আমাদের স্ক্রিনের পেছনের ঘটনা: ‘কারিগর’ খনন ও ‘প্রাকৃতিক’ প্রযুক্তির বাস্তবতা

এই ছবিটি লিজ ক্যারিগান ও সাফা তৈরি করেছেন, যেখানে ইয়োরগোস বাগাকিস, আলেসান্দ্রো ক্রিপস্টা এবং লা লোমার কিছু ভিজ্যুয়াল অংশ অনুমতি নিয়ে যুক্ত করা হয়েছে।

এই নিবন্ধটি ‘ডিজিটাল ডিভাইসেস’ সিরিজের জন্য সাফা লিখেছেন এবং এটির মূল সংস্করণ tacticaltech.org -এ প্রকাশিত হয়েছিল। এর সম্পাদিত সংস্করণটি গ্লোবাল ভয়েসেস-এর সঙ্গে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে পুনঃপ্রকাশ করা হয়েছে।

মানুষ যখন “প্রাকৃতিক” বনাম “কৃত্রিম” বিষয়টি নিয়ে কথা বলে, তখন সাধারণভাবে ধরে নেওয়া হয় যে প্রযুক্তি কৃত্রিম দিকেই পড়ে। কিন্তু প্রযুক্তি তৈরির উপাদান ও বস্তুগুলো আসলে পৃথিবী থেকেই আসে, এবং বহু মানুষের হাতে পরিচালিত হয়।

তাহলে আসলে “প্রাকৃতিক” বলতে কী বুঝায়? মানবতাবাদী, নেতা ও বক্তা কাভে বুলাম্বো ২০২৪ সালের এক ভাষণে বলেন, “একটি সবুজ জ্বালানিতে রূপান্তরিত বিশ্ব কল্পনা করা অসম্ভব, যদি এই খনিজ সম্পদগুলোর কথা না বলা হয়। যখন আপনি বিষয়টি গভীরভাবে অনুধাবনের চেষ্টা করবেন তখন দেখবেন, এই জাঁকজমকপূর্ণ প্রযুক্তি জগতের পেছনে রয়েছে পুরুষ, নারী, এমনকি শিশুদের কঠোর পরিশ্রম, যারা কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের কোবাল্ট খনিতে শোষণ ও দমনের মধ্যে কাজ করছে।”

প্রযুক্তি তৈরির সঙ্গে জড়িত মানবাধিকার লঙ্ঘনকে পরিবেশগত প্রভাব থেকে আলাদা করে দেখার চেষ্টা করা অযৌক্তিক হবে। আধুনিক দাসত্ব বিষয়ক গবেষক সিদ্ধার্থ কারা কোবাল্ট খননের পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে বলেন: “লক্ষ লক্ষ গাছ কেটে ফেলা হয়েছে, খনির আশেপাশের বাতাস ধুলা ও ধোঁয়ায় ঢেকে গেছে, এবং খনি প্রক্রিয়াজনিত বিষাক্ত বর্জ্যে পানি দূষিত হয়েছে।”

কোবাল্ট ও ‘সবুজ’ জ্বালানি

কোবাল্ট একটি পাথর, যার নীলচে রঙ প্রায় রহস্যময়—শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এটি শিল্পকলায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বর্তমানে এটি রিচার্জেবল ব্যাটারি তৈরির জন্য অপরিহার্য—যেমন স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, বৈদ্যুতিক গাড়ি ইত্যাদিতে ব্যবহৃত হয়। কোবাল্ট “সবুজ জ্বালানি বিপ্লব” এ একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদ হলেও, এটি স্পর্শ বা নিঃশ্বাসের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করলে বিষাক্ত প্রভাব ফেলতে পারে।

