লিখেছেন: অ্যারন স্পিটলার
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) কীভাবে বৈশ্বিক অর্থনীতিকে পরিবর্তন করতে পারে, তা নিয়ে ইতিমধ্যেই অসংখ্য লেখা প্রকাশিত হয়েছে। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সম্মেলনের (আঙ্কটাড) এর সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৩৩ সালের মধ্যে বৈশ্বিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বাজারের মূল্য দাঁড়াবে প্রায় ৪.৮ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। এআই–এর সমর্থকদের কাছে এই পূর্বাভাস একটি ইতিবাচক সংকেত যে প্রযুক্তিটি সকল দেশের জন্য আশীর্বাদ হয়ে উঠবে। তবে সংস্থাটি ভিন্ন এক সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে – যে এই খাতের দ্রুত প্রবৃদ্ধি মূলত বিশ্বের উত্তরাঞ্চল বা ধনী দেশগুলোর পক্ষেই কাজ করবে। অপর্যাপ্ত প্রযুক্তিগত অবকাঠামো, সীমিত শিক্ষা সুযোগসহ নানা বাধা বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিপ্লবের সুফল ভোগ করতে বাধা দিচ্ছে। প্রচারণার বাইরে বাস্তবতা হচ্ছে, এই বিভাজন আরও গভীর হতে পারে। তাই এটি দেখা জরুরি যে এআই কীভাবে পৃথিবীকে “যাদের আছে” এবং “যাদের নেই” এই দুই শ্রেণিতে ভাগ করতে পারে।
ক্ষুদ্র স্তরে দেখলে, বিভিন্ন শিল্পক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের বিস্তার নিম্নআয়ের দেশের শ্রমজীবী মানুষের জন্য বিপদের সংকেত দিচ্ছে। বিশেষ করে যেসব কাজ একঘেয়ে বা পুনরাবৃত্তিমূলক হিসেবে বিবেচিত, সেগুলোর স্বয়ংক্রিয়করণের ফলে বিপুল পরিসরে চাকরি হারানোর ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে, যা বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর হাজারো মানুষের জীবিকা বিপন্ন করতে পারে। তবে এআই এর চ্যালেঞ্জ কেবল অর্থনৈতিক ক্ষতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, বর্তমানে যে এআই টুলগুলো সাধারণ মানুষ ব্যবহার করছে, সেগুলোর বেশিরভাগই তৈরি হয়েছে উত্তর গোলার্ধে, যেখানে কেবল কিছু সংখ্যক মানুষের প্রয়োজন ও অগ্রাধিকার প্রতিফলিত হয়েছে। আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, এই প্রযুক্তিগুলো প্রশিক্ষিত হয়েছে এমন ডেটায়, যা দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী সম্পর্কে পক্ষপাতদুষ্ট ধারণা ও প্রচলিত কুসংস্কার বহন করছে। ফলে এই পুরোনো ধাঁচের ধারণাগুলো এখন ডিজিটাল আকারে নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত, যদি এখনই পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে এই এআই এর উত্থান কম সম্পদশালী দেশগুলোর জন্য আশীর্বাদ নয়, বরং অভিশাপ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার জন্ম
এআই শ্রমবাজারকে কীভাবে বদলে দেবে, তা নিয়ে উদ্বেগ এখন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। তবে এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়তে পারে বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর ওপর। ফরেইন পলিসি ম্যাগাজিন এর এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এসব দেশের অনেক প্রতিষ্ঠান খরচ কমানো এবং দক্ষতা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে এখন মানবশ্রমের পরিবর্তে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করার সম্ভাবনা