
ছবি : গ্লোবাল ভয়েস, ক্যানভা প্রো-তে।
এই প্রতিবেদনটি গ্লোবাল ভয়েসের সিভিক মিডিয়া অবজারভেটরি-এর নিউজলেটার ‘আন্ডারটোনস’ -এর অংশ। এখানে সাবস্ক্রাইব করুন।
মাত্র দুই মাসেরও কম সময়ের মধ্যে, ২০২৪ সালের জুলাই ও আগস্টে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ২০০৯ সাল থেকে ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনার স্বৈরশাসিত সরকারকে পদচ্যুত করতে সমর্থ হয়—যা দক্ষিন এশিয়ায় জনগনের শক্তির অন্যতম বিস্ময়কর উদাহরণ। এই আন্দোলন শুরু হয় ছাত্রদের নেতৃত্বে সরকারি চাকরির পক্ষপাতদুষ্ট কোটাপদ্ধতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে এবং তা দ্রুত অন্যায় স্বৈরতান্ত্রিক নীতির বিরুদ্ধে দেশব্যাপী গণআন্দোলনে রুপ নেয়। ছাত্র আন্দোলনকে সমর্থনকারী বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে ছিল প্রধান বিরোধীদল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), সদ্য নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার পাওয়া দেশের বৃহত্তম ইসলামি দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামি, বামপন্থী রাজনৈতিক দলসমূহ এবং দেশের খ্যাতিমান নাগরিক সমাজের নেতা, অর্থনীতিবিদ ও নোবেল শান্তি পুরষ্কার বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনুস।
মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জাতীয় নির্বাচনের সময়সূচী নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক উত্তেজনা সামাল দিচ্ছে। ইউনুস প্রশাসন, নবগঠিত ছাত্র-নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি (এনসিপি) এবং ইসলামি দল জামায়াতে ইসলামির শক্ত সমর্থনে, এপ্রিল ২০২৬ পর্যন্ত নির্বাচন পিছিয়ে নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার কার্যকর করার পক্ষে। অপরদিকে, ২০২৪ সালের অভ্যুত্থানের অন্যতম সমর্থক ও বর্তমান ভোটার জরিপে এগিয়ে থাকা বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) আগামী ডিসেম্বর ২০২৫-এর মধ্যে দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানাচ্ছে। এই মতপার্থক্যের মূল কারন হলো বিএনপির রাজনৈতিক আস্থা, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে উদ্বেগ। অন্যদিকে ইউনুস এবং তার মিত্ররা বিচার বিভাগ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং নির্বাচন কমিশনসহ মূলগত সংস্কারের প্রয়োোজনীয়তার ওপর জোড় দিচ্ছেন, যাতে সত্যিকারের অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করা যায় এবং দেশ আবার যেন স্বৈরশাসনের দিকে না ফিরে যায়।
সংস্কারের ব্যাপারে প্রকাশ্যে অঙ্গীকার থাকা সত্ত্বেও, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নানা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। ২০২৫ সালের মে মাসের শেষ দিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায় যে, সংস্কারের ধীরগতিতে ইউনুস হতাশ এবং পদত্যাগের কথাও বিবেচনা করেছিলেন। তবে তার প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা তাকে গনতান্ত্রিক উত্তরণের স্বার্থে পদে থেকে যাওয়ার জন্য অনুরোধ জানান। বিশেষ করে সংবিধান সংশোধন ও বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরণের মতো জটিল বিষয়ে দৃশ্যমান অগ্রগতি না থাকায় সরকারবিরোধী আন্দোলন এবং রাজনৈতিক কোন্দল বাড়তে থাকে, যা নিরাপত্তা পরিস্থিতি আরও অবনতি ঘটিয়েছে। এ অবস্থায়, ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি (এনসিপি) এবং জামায়াতে ইসলামি উভয়ই নির্বাচন-পরবর্তী নয়, বরং নির্বাচনের আগে এই সংস্কারগুলো বাস্তবায়নের শর্ত জুড়ে দিয়েছে। অন্যদিকে, বিএনপি নির্বাচন এগিয়ে আনার জন্য দাবি জানিয়ে যাচ্ছে, কারন অনির্বাচিত সরকারের অধীনে অর্থনৈতিক স্থবিরতা এবং ২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রস্তাবিত নির্বাচনী সময়সূচি আবহাওয়া ও ধর্মীয় আয়োজনের কারণে বাস্তবসম্মত নয় বলে তারা উদ্বেগ প্রকাশ করছে।