বিশ্বের মোট কোবাল্ট মজুদের প্রায় ৭০ শতাংশই গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রে (DRC) পাওয়া গেছে। সেখানে কোবাল্ট খননের ক্ষতিকর প্রভাব বুঝতে হলে, দেশের ঔপনিবেশিক ইতিহাস বিবেচনা করা জরুরি। ১৯৬০ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পরও সম্পদ শোষণ চলতে থাকে, যা আজও দেশটির খনিশিল্পের কাঠামোকে প্রভাবিত করছেকোলওয়েজি শহরটি বেলজিয়াম কর্তৃক নির্মিত হয় একটি বর্ণবাদী বিভাজন নীতির অধীনে, এবং বর্তমানে এর আশপাশে অসংখ্য খোলা-পিট খনি রয়েছে।

কোবাল্ট খননে আন্তর্জাতিক কোম্পানি ও স্থানীয় ক্ষুদ্র খনিশ্রমিক উভয়ই যুক্ত, যদিও এখন শিল্প খনিগুলোই প্রভাবশালী। তথাপি, ক্ষুদ্র ও স্থানীয় খনন (ASM) এখনো ব্যাপক, যেখানে হাজার হাজার শ্রমিক বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে হাতে করে কোবাল্ট উত্তোলন করেন। কারা বর্ণনা করেন, “যে জায়গা থেকে বিশ্বের প্রায় সব কোবাল্ট আসে, সেই সরবরাহ শৃঙ্খলের নিচের দিকটা এক ভয়াবহ চিত্র।”

আপনার মনে কি আসে যখন আপনি “কারিগর” (artisanal) শব্দটি শুনেন? সম্ভবত তখন আপনার মনে আসে না যে সেখানে স্থানীয় শ্রমিকরা বিপজ্জনক এবং প্রায়ই বিষাক্ত পরিবেশে খুঁড়ে খনিজ উত্তোলন করছেন, কেউ তাদের পরিবার চালানোর জন্য খুব সামান্য আয় করছে, আবার কেউ ছোট দলের মধ্যে খনিজ ব্যবসায় জড়িত। ‘কারিগর’ শব্দের অর্থ হলো ছোট পরিসরের এবং হাতে তৈরি, যা কিছুটা সত্য কারিগর খনি শ্রমিকদের কাজে। কিন্তু এই শব্দটি সাধারণত মনে করায় একটি সুন্দর পাড়ার বাজার বা ঐতিহ্যবাহী হাতে তৈরি চিজ বা সাবান— এটা নয় যে শিশু ও প্রাপ্তবয়স্করা বন্দুকের মুখে হাতে হাতে বিষাক্ত পাথর খুঁজে তুলছে।

এই শব্দটির কিছুটা অর্থ এসেছে এর নিম্ন প্রযুক্তিনির্ভর প্রকৃতির কারণে, যেখানে ব্যক্তিরা এমন খনিজ উত্তোলন করেন যা বড় খনি কোম্পানির জন্য অকার্যকর, ঝুঁকিপূর্ণ বা উপযুক্ত নয়। তবুও, কারিগর খনি খনন মোটেই ছোট পরিসরের নয়। বিশ্বজুড়ে ১০ কোটি মানুষেরও বেশি মানুষ এতে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে যুক্ত বা এর আয়ের ওপর নির্ভরশীল। যদিও এটি শিল্প খননের তুলনায় কিছুটা মানবিক মনে হতে পারে, যা মানবাধিকারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে খারাপ রেকর্ডের মধ্যে একটি, কারিগর খনি খননে প্রায়শই পরিবেশ, শ্রমিক নিরাপত্তা এবং নারী ও শিশুর অধিকারের সুরক্ষা থাকে না

