বাংলাদেশঃ ফেসবুকের উপর সরকারের নজরদারি ও অনলাইন বিতর্ক

বেশ কিছুদিন ধরে, বাংলাদেশের সামাজিক মিডিয়া স্পেস দেশের কর্তৃপক্ষের নজরে রয়েছে এবং বিশেষ করে ফেসবুক ব্যবহারকারীরা নানান বিতর্কে জড়িয়ে পরছেন।

এ বছর জানুয়ারিতে যখন সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশের সরকারকে উৎখাত করার একটি প্রচেষ্টা যখন গুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল, তখন জানা গিয়েছিল যে ষড়যন্ত্রকারীরা তাদের সমর্থন আদায়ের জন্যে যেসব পদ্ধতি ব্যবহার করেছিল তার মধ্যে ফেসবুক ছিল অন্যতম। সরকার এতে নড়েচড়ে বসে এবং সাবধান হয়, এতই যে, ইদানিং ফেসবুকে সরকারের বিরুদ্ধে যে কোনও আলটপকা মন্তব্যই কাউকে কর্তৃপক্ষের রোষানলে ফেলতে যথেষ্ট এবং পরিনামে গ্রেফতার বা অন্য শাস্তি ভোগের নিদর্শন দেখা গেছে।

এরকম একটি উদাহরণে দেখা যায় যে বাংলাদেশী নাগরিক ঢাকার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রুহুল আমিনকে সম্প্রতি দেশের এক উচ্চ আদালত ৬ মাসের জেলের সাজা প্রদান করে যখন তার ফেইসবুক স্ট্যাটাস আপডেট নিয়ে মামলায় তিনি আদালতে হাজিরা দিতে ব্যর্থ হন। জনাব আমিন বর্তমানে অষ্ট্রেলিয়াতে শিক্ষাছুটিতে আছেন এবং তার এক ফেইসবুক স্ট্যাটাসে তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যু কামনা করেছেন বলে অভিযোগ আসার পর তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা হয়। আরেকটি ঘটনায় একজন কলেজ ছাত্রকে গ্রেফতার করা হয় প্রধানমন্ত্রী ও তার পিতা, তথা বাংলাদেশের জাতির জনক শেখ মুজিবর রহমানের বিরুদ্ধে কিছু “অপমানজনক মন্তব্য” করার অভিযোগে। এইসব ঘটনাবলী এবং এ নিয়ে সরকারের কঠোর অবস্থান অনেক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে অনলাইন এবং অফলাইন জগৎে।

ব্রায়ান্ট আর্নল্ড এর মূল কার্টুন থেকে রিমিক্স করা। সিসি – বাই/এনসি

রুহুল আমিনকে নিয়ে বিডিনিউজ ব্লগের সংবাদ আর্টিকেলে ব্লগার “মুখোশ পরা সাধু” লিখেছেন:

আমাদের দেশের রাজনীতেবিদের প্রতি সাধারণ মানুষের যে প্রচন্ড ক্ষোভ তারই বহি:প্রকাশ এটা। অনেকেই তা গণমাধ্যমে প্রকাশ করতে পারেন না। কিন্তু বর্তমানে “ফেইসবুক” অলিখিত অত্যন্ত শক্তিশালী গণমাধ্যমে পরিনত হচ্ছে। এর কারণ আমাদের সংবাদ পত্রের “হলুদ সাংবাদিকতা”।

হাসান সোনার বাংলাদেশ ব্লগে তার উদ্বেগ জানিয়েছেন:

ফেসবুকে স্ট্যাটাসও দেওয়া যাবেনা- এ কোন সময়ে আমরা? কারাগারে বন্দী আজ মত প্রকাশের অধিকার…বর্তমান বিশ্বে সামাজিক যোগাযোগের পাশাপাশি মতামত প্রকাশ, জনমত গঠন ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ক্ষেত্রেও ফেসবুকের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তার প্রমাণ সাম্প্রতিক মিশর ও মধ্যপ্রাচ্যের আন্দোলন। যতই দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাক না কেন – মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত শিক্ষকের স্ট্যাটাসটি এরকম না হলেই শোভন হত। তবে অশোভন বক্তব্য তো আমাদের জাতীয় দুর্বলতায় পরিণত হয়েছে। তবে একজন সরকারের বিরুদ্ধে কিছু বললেই তার বিরুদ্ধে লেগে যেতে হব এমন করাটাও ঠিক না।

অয়ন কুয়েটব্লগে মন্তব্য করেছেন:

স্ট্যাটাস দিবেন ভেবে চিন্তে, নইলে পুলিশে ধরপে!

