সাভার ট্র্যাজেডি: মানুষের পাশে মানুষ

গত ২৪ এপ্রিল বাংলাদেশের সাভারে একটি নয়তলা পোশাক কারখানা ধসে পড়লে তাতে আটকা পড়ে কয়েক হাজার শ্রমিক। (গ্লোবাল ভয়েসেস এর রিপোর্ট দেখুন)। এরপর শুরু হয় মহা কঠিন উদ্ধার তৎপরতা এবং আজ পর্যন্ত ২৮৩৪ এর ও বেশী লোককে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। আজ বুধবার পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা এসে দাড়িয়েছে ৩৯৭ এবং হাজারেরও বেশী আহতদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষরা বলছেন যে এখন পর্যন্ত আরও ১৪৯ জন নিখোঁজ রয়েছে

উদ্ধারস্থলে হাজারেরও বেশী সেনাবাহিনী, দমকল বাহিনী ও অন্যান্য সংস্থার উদ্ধারকারীদের নিয়োজিত করা হয়েছিল প্রথমদিনই। অভিযোগ উঠেছে যে সরকার উদ্ধার কাজে বিদেশী সাহায্য নিতে অস্বীকার করেছে যারা আধুনিক যন্ত্রপাতি ও অভিজ্ঞ উদ্ধারকর্মী দিতে চেয়েছিল। সরকার অবশ্য বলেছেন যে দেশীয় জনবল ও যন্ত্রপাতি দ্বারাই উদ্ধারকার্য ভালভাবে সম্পন্ন করা গেছে।

উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয়া একজন সাধারণ কর্মী। দেয়াল কেটে ভিতরে ঢুকেছেন তারা। ছবি রেহমান আসাদ। স্বত্ব: ডেমোটিক্স (২৪/৪/২০১৩)।

তবে সরকারি সংস্থাগুলোর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আটকে পড়া শ্রমিকদের উদ্ধারে অংশ নেন সাধারণ মানুষেরাও। নিরাপত্তা সংস্থার কর্মীরাও যেখানে যেতে ভয় পেয়েছেন, সেখানে বুক চিতিয়ে গেছেন এরাই। উদ্ধার কাজে অংশ নেয়া সাধারণ মানুষের অসীম সাহসিকতার গল্প রয়েছে এই আর্টিকেলে।

কেউ ছাত্র, কেউ রাস্তার ফেরিওয়ালা, কেউ রাজমিস্ত্রি, কেউ খেটে খাওয়া শ্রমিক, আবার কেউবা আটপৌরে গৃহিনী। খুব সাধারণ মানুষ তারা। তাদের না ছিল প্রশিক্ষণ, না ছিল নিরাপত্তা প্রস্তুতি, না ছিল দরকারি যন্ত্রপাতি। তবে তারাই কি না রাখলেন সাহসী ভূমিকা- ধ্বংসস্তুপের ভিতরে গিয়ে উদ্ধার করে আনলেন হাজারো আহত, নিহত পোশাকশ্রমিকদের।

ব্লগার আরিফ আর হোসাইন উদ্ধার কাজের শুরু থেকেই ছিলেন। তিনি কাছ থেকে দেখেছেন উদ্ধার কাজে সবার অংশগ্রহণ। তিনি ফেসবুকে লিখেছেন একজন খুব সাধারণ এক মায়ের কথা, যিনি ভবন ধসের পরেই খুন্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন উদ্ধার কাজে:

সর্বপ্রথম এগিয়ে এসেছিলেন লিটনের মা, খুন্তি নিয়ে…এমনভাবে দৌড়ে এসেছিলো যে পারলে তিনি তার হাতের খুন্তিটা দিয়েই সব ধসে পড়া ছাদগুলোকে আল্গি দিবে।
কালকে ওখানে আমি দাঁড়িয়ে হঠাত্ শুনলাম, দমকলের এক কর্মীকে বলতে, “কেউ একটা ডাইলের চামচ দেন আমাকে… নিচে একজনকে দেখা যাচ্ছে… ওকে পানি খাওয়াতে হবে।”

উদ্ধারকর্মীরা একজন গার্মেন্টস শ্রমিককে টেনে তুলছেন। ছবি রেহমান আসাদের। সর্বস্বত্ব: ডেমোটিক্স (২৬ এপ্রিল ২০১৩)।

দেশের নানা প্রান্ত থেকে মানুষ এসে অংশ নিয়েছেন আটকেপড়া পোশাকশ্রমিকদের উদ্ধার কাজে। ব্লগার আরিফ জেবতিক জানাচ্ছেন ভৈরব থেকে আসা দুই রাজমিস্ত্রির কথা, যারা তার গাড়িতে উঠেছিল সাভার যাবার জন্যে:

দুইজনের হাতে বড় দুই ঝোলা। এতরাতে এসব দেখে সন্দেহ হলো গাড়িতে বসা একজনের। সে সোজাসাপ্টা লোক। সোজা বলে বসলো, ‘ঝোলা দেখান, দেখি ঝোলাতে কী ঝনাত্ ঝনাত শব্দ করে। মাঝরাতে গাড়িতে তুলবো আর গলা কাইটা ফালায়া যাবেন, তা হবে না।’ ঝোলা পরীক্ষা করে দেখা গেল সেখানে ছেনি-বাটাল আরো কী কী দেশি যন্ত্রপাতি!
জানা গেল এরা পেশায় রাজমিস্ত্রি, তবে মূল কাজ পুরোনো ভবন ভেঙ্গে বিক্রি করা দলে শ্রম দেয়া। কাজ করছিলেন ভৈরবে, কিন্তু সাভারের খবর পেয়ে মন মানেনি, নিজেদের কাজ শেষ করে রওনা দিতে অনেক রাতই হয়েছিল, অন্যরুটের বাস ধরে আপাতত গাজীপুরের এই জংশনে নেমে পড়েছেন। সাভারের জন্য কোনো গণপরিবহনের অপেক্ষা করছেন। সাভারের এই কারখানাগুলোতে তাদের কেউ কাজ করে না, কিন্তু তারা এসেছেন বিবেকের দায়ে।
এদের মধ্যে প্রৌঢ়জন দাঁতমুখ শক্ত করে বললেন, ‘২১ বছর বিল্ডিং ভাঙ্গার কাম করি। এই বিপদে আমি না থাকলে কে থাকব কন?’