এই ধরনের খনন কোলওয়েজিতে প্রচলিত,  বিশেষ করে যেখানে বড় খনিপ্রকল্পের কারণে মানুষ উচ্ছেদ হয়েছে। সরকার খাতটিকে নিয়মবদ্ধ করার চেষ্টা করলেও, স্থানীয় খনন এখনো চলছে। স্থানীয়ভাবে যাদের “ক্রুসার” (Creuseurs) বলা হয় (খননকারী অর্থে)  তাদের ঘরের নিচে বা নতুনভাবে ঘোষিত “অবৈধ সাইট” এ খনন চালিয়ে যাচ্ছে। এক খনি শ্রমিক, এডমন্ড কালেঙ্গা, এ বিষয়ে বলেন, “খনিজগুলো যেন গ্রামের মধ্যে দিয়ে সাপের মতো চলে যায়। তুমি শুধু সেই সাপটাকে অনুসরণ করো।”

‘রক্ত কোবাল্ট’

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ২০২২ সালের এক প্রতিবেদনে তিনটি খনির এলাকার বেশ কিছু মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তুলে ধরা হয়। সেখানে নথিপত্র, স্যাটেলাইট ছবি এবং পূর্বে বসবাসকারী বাসিন্দাদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে প্রমাণ করা হয় যে, তথাকথিত “জ্বালানি রূপান্তর” প্রকল্পের নামে মানুষকে জোরপূর্বক তাদের ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল। জোরপূর্বক উচ্ছেদ মানবাধিকারের একটি মৌলিক লঙ্ঘন, যা শুধু জীবিকার ক্ষতি নয়, বরং স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো মৌলিক সেবায় প্রবেশাধিকারের মতো অন্যান্য অধিকারকেও হরণ করে। এসব উচ্ছেদ সরকার ও খনন কোম্পানিগুলোর যৌথ প্রচেষ্টায় খনি খাতকে আনুষ্ঠানিক করার অংশ হিসেবে ঘটেছিল।দূষিত খনির আশপাশে বসবাসকারী মানুষ মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির মুখে রয়েছে। কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের খনি অঞ্চল বিশ্বের ১০টি সবচেয়ে দূষিত এলাকার একটি। গবেষণায় দেখা গেছে, কোবাল্টসহ ভারী ধাতুর সংস্পর্শে আসা জন্মগত ত্রুটির ঝুঁকি বাড়ায়। এমনকি স্থানীয় শিশুদের প্রস্রাবে উচ্চমাত্রায় কোবাল্ট পাওয়া গেছে

মানবাধিকার লঙ্ঘনের পাশাপাশি পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের অগণিত ক্ষতি একে অপরের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত — জীববৈচিত্র্যের ধ্বংস, বায়ু, মাটি ও পানিদূষণ, কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তা, সহিংসতা এবং জীবিকা হারানোর মতো সমস্যাগুলো এর অংশ। এসব প্রভাবের ফলে নতুন নতুন সংকটও দেখা দিচ্ছে; যেমন উচ্ছেদ, লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা এবং স্থানীয় সংস্কৃতি ও জ্ঞানের ক্ষয়। হীরকখনি যেমন সংঘাতের প্রতীক হয়ে উঠেছিল, তেমনি কোবাল্টও এখন “সংঘাতজনিত খনিজ”-এর মধ্যে অন্যতম, যা শোষণমূলক উপায়ে উত্তোলিত হয়ে ভয়াবহ পরিণতি বয়ে আনছে।

লিথিয়াম ব্যাটারি তৈরিকারী প্রতিষ্ঠানগুলো; যেমন টেসলা — মাঝে মাঝে সরবরাহ চেইনে স্বচ্ছতার দাবিতে প্রতিক্রিয়া জানালেও, কোবাল্টের চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই কোম্পানিগুলোর ওপর নৈতিক ও মানবাধিকারের দায়িত্ব আরও বাড়ছে। অ্যালফাবেট (গুগলের মূল প্রতিষ্ঠান), অ্যাপল, ডেল, মাইক্রোসফট এবং টেসলার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে, তারা জোরপূর্বক শ্রমিকদের দ্বারা উত্তোলিত কোবাল্ট কিনেছে এবং শিশু শ্রমের ওপর নির্ভরতা আড়াল করার চেষ্টা করেছে — এমনকি চরম দারিদ্র্যের শিকার শিশুদের ক্ষেত্রেও।