তবে সবাই যে অভিযুক্তের পক্ষে রায় দিচ্ছেন তা নয়। অনেক ব্লগার এইসব স্ট্যাটাস আপডেটের সমালোচনা করেছেন, বিশেষ করে যেহেতু সেগুলি দায়িত্ববান নাগরিক কর্তৃক (রুহুল আমিনের ক্ষেত্রে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কর্তৃক) করা সমিচীন নয় বলে মনে করা হচ্ছে।

ব্লগ বিডিনিউজের উপরোল্লিখিত আর্টিকেলে মোশাররফ মন্তব্য করেছেন:

এইসব শিক্ষক দের কাছ থেকে ছাত্ররা কী শিখবে? এরা ছাত্রদের ঘুষ, দুর্নীতি, যাবতীয় খারাপ কাজ শেখায়।

মাহতাব জানিয়েছেন:

শেখ হাসিনাকে কেউ পছন্দ না ই করতে পারেন সেটা তার ব্যাক্তিগত ব্যপার কিন্ত হাসিনা যে চেয়ার বা পদ এ বসে আছেন সেই পদের তো সন্মান আছে। এই সাধারণ বিষয় যিনি বুঝেন না তিনি তো প্রাইমারী স্কুল এর শিক্ষক হবারই যোগ্যতা রাখেন না। তিনি কি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের এর শিক্ষক হন। স্টুপিড।

ব্লগারদের মধ্যে রুহুল আমিনের ৬ মাসের জেল এর রায় নিয়ে কিছু দ্বিধাদ্বন্দ্ব রয়েছে। মেঘবন্ধুর মত ব্লগার এই শাস্তি তার ফেসবুকের মন্তব্যের জন্যেই হয়েছে বলে ভাবছেন এবং মন্তব্য করেছেন:

সত্যি অবাক লাগে এ কেমন দেশে বাস করি? যেখানে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বুশ'কে জুতা মেরে তেমন কোন সাজাই পায়নি ইরাকের সেই বিখ্যাত সাংবাদিক, সেখানে শুধুমাত্র ফেসবুক স্ট্যাটাস দেয়ার কারনে এই অবস্থা!!!

তবে, হাসান কালবৈশাখীর মত অন্যেরা তাদের ভুল শুধরিয়েছেন এবং ব্যাখ্যা করেছেন:

ওনার শাস্তি হয়েছে ফেসবুকে মৃত্যু কামনার জন্য নয়। মৃত্যুকামনা মামলায় উনি সরি বললেই মাফ পেয়ে যেতেন। আদালত কে অবজ্ঞা করার কারনে ওনার এই শাস্তি।

আদালত অবমাননার অভিযোগে রুহুল আমিনের শাস্তির পরে, সবাই আগ্রহভরে অপেক্ষা করছে যে মূল ফেইসবুক স্ট্যাটাস মামলার রায় কি হয়, তা জানার জন্য। এই মামলা বাংলাদেশের বাক স্বাধীনতার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। বর্তমান সরকার দেশের নাগরিকদের একটি ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। অনেকে মনে করছেন যে এই মামলার রায় ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন এবং বাক স্বাধীনতা – উভয়ের উপরই নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। রুহুল আমিন জানিয়েছেন যে তার ফেইসবুক ব্যবহার করতেই এখন ভয় হয়

সম্প্রতি আরেক ঘটনায়, কর্তৃপক্ষ ব্লু ব্যান্ড কল নামে একটি ফেইসবুক গ্রুপ এর একটি সমাবেশ ভণ্ডুল করে দেয়। এটি কিছু যুবাদের একটি প্রয়াস ছিল দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে “পরিবর্তনের এজেন্ট” হিসেবে প্রভাবিত করতে যুবসমাজকে উদ্বুদ্ধ করার। যদিও কর্তৃপক্ষ বলছেন যে এই দল উন্মুক্ত সমাবেশ করার জন্যে প্রয়োজনীয় অনুমতি নেয়নি, দলের মুখপাত্রদের মন্তব্য ছিল অন্যরকম।

প্রজন্ম ফোরামে এই নিয়ে সংবাদ দেন উপল বাংলাদেশ:

সরকার মনে হয় আজকাল সবকিছুতেই “ভূত” দেখা শুরু করেছে।

এদিকে সরকারের তরফ থেকে ইন্টারনেটের উপর নজরদারি শিথিল করার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। বরং বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি) দেশের অভ্যন্তরীন সাইবার ক্রিয়াকলাপের উপর সার্বক্ষনিক নজরদারি করার জন্যে একটি বিশেষ সেল গঠন করার কথা ঘোষণা করেছে। এই নতুন উদ্যোগ সাধারণ মানুষের জীবনে কি প্রভাব ফেলে তা দেখার অপেক্ষায় রয়েছে সবাই।

Exit mobile version