ইউক্রেনঃ আনা বৈকোর জীবন কাহিনী

আমি তোমাদের আমার দাদী- বৈকো আনা সম্পর্কে বলতে চাই। তার জন্ম হয়েছিল আইভানো-ফ্রাঙ্কিভ্স্ক ওব্লাস্টের রোগাতিন জেলার ইয়াগ্লুশ গ্রামে এবং তিনি সেখানেই বসবাস করেন। আনা হাসিখুশি, মেধাবী আর শক্তিশালী ব্যক্তিত্বের অধিকারী, যিনি অনেক জ্ঞান ও স্মৃতির মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করেছেন এবং তা অর্জন করেছেন।

এভাবেই আনা বৈকোর নাতনী ওলিয়া সুপ্রান তার ব্লগ “আনা বৈকোর জীবন কাহিনীশুরু [ইউক্রেনীয় ভাষায় ] করেন। অনলাইনে ওলিয়া তার দাদীর পরিবারসহ ইয়াগ্লুশের অন্যান্য অধিবাসীদের জীবনের নানা কাহিনী জানান।

তার দাদীর নিজ গ্রাম ইয়াগ্লুশের অবস্থান বর্তমান পশ্চিম ইউক্রেনের আইভানো-ফ্রাঙ্কিভ্স্ক অঞ্চলে। ১৭৭২ সাল থেকে এই অঞ্চলটি অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর স্বল্প সময়ের জন্যে এটি পশ্চিম ইউক্রেন প্রজাতন্ত্রের অংশে পরিণত হয়। ১৯২০ থেকে ১৯৩০ দশকের শেষাংশ পর্যন্ত যুদ্ধমধ্যবর্তী সময়ে তা পোল্যন্ডের অংশ হয়ে দাঁড়ায়। এটি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রথমে সোভিয়েত এবং পরবর্তীতে নাৎসী দখলে ছিল, আর ইউক্রেনের স্বাধীনতা লাভের আগে ১৯৪৪ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত, এটি পুনরায় সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশে পরিণত হয়েছিল।

স্বামী মিখাইলোর সাথে আনা বৈকো। ওলিয়া সুপ্রানের স্ক্যান করা ছবি, অনুমতি গ্রহণের মাধ্যমে এটি ব্যবহার করা হয়েছে।

নাতনী ওলিয়া সুপ্রানের ধারণ করা আনা বৈকোর স্মৃতি ফিরে যায় ১৯৩৯ সালে এবং তা ইয়াগ্লুশের অধিবাসীদের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে পোলিশ থেকে সোভিয়েত শাসনে পরিবর্তন এবং কালক্রমে সোভিয়েত শক্তির ফিরে আসার অভিজ্ঞতার কথা বলে। তাদের স্মৃতি নাৎসী দখলদারিত্ব, কমিউনিজমের প্রাথমিক পর্যায়ের অত্যাচার ও দেশ থেকে তাদের বিতাড়িত করা, ইউক্রেনীয় বিপ্লবী বাহিনীর সমর্থকদের পরিণতির মতো ইউক্রেনের ইতিহাসের কষ্টকর বিষয়গুলো ছুঁয়ে যায়।

এভাবেই আনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে গ্রামবাসীর জীবনের বর্ণণা দিয়েছেন [ইউক্রেনীয় ভাষায় ] :

রাজনীতির বিষয়গুলোও তখন ছিল অস্থিতিশীল। [জনগণ] তাদের কাছে পোল্যান্ডের শাসনের চেয়েও ভাল সময় আশা করছিল। কিন্তু তা আর আগের চেয়ে আরো ভাল হয়নি। নাগরিকরা গ্রেপ্তার হতে থাকল ও তাদের নামে মামলা হতে থাকলো। কিছু কিছু পরিবারকে সাইবেরিয়ায় পাঠিয়ে দেয়া হল। পোল্যান্ড থেকে জাখারি জ্লিউকোভ্স্কি, দুৎকা এবং আরো কয়েকটি পরিবার আবার এখানে ফিরে এল। ভূস্বামীদের জমি বণ্টন করে দেয়া হল এবং [আমার] মা পেল সামান্য কয়েক শত [বর্গ মিটার] জমি। কিন্তু ভাল রাস্তা না থাকায় বৃষ্টির সময় কাদামাটির সেই জমিতে যাওয়া যেত না।