পুরো জুন জুড়ে সিভিক মিডিয়া অবজারভেটরি বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকটকে ঘিরে দুটি প্রধান আখ্যান বিশ্লেষণ করেছে। এই আখ্যান গুলোতে দেশের উত্তেজনাপূর্ন ও অনিশ্চিত রাজনৈতিক উত্তরণের চিত্র উঠে এসেছে। একদিকে, মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ২০২৬ সালের এপ্রিলের আগে ব্যাপক সংস্কার বাস্তবায়নের লক্ষ্য নিয়েছে। অন্যদিকে, বিএনপির মতো প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো ধীরগতির সংস্কার ও চলমান অস্থিরতার মধ্যে ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই দ্রুত নির্বাচন আয়োজনের জন্য চাপ সৃষ্টি করছে।
আখ্যান : সংস্কার সম্পন্নের জন্য ইউনুসের আরও সময় প্রয়োজন
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বর্তমান জাতীয় নির্বাচনের সময়সূচি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিভাজন দেখা দিয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শুরুতে ২০২৬ সালের জুনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ইঙ্গিত দিলেও, ২০২৫ সালের ৬ জুন তারা আনুষ্ঠানিকভাবে ২০২৬ সালের এপ্রিলের জন্য নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ করে। এই সময়সূচিকে ব্যাপকভাবে সমর্থন দিয়েছে ছাত্র-নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি (এনসিপি) এবং জামায়াতে ইসলামি দল। তারা উভয়ই নির্বাচনের আগে বিচার বিভাগ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং নির্বাচন কমিশন সহ গুরুত্বপূর্ণ প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার সম্পন্নের ওপর জোর দিয়েছে। তাদের বিশ্বাস, এসব সংস্কার ছাড়া একটি সত্যিকারের অবাধ ও সুষ্ঠু গনতান্ত্রিক নির্বাচন সম্ভব নয় এবং পূর্ববর্তী শাসনামলের স্বৈরশাসনে ফিরে যাওয়ার ঝুঁকি থেকেই যাবে।
তবে এই সময়সূচির ব্যাপারে তীব্র বিরোধিতা করছে ভোটারদের কাছে জনপ্রিয় প্রধান রাজনৈতিক শক্তি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। তারা ধারাবাহিকভাবে ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন আয়োজনের দাবি জানিয়ে আসছে। এই চাপের ফলে দেশ এক অস্থির পরিবেশের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। ২০২৫ সালের মে মাসের শেষ দিকে সংস্কারের অগ্রগতি না হওয়া এবং রাজনৈতিক দলসমূহের যথেষ্ট সমর্থন না পাওয়ায় ইউনুস পদত্যাগের হুমকি দেয় বলে জানা যায়। যদিও পরবর্তীতে তাকে পদে থাকার জন্য রাজি করানো হয়, তবুও ভেতরের উত্তেজনা থেকে যায়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ স্থিতিশীলতা রক্ষায় এবং সংস্কার সম্পন্নের জন্য বৃহত্তর ঐক্যের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছে। তবে দৃশ্যমান অগ্রগতির ধীরগতি এবং বিএনপি ও সেনাপ্রধানের পক্ষ থেকেও আগাম নির্বাচনের আহবান রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং নিরাপত্তা পরিস্থিতির আরও অবনতির ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলেছে।
অনলাইনে এই আখ্যানটি যেভাবে ছড়িয়ে পরছে

এই ভিডিওটি ফেসবুকে প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে ঈদ-উল-আযহার নামাজের সময় উপস্থিত মুসল্লিরা ইউনুসকে ক্ষমতায় পাঁচ বছর থাকার জন্য অনুরোধ করছে। ভিডিওতে দেখা যায়, নিরাপত্তা কর্মীদের পাহারায় ইউনুস একটি লাইন ডিভাইডারের পাঁশে হাটছেন, অপর পাশে জমায়েত হওয়া জনগণ তাকে অভিবাদন জানাচ্ছে, এবং তিনি হাত নাড়িয়ে ও ঐক্যের সংকেত দেখাচ্ছে।
ইউনুস নিজেও বারবার জানিয়েছেন যে, তিনি পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের অংশ হতে আগ্রহী নন, এবং তার একমাত্র অগ্রাধিকার হলো দেশটিকে সঠিকভাবে উত্তরণ এবং নির্বাচন পরিচালনা করা।
এই বিষয়টি একটি সুস্পষ্ট অপ্রকৃত প্রভাব বৃদ্ধির অংশে পরিণত হয়েছে, যেখানে অনেক জামায়াত সমর্থক অ্যাকাউন্ট ২০২৫ সালের ৭ জুন এই উক্তি ও ভিডিওটি X (এক্স) এবং ফেসবুকে পোস্ট করেছে, যার মধ্যে ছিল বাসেরকেল্লা—জামায়াতের যুব সংগঠনের জনসংযোগ শাখা। উদাহরণসহ পুনরায় পোস্ট : ১,২,৩,৪,৫।
এই বিষয়টি বিনা সমালোচনায় এমন একটি জনমতকে জোর দিচ্ছে যা ইউনুসের জনগনের প্রতি প্রতিশ্রুতি এবং সাময়িক সরকারের গনতান্ত্রিক নির্বাচন প্রস্তুতির কর্তব্য উভয়কেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
আখ্যান: শুধুমাত্র আগাম নির্বাচনই দেশের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করতে পারে
বাংলাদেশের ঐতিহাসিক রাজনৈতিক শক্তি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), যারা ২০২৪ সালের ‘জুলাই বিপ্লব’ কে সমর্থন করেছিল, বর্তমানে মুহাম্মদ ইউনুসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাথে নির্বাচনের সময়সূচি নিয়ে দ্বন্দ্বে রয়েছে। ইউনুসের সংস্কার এজেন্ডাকে বহিরাগতভাবে সমর্থন করলেও, ভোটার জরিপে এগিয়ে থাকা বিএনপি জোরালোভাবে দাবি করছে যে নির্বাচন অবশ্যই ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে এবং ৬ জুন ইউনুস ঘষিত ২০২৬ সালের এপ্রিলের তারিখটি প্রত্যাখ্যান করছে। তারা যুক্তি দেয় যে, আরও বিলম্ব রাজনৈতিক অবস্থা কমিয়ে দেবে, অর্থনীতিকে অস্থিতিশীল করবে এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষতি করবে, পাশাপাশি আবহাওয়ার পরিস্থিতি ও রমজানের সময় নির্বাচনের সম্ভাব্য অসুবিধার কথাও উল্লেখ করে। জুন মাসের মাঝামাঝি লন্ডনে নির্বাসিত বিএনপি নেতা তারিক রহমানের সঙ্গে বৈঠকের পর ইউনুস ২০২৬ এর ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন করার সম্ভাবনা স্বীকার করেন।
বিএনপির চাপ দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে গভীর বিভাজনের প্রতিফলন ঘটায়, যেখানে দ্রুত নির্বাচনের প্রত্যাবর্তনের ইচ্ছা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সমগ্র প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার বাস্তবায়নের ঘোষনার সঙ্গে সংঘর্ষে রয়েছে। এই আখ্যান ইউনুসকে বহু বছর ধরে অ-নির্বাচিত সরকারের নেতৃত্বে রাখার প্রবনতাকে একটি তদারকি হিসেবে কাজ করতে পারে, যা তার কিছু সমর্থক প্রস্তাব করে থাকেন। একই সঙ্গে, এটি বিএনপির মূল কৌশল যেটি তাদের ক্ষমতায় ফেরার পথ নির্মান করছে, কারন তারা নবগঠিত এনসিপি এবং সম্প্রতি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হওয়া জামায়াতে ইসলামি থেকে বেশি সংগঠিত মনে হচ্ছে, যদিও উভয় দলই প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে একমত।
অনলাইনে এই আখ্যানটি যেভাবে ছড়িয়ে পড়ছে

এই ফেসবুক ভিডিও সংবাদ প্রতিবেদনটিতে, শীর্ষস্থানীয় বিএনপি নেতা রুমীন ফারহানা অবমাননাকর স্বরে দাবি করেন যে শুধুমাত্র ইউনুস এবং ছাত্র নেতৃত্বাধীন এনসিপি পার্টিই নির্বাচনের বিরোোধী। ভিডিওটি এমপির টক শোতে উপস্থিতির তিন দিন পর ধারণা করা হয়েছে, যখন প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচন তারিখ এপ্রিল ২০২৬ নির্ধারণ করেন।
রুমীন ফারহানা একজন প্রখ্যাত সংসদ সদস্য এবং প্রধান বিরোধী সদস্য, যিনি পূর্ববর্তী শাষনামলে বেশ সক্রিয় ছিলেন। তিনি বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। আওয়ামী লীগের শাসনের তাঁর প্রতিবাদের কারণে তিনি ব্যাপক অনলাইন হ্যারাসমেন্ট এবং মিথ্যা তথ্য প্রচারের লক্ষ্যবস্তু হয়েছেন। ফারহানা একটি ভারতীয়, প্রো-বিজেপি মিডিয়াকে সাক্ষাৎকার দেওয়ার জন্যও কঠোর সমালোচিত হয়েছিলে, যাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য প্রচারের অভিযোগ রয়েছে।
প্রাথমিকভাবে বিবেচনা করলে, এই বক্তব্যটি ইউনুস ও এনসিপিকে গণতন্ত্রবিরোধী উদ্দেশ্যে অভিযুক্ত করে, যা বিভাজনমূলক ও প্রমাণহীন। তবে দ্রুত নির্বাচন আয়োজনের পক্ষে এবং বিপক্ষে রাজনৈতিক ও সামাজিক গোষ্ঠীগুলোকে একসঙ্গে তুলনা করা একটি বিরোধী রাজনীতিকে স্বাভাবিক কৌশল হিসেবে দেখা যায়।