যদিও মার্কিন আদালত রায় দিয়েছে যে সরবরাহকারীদের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য ক্রেতা কোম্পানিগুলো দায়ী নয়, তবুও অ্যাপলের বিরুদ্ধে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে। আফ্রিওয়াচের নির্বাহী পরিচালক ইমানুয়েল উমপুলা বলেন, “এটা ডিজিটাল যুগের এক বিশাল প্যারাডক্স—বিশ্বের ধনী ও উদ্ভাবনী কোম্পানিগুলো অবিশ্বাস্য প্রযুক্তি তৈরি করতে পারে, কিন্তু তাদের কাছ থেকে উপাদানের উৎস সম্পর্কে স্বচ্ছতা দাবি করা হয় না।”

ইউরোপীয় সংসদ একটি আইন পাস করেছে, যার মাধ্যমে বড় কোম্পানিগুলোকে মানবাধিকার ও পরিবেশ সংক্রান্ত যথাযথ যাচাই বাধ্যতামূলক করা হয়েছে—এটি সরবরাহকারীদের দ্বারা সংঘটিত অধিকার লঙ্ঘনের জন্য কর্পোরেশনগুলোকে দায়বদ্ধ করার দিকে একটি পদক্ষেপ। তবে সরবরাহ চেইন নিজেই সবসময় নির্ভরযোগ্য নয়। কোবাল্টের ক্ষেত্রে প্রায়শই শিশু শ্রমে উত্তোলিত খনিজ ও শিশু শ্রমমুক্ত খনিজ একসঙ্গে মিশিয়ে পরিশোধনাগারে পাঠানো হয়, ফলে উৎস নির্ণয় করা কঠিন, অনেক সময় অসম্ভব হয়ে পড়ে। উপরন্তু, “শিশু শ্রমমুক্ত” লেবেল থাকলেই তা মানবিক বা নিরাপদ পরিবেশে উত্তোলিত, এমন নিশ্চয়তা নেই। ডিআরসির খনি খাতে জবাবদিহিতা ও ন্যায্যতার বিষয়ে গভীর বিশ্লেষণ ও সুপারিশ করেছে দ্য কার্টার সেন্টার।

আমাদের জ্বালানি ব্যবহারের পরিমাণ ক্রমেই বাড়ছে মূলত চ্যাটজিপিটি, ক্রিপ্টোকারেন্সি, এবং দ্রুতগতির ইন্টারনেটের মতো উদ্ভাবনের কারণে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, জেনারেটিভ এআই দিয়ে একটি ছবি তৈরি করতে যত বিদ্যুৎ লাগে, তা দিয়ে একটি স্মার্টফোন পুরোপুরি চার্জ করা যায়। বহুজাতিক বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান গোল্ডম্যান স্যাকসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এআই-চালিত একটি সার্চ সাধারণ সার্চের চেয়ে ১০ গুণ বেশি বিদ্যুৎ খরচ করে। গুগল ও মাইক্রোসফট নিজেরাই জানিয়েছে, এআই ব্যবহারের কারণে তাদের কার্বন নিঃসরণ বেড়েছে। যখন পানি ও খাদ্য সংকট এবং ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক উষ্ণতা বাস্তব হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন প্রশ্ন উঠছে,পৃথিবী আর কতদিন এই প্রযুক্তিগত ব্যবস্থাগুলো বহন করতে পারবে? হয়তো একদিন আমরা তাকাবো প্রকৃতির দিকে, যার উপাদান আমাদের স্ক্রিন চালাতে যে শক্তির প্রয়োজন তাতে ব্যবহার হচ্ছে, এবং সেটিকে পর্যালোচনা করব, তখন আমরা সত্যিই বুঝতে পারব তার বিষাক্ত প্রভাব মানুষ ও পৃথিবীর ওপর কতটা গভীর।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .