বাংলাদেশ: সোশ্যাল মিডিয়ার আগুন ছড়িয়ে পড়েছে রাজপথে

৪২ বছর। বাংলাদেশীদের এতদিন অপেক্ষা করতে হয়েছে পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা লাভের সময় তাদের বিরুদ্ধে করা জঘন্য অপরাধগুলোর বিচার পাবার জন্যে। গত ৫ই ফেব্রুয়ারি ২০১৩ মঙ্গলবার গুরুতর যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

তবে লাখো মানুষ মনে করে যে ন্যায় বিচার হয়নি। তারা কাদের মোল্লার ফাঁসি চায়। এবং তারা ঢাকার শাহবাগ চত্বরে অবস্থান নিয়েছে তাদের প্রতিবাদ জানানোর জন্যে। এখন শাহবাগ ছাড়াও এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ছে সারাদেশে।

জামাতে ইসলামী এই রায়ের বিরুদ্ধে মঙ্গল ও বুধবারে সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল দিয়ে কার্যত জনজীবন স্থবির করে দেয়। (এখানে সম্পূর্ণ রায় পাওয়া যাচ্ছে)

ফেইসবুক ইভেন্ট এর স্ক্রীণশট

এখানে উল্লেখ্য ব্লগার এবং অনলাইন অ্যাকটিভিস্টরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অভিযুক্তদের অনেকেই ইসলামী দলগুলোর নেতা এবং এই বিচার ৪২ বছর বিলম্বে হল।

তাই অবাক হবার কিছু নেই যে ব্লগাররাই এই প্রতিবাদগুলো আয়োজনে মূল ভূমিকা পালন করেছে। হরতাল ও কাদের মোল্লার লঘু শাস্তির প্রতিবাদে ব্লগার ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট নেটওয়ার্ক (বিওএএন) ফেসবুকের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল শাহবাগে প্রতিবাদ কর্মসূচীর ডাক দেয়। উক্ত ফেইসবুক ইভেন্টে এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে ৭০০০০ এর বেশী লোককে এবং যোগদান করছেন বলে জানিয়েছেন ৭০০০ এর ও বেশী লোক।

আপামোর জনগণ জামাত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছে। ছবি ফিরোজ আহমেদের। সর্বস্বত্ব ডেমোটিক্স (৬/২/২০১৩)।

শাহবাগ- বাংলাদেশের তাহরির স্কয়ার

কাদের মোল্লার ফাঁসি চেয়ে গত দুইদিন ধরেই শাহবাগে চলছে আন্দোলন, সমাবেশ। ১৫০০০-২০০০০ লোকের অবস্থান ও প্রতিবাদে শাহবাগ হয়ে উঠছে যেন মিশর বিপ্লবের কেন্দ্রস্থল তাহরির স্কয়ার। মঙ্গলবার বিকেল থেকে শাহবাগে ব্লগাররা ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ সাধারণ মানুষরা মিছিল করে আসতে থাকেন। সেখানে চলে প্রতিবাদী গান, কবিতা, মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা ও প্রামান্যচিত্র প্রদর্শনী।

পাভেল মহিতুল আলম শাহবাগ থেকে তার স্ট্যাটাসে জানান:

মিছিল, স্লোগান আর গানে মুখরিত শাহবাগ। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে মোমবাতি আর মশালের আলোয় প্রতিবাদে অংশ নিচ্ছে সর্বস্তরের হাজার হাজার মানুষ। একটু পরে গাইবে গানের দল ‘সমগীত'। আপনিও আসুন।

ফেসবুকে শাহবাগের ছবি শেয়ার করে অনেকে, যেমন আইসিএসএফ এবং কাজী সুদীপ্ত

মুক্তাঙ্গন ব্লগে লেখক, সাংবাদিক, ব্লগার ইমতিয়ার শামীম লিখেন:

…এই শাহবাগ অচিরেই ছড়িয়ে পড়বে সারা দেশে, -পরাজিত করবে গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা এবং সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপের আকুতিকে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সুনিশ্চিত করার মাধ্যমে ছিনিয়ে আনবে বিজয়।

শুধু ঢাকার শাহবাগ নয়। চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট, খুলনা, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, রংপুর-সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে শহীদ মিনারে জড়ো হয়ে সবাই যুদ্ধাপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের দাবি করেছেন।

রায়হান রশীদ আন্দোলন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়া নিয়ে ফেসবুকে লিখেছেন:

ছড়িয়ে পড়ছে আগুন শহর থেকে শহরে। এই শত-সহস্র-নিযুত এর একজন হতে চাই আজ শুধু . . .