[…]

এদিকে জার্মানদের সাথে যুদ্ধের সময় ঘনিয়ে আসছিল। আমার মনে আছে, সেদিন ছিল রবিবার এবং রৌদ্রোজ্জ্বল এক দিন। দাদি বাড়িতে এক প্রতিবেশীর সাথে আলাপ করছিলেন। মুরগিগুলোকে ছেড়ে দিতে আমি উঠোনে গিয়েছিলাম […]। হঠাৎ [আমি] একটা বিকট বজ্রের আওয়াজ শুনলাম – একটা, তারপর আরেকটা। আমি দৌড়ে ঘরে গিয়ে দাদিকে বললাম, “দাদি, মুরগিগুলোকে ঘরে আনো, ঝড়বৃষ্টি আসছে!“ অথচ তখন আকাশ ছিল পরিষ্কার- কোন মেঘ ছিল না, কোন ঝড়ও দেখা যাচ্ছিল না। শিগগিরই মা বাড়িতে এসে বললেন, তিনি কোন এক গ্রামে শুনেছেন যে যুদ্ধ শুরু হয়েছে! এটা বজ্রের আওয়াজ নয়, বোমা পড়ার শব্দ। সেদিন থেকেই সমস্ত লোকজন খুব সতর্ক হয়ে গেল। এটা ছিল ১৯৪১ সাল।

দাদির কষ্টকর শৈশব সত্ত্বেও ওলিয়া তাকে জ্ঞানসম্পন্ন ও কৌতূহলী ৭৫ বছর বয়েসী এমন মহিলা প্রতিপন্ন করতে পেরেছিল যিনি কবিতা ও স্মৃতিকথা লিখেন, সুন্দর সূচীকর্ম করেন, কম্পিউটার গেম খেলেন আর রান্না উপভোগ করেন। তিনি গ্রামবাসীদের ঐতিহ্য ও রীতির প্রতি বিশেষ মনযোগ দেয়ার পাশাপাশি মাঝেমাঝেই আনার সাথে কবিতা, রন্ধনপ্রণালী আর গ্রামবাসীদের প্রতিদিনের গল্প ভাগাভাগি করেন।

বড়দিনের সন্ধ্যায় নৈশভোজের জন্যে আনা বৈকোর তৈরী ১২-পদের ঐতিহ্যবাহী রান্না। ওলিয়া সুপ্রানের ছবি, অনুমতি গ্রহণের মাধ্যমে ব্যবহার করা হয়েছে।

একাট পোস্টে ওলিয়া স্বীকার করেছেন [ইউক্রেনীয় ভাষায় ] ব্লগিং ও বুঝতে পারার ক্ষেত্রে নতুন হওয়ার কারণে তার ব্লগ একটু অন্যরকম:

আমি জানি এসব ব্লগ একটু অদ্ভুত ও অন্যরকম ধাঁচের; পটভূমিতে একটা অচেনা, অজানা বাড়ি, অজনপ্রিয় নানা কাহিনী, যেসবের অর্থ খূঁজে পাওয়া কঠিন। তদুপরি সেগুলোর রচয়িতা – আমার দাদী – যিনি এই ব্লগের রচয়িতা নন। … কিন্তু এগুলো রেটিং বা মুনাফার জন্যে নয়; বরং প্রতিটি লাইন পড়ে এগুলোর মর্মার্থ অনুধাবন করার জন্যে।

আনা বৈকো তার স্বামীর সঙ্গে একত্রে তার সম্পর্কে লেখা একটি ব্লগ পড়ছেন। ওলিয়া সুপ্রানের ছবি, অনুমতি গ্রহণের মাধ্যমে ব্যবহার করা হয়েছে।

তারপরও মনে হচ্ছে ইতোমধ্যে আনা বৈকোর জীবন কাহিনীর জনপ্রিয়তা, এর রচয়িতার প্রত্যাশাকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। ২০১১ সালে এটি সেরা ইউক্রেনীয় ব্লগ পুরস্কার [ইউক্রেনীয় ভাষায় ]-এ সেরা ব্যক্তিগত ব্লগ বিবেচিত হয়েছে এবং এর পাঠক ও সমর্থকদের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে।

Exit mobile version