যাচাই করছে। যেসব কাজে উচ্চ দক্ষতা বা বিশেষজ্ঞতার প্রয়োজন কম, সেগুলিই প্রথমে বাদ দেওয়া হচ্ছে। ফলে যেসব শ্রমিকের কাছে প্রয়োজনীয় আধুনিক দক্ষতা নেই, তারা নিজেদের নির্ভরশীল চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে পড়ছেন। উত্তর গোলার্ধের দেশগুলোর তুলনায় এই শ্রমিকদের দক্ষতা বাড়ানোর সুযোগও অনেক কম। পুনঃপ্রশিক্ষণ বা নতুনভাবে দক্ষতা অর্জনের সুযোগ সীমিত হওয়ায় এবং চাকরির প্রতিযোগিতা ক্রমেই বাড়তে থাকায়, বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলের শ্রমিকরা দ্রুত এক অনিশ্চিত ও অস্থির অবস্থার মুখে পড়তে পারেন।
এই অর্থনৈতিক অস্থিরতা এসব দেশের সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থার ওপর যে চাপ সৃষ্টি করবে, সেটিও গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা দরকার। সেন্টার ফর গ্লোবাল ডেভেলাপমেন্ট (সিজিডি) এর এক ব্লগে উল্লেখ করা হয়েছে, অনেক দেশেই নাগরিকদের আর্থিক সংকট থেকে রক্ষা করার মতো শক্তিশালী ও নির্ভরযোগ্য সুরক্ষা ব্যবস্থা নেই। যখন বেকারত্ব হঠাৎ বেড়ে যায়, তখন তহবিল-স্বল্পতা ও অপরিণত সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা সেই ধাক্কা সামলাতে হিমশিম খায়। ফলে কর্মহীন নাগরিকদের সহায়তা করার ক্ষমতা সীমায় পৌঁছে যায়। এর পরিণতিতে অনেকেই এই ব্যবস্থার ফাঁক গলে দারিদ্র্যের ফাঁদে পড়ে যান, যা সাধারণ জনগণের এক বৃহৎ অংশকে প্রভাবিত করে। যদিও কেউ কেউ এআই এর কারণে চাকরি হারানোকে অনিবার্য বলে হালকাভাবে নেন, তবুও এটি সমাজের স্থিতিশীলতা ও সহনশীলতার ওপর যে গভীর প্রভাব ফেলতে পারে, তা উপেক্ষা করা একেবারেই উচিত নয়।
সংস্কৃতিগত শ্রেণিবিন্যাসের ডিজিটাল রূপ
এআই এর সমস্যাগুলো কেবল তার ব্যবহারের পদ্ধতিতেই নয়, বরং এর নির্মাণ প্রক্রিয়াতেও লুকিয়ে আছে। প্রোজেক্ট সিন্ডিকেট ম্যাগাজিন এর এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, আজকের যে এআই নির্ভর প্রযুক্তিগুলো মূলধারায় স্থান পেয়েছে, সেগুলো মূলত উত্তর গোলার্ধের ভোক্তাদের জন্য তৈরি। কিন্তু এই প্রযুক্তিগুলোকে যেসব দেশে স্থানীয় প্রেক্ষাপট বিবেচনা না করেই ব্যবহার করা হচ্ছে, সেখানে সেগুলোর কার্যকারিতা অনেকটাই কমে যায়। ফলে এই তথাকথিত “সমাধানগুলো” শেষ পর্যন্ত বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর ব্যবহারকারীদের জন্য আরও নতুন সমস্যা তৈরি করার সম্ভাবনা থেকে যায়। যদিও কিছু দেশ ইতিমধ্যে এআই এর ক্ষতিকর প্রভাব কমানোর লক্ষ্যে নিয়মনীতি তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে, তবুও অধিকাংশ দেশেই এখনো এই বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার মতো নীতিগত কাঠামো গড়ে ওঠেনি। তাই অনেক ক্ষেত্রেই ক্ষতি ইতিমধ্যেই ঘটে যাচ্ছে।
উত্তর গোলার্ধে তৈরি এবং পরবর্তীতে বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়া কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নির্ভর পণ্যগুলো নানা দিক থেকে ত্রুটিপূর্ণ। ওয়াইয়ার্ড ম্যাগাজিন এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব প্রযুক্তিতে সেসব অঞ্চলের মানুষের মূল্যবোধ ও চিন্তাধারা প্রোগ্রাম করা থাকে, যা প্রায়ই বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবন অভিজ্ঞতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সীমিত