্তি তৈরী করতে সফল।

শাহবাগে সহযোদ্ধার কফিন ছুঁয়ে শপথ নিচ্ছেন আন্দোলনকারীরা। ছবি ফিরোজ আহমেদের। কপিরাইট ডেমোটিক্স (১৬/২/২০১৩)

ব্লগার রাজীব হায়দারের হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ উঠেছে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক সংগঠন জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ ও তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে। আমার ব্লগে সুশান্ত লেখেন:

তবে এ পর্যন্ত যতটুকু তথ্য পেয়েছি এবং জামাত শিবিরের ব্লগ সোনার বাংলায় প্রদত্ত হিট লিস্ট এবং জামায়াত-শিবিরের অতীতের কর্মকান্ড এবং শাহবাগ-ঘটিত তাদের বিভিন্ন বক্তব্যের আলোকে ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে কোনো সন্দেহ নেই যে এই হত্যাকান্ডের সম্ভাব্য অপরাধী জামায়াত-শিবির চক্র।

উল্লেখ জামাত-শিবির পরিচালিত সোনার বাংলা ব্লগে রাজীব হায়দারের হত্যার চারদিন আগে যারা যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে শাহবাগে আন্দোলন করছেন, তাদের নিয়ে একটি পোস্ট [পিডিএফ] প্রকাশিত হয়। সেখানে প্রথম নামটি ছিল রাজীব হায়দারের।

শাহবাগের প্রতিবাদকারীরা রাজীবের নামাজে জানাজা পড়ছে। ছবি মোহাম্মদ আসাদের। কপিরাইট ডেমোটিক্স (১৬/২/২০১৩)

রাজীব হায়দার নিহত হবার পর একটি ব্লগের লিংক অনেকেই ফেসবুকে শেয়ার করেন, যেখানে দাবি করা হয় ব্লগটি নিহত ব্লগারের। ব্লগে ধর্মবিরোধী অনেক পোস্ট ছিল। তবে ব্লগটি রাজীব হায়দারের ছিল না। এটি একটি ফেক ব্লগ ছিল। আবদুল্লাহ আল কাফি কোয়ানকাস্টে ব্লগার রাজীব হায়দার ওরফে থাবা বাবা’র কথিত ওয়ার্ডপ্রেস সাইটের ট্রাফিক অ্যানাসাইসিস করে বলেন:

quantcast এ গিয়ে দেখা যায় সাইটটি ফেব্রুয়ারীর ১৫ তারিখ থেকেই দেখা যাচ্ছে এর তা হোল রাজিব হত্যার দিন, অথচ সাইটটির পোস্টগুলো এক বছর আগের, নূরানি চাপা সাইটটার অস্তিত্ব ফেব্রুয়ারীর ১৫ তারিখ এর আগে ছিলই না। রাজিব হত্যার পরপরি সাইটটি রাজিব এর নামে বিকৃত কিছু পোস্ট দিয়ে অনলাইন এ ছড়িয়ে দেয়া হোল, যাতে সাধারণ মানুষ রাজিব এর লিখা পড়তে গেলে এই পোস্ট গুলো পায়।

কাফি খানও শাহবাগে সাইবার যুদ্ধ পেজে লিখেন:

নুরানি চাপা সাইটটা থাবা বাবা-এর খোলা না। আপনারা নিচের লিঙ্কটাতে গেলেই সব ডাটা পাবেন। এই সাইটটা গতকালও মডিফাই করা হইছে। তাইলে মরার পর কে মডিফাই করল?? আমি একটা ছবিও দিয়া দিছি!! আজব!!! এইভাবে মানুষকে দোষী বানানো কোন ঈমান এর ভিতর পড়ে??

কাফি খান অ্যানালাইসিস করে দেখাচ্ছেন রাজীবের মৃত্যুর পরেই ব্লগটি মডিফাই করা হয়েছে। ছবি শাহবাগে সাইবার যুদ্ধ পেজ থেকে নেয়া।

বাংলাদেশে ৮৯% মানুষই ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী। তাই ব্লগার রাজীব হায়দারের ধর্ম বিশ্বাসহীনতাকে ব্যবহার করে ঘটনাকে ভিন্ন খাতে নেয়ার একটা প্রচেষ্টা সোশ্যাল মিডিয়াতে চোখে পড়ে। এ প্রসঙ্গে আমার ব্লগে শুভ রায় চৌধুরী লিখেন:

রাজীব ভাইকে নাস্তিক বলে অনেকেই আন্দেলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে চায়। তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, আপনারা যারা প্রথম থেকে আন্দোলনের সাথে কোন না কোনভাবে সম্পৃক্ত, তারা হয়তো জানবেন এই আন্দোলন কোন ধর্মযুদ্ধ নয়। এটি দেশের কলঙ্ক মোচন করার লড়াই।

প্রজন্ম চত্বর – শাহবাগ যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবির সাথে ধর্মকে এক না করার আহবান জানিয়ে ফেসবুকে লিখেন:

আবারো হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে ধর্ম, পুঁজি করা হয়েছে ধর্মকে। প্রজন্ম চত্বরে বাঙালি এক হয়েছে রাজাকারের ফাঁসির দাবি নিয়ে, কোন ধর্মীয় ইস্যু নিয়ে নয়। প্লিজ ধর্ম এবং ফাঁসির দাবি এই দুইটা ফ্যাক্ট গুলিয়ে এক করে ফেলবেন না।

ধর্ম বিশ্বাসহীনতার জন্য নয়, ব্লগার রাজীব হায়দারকে খুন করা হয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন পরিচালনার জন্য ফেসবুকে এমনটাই লিখেছে শাহবাগ আন্দোলন Shahbagh Movement:

ব্লগার রাজীব হায়দারকে কিন্তু তার ধর্মে বিশ্বাস অথবা অবিশ্বাসের জন্য খুন করা হয়নি। সেরকম হলে তাকে আরো আগেই হত্যার চেষ্টা করা হত! রাজীব হায়দার ছাড়াও আরো অনেকে রয়েছেন যারা ধর্মে বিশ্বাস রাখেন না। তাদেরকেও কিন্তু আক্রমণ করা হয়নি। রাজীব হায়দারকে খুন করা হয়েছে যখন তিনি জামায়ত শিবির যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছেন, তখন!

যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে শাহবাগে গেল তেরদিন ধরে প্রায় লক্ষাধিক মানুষ অবস্থান করছেন। তারা তাদের সহযোদ্ধা রাজীব হায়দার হত্যার দ্রুত বিচার দাবি করেছেন। ইতোমধ্যে হত্যার অভিযোগে পুলিশ ৫ জনকে গ্রেফতার করেছে।

Exit mobile version