গত ৮ই আগস্ট চীনের নিয়ন্ত্রণাধীন তিব্বতের গানসুর ঝোউকুতে এক ভূমিধস ঘটে। সরকারি সংবাদপত্র শিনহুয়ার সংবাদ অনুসারে এই বিপর্যয়ে এখন পর্যন্ত ১২৭ জন লোক মারা গেছে এবং ১,২৯৪ জন লোক নিখোঁজ রয়েছে।
যেহেতু সরকারি প্রচার মাধ্যমগুলোতে এ ব্যাপারে সীমিত সংবাদ প্রকাশ করা হচ্ছে। বিপর্যয় ঘটার পরপরই উয়েসার টুইটারের মাধ্যমে যৌথ অনুসন্ধানের বিষয়টির সমন্বয় সাধন করছে। টুইটার ব্যবহারকারীরা ফোন করেছে, অতীতের সংবাদ এবং তথ্যগুলো বের করেছে এবং তারা আবিষ্কার করে যে এই ভূমিধসের কারণ ১) জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ; ২) খনি খনন করা; ৩) বন উজাড় করা। সংক্ষেপে বলা যায় এটা হচ্ছে মানব সৃষ্ট বিপর্যয়।
জলবিদ্যুৎ প্রকল্প এবং স্বর্ণ অনুসন্ধান
ভারী বর্ষণ ছাড়াও এই ভূমিধসের প্রধান কারণ ছিল এই এলাকায় বেশ কিছু জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ।
তিব্বতের স্বায়ত্তশাসিত গানসু ঝোউকু জেলায় ২০টি শহর রয়েছে এবং সেখানকার বাসিন্দা ১৩,০০,০০০ জন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই এলাকায় ৪৭ টি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করার পরিকল্পনা নেওয়া হয় এবং যতদুর জানা যায় ১৫ টি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে, যার মধ্যে বাকং ও লি জিয়ে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র অর্ন্তভুক্ত, এছাড়া ১৪টি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণাধীন অবস্থায় রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ফুজিয়াই, লিয়ানহেকু জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র। স্থানীয় তিব্বতীয় সূত্র বলছে যে অসংখ্য নির্মাণ পরিকল্পনার কারণেই ভূমিধস ঘটেছে, যা এই এলাকার প্রতিবেশ ব্যবস্থার ধ্বংস সাধন করেছে। তারা এই ব্যাপারে আরো সচেতনতা বৃদ্ধির আবেদন জানায়।
২০০৩-২০০৭ সালের মধ্যে ৫৩টি জল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪১টি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র হয় নির্মিত হয়েছে অথবা সেগুলো নির্মাণাধীন অবস্থায় রয়েছে। এর মধ্যে ১২টি শীঘ্রই চালু হবে। এই সকল প্রকল্প একসাথে প্রদেশের প্রায় ৮০ শতাংশ বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারবে। ৪১টি প্রকল্পের জন্য মোট ৩২২.৮৩ বর্গ হেক্টোমিটর এলাকা ব্যবহার করা হয়েছে এবং এই প্রকল্পে যে আবর্জনা তৈরি হয়েছে তা ৩২২.৮৩ মিলিয়ন কিউবিক মিটারে এসে দাঁড়িয়েছে। এই সব কারণে পানি নষ্ট হওয়া এবং মাটির ক্ষয় সাধনের পরিমাণ ৭৪৯ হাজার টনে এসে দাঁড়িয়েছে।
এই নির্মাণ প্রকল্প ছাড়াও এই এলাকায় খনন কাজ চালানো হয়েছে।@ডোগারাফের জানাচ্ছে:
অনেক বছর ধরে ঝোউকু এলাকায় খনন কাজ চালানো হয়েছে। পাহাড়ি এলাকার সকল গাছ কেটে ফেলে হয়েছে এবং সেখানকার বাতাসে কালো ধুলা উড়তে দেখা যায়। স্বর্ণ অনুসন্ধানে মধ্যে দিয়ে নদীর পানি দুষিত করা হয়েছে এবং এখন সেই পানি ঘোলা হয়ে গেছে। শহরটির অবস্থান গ্রাম যে পাহাড়ে অবস্থিত তার নীচে। এগুলো খাড়ি এবং বিপজ্জনক ঢাল দিয়ে ঘেরা। কিছু কিছু ভবন ঢালের উপর নির্মাণ করা হয়েছে। অনেক বছর আগে আমি এলাকায় গিয়েছিলাম। এলাকাটি মানুষ্য বসবাসের উপযোগী নয়। প্রকৃতপক্ষে ২০০৮ সালে শহরটিতে ৫১২ বার ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে।
@বিমাওয়েন একটি গুগল মানচিত্র পোস্ট করেছে যেটিতে ঝোউকু শহরটির ভূ-প্রকৃতি দেখানো হয়েছে এবং এখানে তুলে ধরা হয়েছে যে এই বিপর্যয় সরকারি পর্যবেক্ষণের অভাবের কারণে ঘটেছে:
ঝোউকুতে যা ঘটেছে তা কি প্রাকৃতিক, নাকি মানুষের সৃষ্টি বিপর্যয়? মানচিত্রের দিকে এক নজর চোখ বুলাই: সাধারণ ধারণা যা বলে তাতে দেখা যায় ভূমিধ্বস ঘটে হ্রদ/বাঁধের কোন বাধা থাকলে। সাধারণত কোন বাঁধকে ভাঙ্গতে পানির স্রোতের খানিকটা সময় লাগে। এই ঘটনার সময় প্রচার মাধ্যম কোথায় ছিল? রাষ্ট্রীয় রেডিও, চলচ্চিত্র, এবং টেলিভিশন সংস্থা তখন কোথায় ছিল (স্টেট এ্যাডমিনিস্ট্রেশন অফ রেডিও, ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন বা সারফট তখন কোথায় ছিল? সকল ফোন লাইন এবং তার বিহীন (ওয়্যারলেস) যোগাযোগ ব্যবস্থা তখন কোথায় ছিল? তখন সকল মাইক্রো-ব্লগাররা কোথায় ছিল? এ ধরনের এক বিপর্যয়ের ফল হল তথ্য প্রবাহ বন্ধ করে ফেলা।
বিশেষজ্ঞ এবং প্রচার মাধ্যমের সংবাদ থেকে পাওয়া সতর্ক বার্তা
বাস্তবে ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিশেষজ্ঞ এবং প্রচার মাধ্যমের করা অনেক সতর্ক বার্তা আমরা দেখতে পাচ্ছি। টুইটারার (যিনি টুইটারে টুইট বা বার্তা পাঠান) হিউম্যান ফ্লেশ ইন্টারনেট অনুসন্ধান করেছেন এবং বেশ কিছু সংবাদ এবং গবেষণা আবিষ্কার করেছেন, যেগুলো ঝোউকু প্রদেশের বাইলং নদীর ভূমি ক্ষয় সমস্যার ব্যাপারে সর্তক করে দিয়েছিল। পানি সম্পদের উপর এ রকম একটি সংবাদ জানাচ্ছে:
ঝোউকু প্রদেশের পানি দুষিত হওয়া এবং ভূমি ক্ষয় সমস্যা গভীর আকার ধারণ করেছে। বাইলং নদীর তীরবর্তী এলাকার পরিবেশ এবং প্রতিবেশ (ইকোলজি) ধ্বংস হয়ে গেছে এবং এই খারাপ পরিস্থিতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বন্যা, ভূমিধস, কাদা ধস এবং সকল প্রকার প্রাকৃতিক বিপর্যয়। এটি স্থানীয় বাসিন্দাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এখানকার পাহাড়গুলো একেবারে নড়বড়ে হয়ে গেছে এবং এগুলো ভূমিধ্বস ও নরম মাটি বা কাদাধসের মত প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে। বন উজাড়, খনির যাবতীয় কার্যক্রম, জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ এবং অন্য সব উন্নয়ন কার্যক্রমের ফল হচ্ছে এই সব বিপর্যয়।
২০০৮ সালে ছাপা হওয়া এক সংবাদে জানা যায় যে ঝোউকু এলাকা এক সময় নদী এবং বন পরিবেষ্টিত এক মানব স্বর্গ ছিল:
৫০ থেকে ৮০র দশক পর্যন্ত ঝোউকু ছিল গানসুর ঝিয়াং নান (ঝিয়াং নান দক্ষিণ চীনের সবচেয়ে সমৃদ্ধ এলাকা), যা বন দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল। তবে গাছ কাটার মত কার্যক্রমের ফলে পাহাড়ের ঢাল ভূমি ক্ষয়ের কারণে উন্মুক্ত হয়ে পড়েছে এবং যার ফলে বর্ষার সময় প্রায়শই ভূমিধ্বস ঘটছে।
@ট্রাইটুফিল ২০০৮ সালে আরেকটি নতুন সংবাদ পেয়েছেন যা ঝোউকু এর ভূমিধসের কারণ বর্ণনা করছে।
২০০৮ সালের সংবাদ: ঝোউকু এলাকায় ৬০টির মত ভূমিধস ঘটেছে, এর মধ্য ১৩টি ছিল ভয়াবহ যা স্থানীয় বাসিন্দাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। ভূমিধসের সমস্যাকে ভূমিকম্প পুন: নির্মাণ কর্মকাণ্ডের দ্বারা নিবারণ করতে হবে।
মানব সৃষ্ট প্রতিবেশ বিপর্যয়ের ইতিহাস
গাছ কাটার ইতিহাস শুরু হয় ১৯৫৮ সালে, যে বছরটিকে লাফিয়ে সামনে এগিয়ে যাবার বছর বলে অভিহিত করা হয়:
সেই ১৯৫৮ সাল থেকে ঝোউকু এর প্রাকৃতিক সম্পদ উজাড় করা শুরু হয়েছে। যে সময় থেকে চীনের লাফিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার শুরু। ঝোউকু এর বন মন্ত্রণালয়ের প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে ১৯৫২-১৯৯০ সালের মধ্য ১.৮৯৭৫ মিলিয়ন মিইউ পরিমাণ (মিইউ চীনা ভূমি পরিমাপক, ১০০ মিইউ=০.১৬৪৭ একর প্রায়) বন ধ্বংস করা হয়েছে। প্রাকৃতিক বন দ্বিতীয় স্তরের কৃত্রিম বনে পরিণত হয়েছে। এছাড়াও, অবৈধ গাছ কাটার কারণে বছরে ১০০ হাজার বর্গ মিটার বন ধ্বংস হচ্ছে। এর ফলে ঢাল রক্ষার যে প্রতিবেশ ব্যবস্থা তা পুরোপুরি বিনষ্ট হয়ে গেছে।