নয়তলা ভবনের ধসে যাওয়া ছাদগুলো। এর মাঝখানে আটকে ছিল অসংখ্য কর্মীরা। ছবি ফিরোজ আহমেদের। সর্বস্বত্ব: ডেমোটিক্স (২৬ এপ্রিল ২০১৩)

উদ্ধারকারী একজনের ছবি ফেসবুকে শেয়ার করেছেন মহাপুরুষ শোয়েব। উনার নাম বাবু। তিনি একাই ধ্বংসস্তুপের ভিতরে আটকেপড়া ৩০ জনকে উদ্ধার করেছেন। এজন্য তিনি নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভবনের একেবারে ভিতরে ঢুকে পড়েছিলেন। তিনি তার অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন এভাবে:

ইটের স্তুপ সরিয়ে ৮ তলা থেকে একেবারে ৬ তলা পর্যন্ত নেমে আসি। সঙ্গে আরো দুজন ছিল। সেখানে ৫০ থেকে ৬০ জনের লাশ দেখতে পেলাম। লাশের স্তুপের মধ্যে থেকেই একজন হাত ধরে বললো, আমাকে বাঁচান। টেনে তাকে বাইরে বের করে নিয়ে আসি।

বাবু উদ্ধার করতে গিয়ে নিজের অসুস্থ হয়ে পড়েন একপর্যায়ে। তবে সুস্থ হয়ে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

আহতদের চিকিত্সা দিয়ে অনন্য নজির স্থাপন করেছে সাভারের এনাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। এই কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র মারুফ রায়হান খান দেখেছেন আহত মানুষের অবস্থা। তিনি ডক্টরসক্যাফেতে লিখেছেন:

[…] অ্যাম্বুলেন্স করে এতো মানুষ আসছে কেন? কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করতেই জানা গেল। কি অবস্থা একেকজন রোগীর! তাকানো যায় না! চোখে জল টলমল করা শুরু করলো।
এক অ্যাম্বুলেন্স থেকে রোগী নামাতে না নামাতেই চলে আসে আরেকটা। যারা উপস্থিত সকলে যেন দিশেহারা। এতো ট্রলি, এতো হুইল চেয়ার আন-নেয়ার লোক কোথায়? কর্মচারীদের সাথে হাত লাগালো এখানেও ছাত্ররা, আশেপাশের মানুষরাও।

তিনি আহতদের চিকিৎসায় মানুষের রক্ত দান করা নিয়ে লিখেছেন:

তখন রক্ত দরকার, প্রচুর, প্রচুর। একটা টেবিল আর টুল নিয়ে বাইরে বসা হয়েছে। যারা রক্ত দেবে তাদের তালিকা করা হচ্ছে। লিখে কূল পাচ্ছি না। পাশে থাকা আরো দুই লোক আমার সাথে লিখতে থাকলেন। শত শত মানুষ রক্ত দিতে চলে এসেছেন, শুধু সাভার থেকে নয়; বহু দূর-দূরান্ত থেকে। কার আগে কে রক্ত দেবেন, এই নিয়ে প্রতিযোগিতা।

এই দেয়ালে প্রতিদিন যোগ হচ্ছে খুঁজে না পাওয়া মানুষের বৃত্তান্ত। ছবি শুভ্রা রাণী দাস। সর্বস্বত্ব ডেমোটিক্স (৩০/৪/২০১৩)

শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চেও বিপুল সংখ্যক মানুষ রক্ত দিয়েছেন। পানি, স্যালাইন, ঔষধসহ নানা চিকিৎসাসামগ্রী দিয়েছেন। একজন সাধারণ মানুষ ১ বোতল পানি, ১ প্যাকেট বিস্কুট, ১ প্যাকেট স্যালাইন এনেছিলেন আহতদের জন্য। পরিমাণে কম বলে খুব লজ্জা পাচ্ছিলেন। কিন্তু মানুষের পাশে দাঁড়াতে ভোলেননি তিনি। দামি ত্রাণ তহবিল দেয়ার সামর্থ্য ছিল না দুই তরুণের। তাই নিজেদের স্বল্প টাকা মোবাইলে লোড করে দুর্ঘটনাস্থলে গিয়ে দিয়েছিলেন ফ্রি কলিং সুবিধা।

সাধারণ মানুষের এই অভূতপূর্ব সাড়া দেখে পারভেজ আলম লিখেছেন:

রাষ্ট্র যেমনি হউক আমাদের সমাজ পিছিয়ে নাই। এর প্রমাণ গতকালই হয়েছে যখন জনতা নিজ উদ্যোগে লাইন দিয়ে রক্ত দিয়েছে, ঝুঁকি নিয়ে উদ্ধার কাজে নেমে পড়েছে, নিজেরাই যে কয়জনকে সম্ভব বাঁচিয়েছে।

Exit mobile version