দৃষ্টিভঙ্গি–সম্পন্ন ডেটা দিয়ে প্রশিক্ষিত এই টুলগুলো উন্নয়নশীল দেশের ভোক্তাদের কাছে “সহায়ক” হিসেবে বিক্রি করা হয়, অথচ বাস্তবে এগুলো ক্ষতিকর, কারণ এগুলো নির্দিষ্ট কিছু সম্প্রদায় সম্পর্কে পক্ষপাত, ভুল ধারণা ও বিকৃত চিত্র তৈরি করে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, এসব পশ্চিমকেন্দ্রিক এআই এর সমালোচকরা বিকল্প উপস্থাপন করতে পারেন না, কারণ তাদের সম্পদ ও সামর্থ্য ইউরোপ বা উত্তর আমেরিকার বড় বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের তুলনায় অতি সীমিত। ফলে তারা প্রায়ই কার্যকর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রযুক্তি তৈরি করতে অক্ষম থাকেন, এবং বৈষম্যমূলক এই প্রযুক্তির প্রবাহ অনবরত চলতেই থাকে।
ন্যায়সঙ্গত সমাধানের কল্পনা
সমস্ত প্রমাণ বিচার করলে সহজেই বোঝা যায় যে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর ওপর প্রভাব ফেলা বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। তবুও এই ফলাফল অনিবার্য নয়। এআই যেভাবে মানুষের জীবিকা ও জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনছে, তা মোকাবিলায় এসব অঞ্চলের নীতিনির্ধারকদের এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, দক্ষতা উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করা এবং সামাজিক সহায়তা ব্যবস্থা শক্তিশালী করা নাগরিকদের অর্থনৈতিক দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করতে পারে। এছাড়া, বিশ্বের দক্ষিণের দেশগুলোর নেতারা যেন একত্রে বসে এআই এর নিয়ম, মান ও নীতিমালা নিয়ে আলোচনা করতে পারেন এমন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করাও অত্যন্ত জরুরি। এতে সরকারী পর্যায়ে নীতি নির্ধারকরা এআই সম্পর্কিত বিষয়ে আরও গভীর জ্ঞান অর্জন করতে পারবেন। এই আলোচনাগুলো থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা ও অন্তর্দৃষ্টি পরবর্তীতে এমন নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে যা সরাসরি মানুষের চাহিদা ও বাস্তব সমস্যার প্রতিফলন ঘটাবে।
বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর প্রেক্ষাপট অনুযায়ী সুনির্দিষ্টভাবে উপযোগী এআই টুল তৈরি করাও গুরুত্বপূর্ণ। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য এসব অঞ্চলে একটি শক্তিশালী ডিজিটাল ইকোসিস্টেম গড়ে তুলতে হবে, যেখানে স্থানীয় উদ্ভাবক ও তরুণ প্রযুক্তিবিদদের জন্য পর্যাপ্ত সহায়তা থাকবে। সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশগুলো উত্তর গোলার্ধের একচেটিয়া প্রভাবের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে সক্ষম হবে, যেখানে এখনো ত্রুটিপূর্ণ, এমনকি কখনো ক্ষতিকর প্রযুক্তিগুলো তাদের বাজারে ভরিয়ে তুলেছে। এই সহযোগিতা থেকে এমন নতুন এআই টুলের বিকাশ ঘটতে পারে, যা বিভিন্ন অঞ্চলের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে আরও মানানসই হবে, এবং একইসঙ্গে সেইসব পণ্যের সংখ্যা কমিয়ে আনবে, যেগুলো দীর্ঘদিন ধরে পক্ষপাত ও ভুল ধারণা পুনরুৎপাদন করে আসছে। এ ধরনের পদক্ষেপ বৈশ্বিক এআই বৈষম্য হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, যার মাধ্যমে আমরা এমন এক পৃথিবীর দিকে এগোতে পারব, যেখানে প্রযুক্তি সত্যিই সবার কল্যাণে কাজ করবে।