ব্লগার এবং অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা যুদ্ধাপরাধী আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবীতে মোমবাতি জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করছে। ছবি ফিরোজ আহমেদের। সর্বস্বত্ব ডেমোটিক্স (৬/২/২০১৩)

বিলম্বিত বিচার

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে প্রাণ হারায় ৩০ লক্ষ নিরীহ মানুষ। ধর্ষণের শিকার হন ২ লক্ষ ৫০ হাজারের বেশি নারী। পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে এসব কাজে সহযোগিতা করে এদেশীয় রাজাকার, আলবদর বাহিনীকাদের মোল্লা ছিলেন রাজাকার বাহিনীর নেতৃস্থানীয় সদস্য। সেই সময় তার নেতৃত্বে মিরপুরে গণহত্যা পরিচালিত হয়। স্বাধীনতার ৪২ বছর পরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে সেই সময়কার যুদ্ধাপরাধের বিচার কার্যক্রম চলছে। ট্রাইব্যুনাল এর আগে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বাচ্চু রাজাকারকে ফাঁসি আদেশ দেয়।

ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া

যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন রায় ঘোষণার পর অসংখ্য ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া এসেছে ফেসবুক, টুইটার, ব্লগে। ইলোরা লিলিথ রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধী মুক্ত বাংলাদেশ চেয়ে লিখেছেন:

আগামিকাল ৭ ফেব্রুয়ারি দ্বিপ্রহরে আমার প্রথম সন্তান ভূমিষ্ঠ হবে। ওর প্রজন্ম যেন পায় রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধী মুক্ত বাংলাদেশ। অবিলম্বে কাদের মোল্লা গংদের কেবল মাত্র ফাঁসি হোক।

হযরত বিনয় ভদ্রে টুইটারে ট্রাইব্যুনালের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন রেখেছেন:

@hazratb9bhodroe কয়টা খুন প্রমাণ হইলে ফাঁসি দেউন যায়, মাননীয় ট্রাইবুনাল?

কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে অভিযোগ

যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ৬টি অভিযোগ ছিল। এর মধ্যে তিনটিতে সংশ্লিষ্টতা, এবং দুটিতে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ আদালতে প্রমাণিত হয়েছে। একটিতে বেকসুর খালাস পেয়েছে। তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ ৬টি ছিল:

(১) ১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল তার নির্দেশে মিরপুর বাঙলা কলেজের ছাত্র পল্লবকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
(২) ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ সহযোগীদের নিয়ে কবি মেহেরুননিসা, তার মা এবং দুই ভাইকে মিরপুরের বাসায় হত্যা করেন।
(৩) ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ সহযোগীদের নিয়ে সাংবাদিক খন্দকার আবু তালেবকে আরামবাগ থেকে তুলে নিয়ে জল্লাদখানা পাম্পহাউসে নিয়ে জবাই করে হত্যা করা
(৪) ১৯৭১ সালের ২৫ নভেম্বর রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে কেরানীগঞ্জের ভাওয়াল খানবাড়ি এবং ঘাটারচরে শতাধিক গ্রামবাসীকে হত্যা।
(৫) ১৯৭১ সালের ২৪ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে নিয়ে মিরপুরের আলোকদী গ্রামে গিয়ে ৩৪৪ জনের বেশি মানুষকে হত্যা।
(৬) ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ সহযোগীদের নিয়ে মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনে হযরত আলী লস্করের বাসায় গিয়ে তার নির্দেশে লস্করের স্ত্রী, দুই মেয়ে এবং দুই বছরের এক ছেলেকে হত্যা এবং এক মেয়ে হন ধর্ষণ করা।

রায়ের বিরুদ্ধে আপিল

রায়ের বিরুদ্ধে আপিল কিংবা ফাঁসির দাবি বাস্তবায়ন করা আদৌ সম্ভব কিনা তা নিয়ে শুরুতে সংশয় থাকলেও ব্লগার অমি রহমান পিয়াল ফাঁসির দাবি আদায়ের একটি যৌক্তিক সুযোগের কথা তুলে ধরেছেন:

কেরানিগঞ্জের যে গণহত্যার অভিযোগ থেকে কাদের মোল্লা খালাস পেয়েছে সেই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল। আর এই আপিল করার জন্য সরকারি প্রসিকিউশনকে বাধ্য করতে হবে এই আন্দোলনের মাধ্যমে। ৩৪৪ জন মানুষ মারা গেছে। আর কাদের মোল্লা মানুষ জবাই করতো। এই রকম নির্মম খুনীর শাস্তি স্রেফ যাবজ্জীবন হতে পারে না।…

ইতোমধ্যে কাদের মোল্লার সাজা বাড়াতে আপিল করার ‘নীতিগত সিদ্ধান্ত’ নিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-এর প্রসিকিউশন। বাংলাদেশ পৃথিবীর সেই ৫৮টি দেশের একটি যারা এখনও সাজা হিসেবে মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছে।

Exit mobile version