
মেলিয়া সীমান্তের বর্তমান অবস্থা। ছবি তুলেছেন মোহাম্মদ বেলকাসেন, অনুমতি নিয়ে ব্যবহৃত।
গত ২৪ জুন, ২০২৫ তারিখে সাম্প্রতিক ইউরোপীয় সীমান্ত ইতিহাসের এক অন্যতম মর্মান্তিক ঘটনার তিন বছর পূর্ণ হলো। ঐ দিন প্রায় ২,০০০ উপ-সাহারান অভিবাসী উত্তর আফ্রিকায় অবস্থিত স্পেনের ছিটমহল মেলিয়ায় প্রবেশের চেষ্টা করেছিল। আজও ঠিক কতজনের মৃত্যু হয়েছিল, তার সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি।
মেলিয়া স্বায়ত্তশাসিত শহরে সেদিন ছিল এক সাধারন শুক্রবার সকাল – যা দ্রুতই পরিনত হয় রক্ত, অনিশ্চয়তা এবং নীরবতায় ভরা এক ভয়াবহ দিনে। এই দিনটি স্পেন, মরক্কো এবং ইউরোপের অভিবাসন নীতির ইতিহাসে এক অন্ধকার অধ্যায়।
মরক্কো ও স্পেনের সীমান্তের বারিও চিনো চেকপয়েন্ট দিয়ে সীমান্তের বেড়া টপকানোর চেষ্টা করে প্রায় ২,০০০ অভিবাসী, যাদের অধিকাংশই সুদান থেকে আসা। পরিনতিতে ঘটে কয়েক ডজন মৃত্যু ও নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা — যা এই অঞ্চলের অভিবাসন ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় নিয়ে আসে।
স্বাধীন তদন্তকারীরা, যেমন বর্ডার ফরেনসিকস, অ্যামনেস্টি, লাইটহাউস রিপোর্টস এবং অন্যান্যরা, ভিডিও প্রমান ও প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষ্যের ভিত্তিতে প্রকাশ করেছেন যে, অভিবাসীরা মারাত্নক সহিংসতা, টিয়ার গ্যাস ছোঁড়ার এবং অত্যধিক ভিড়ের কারনে সীমান্তের প্রান্তে পিষ্ট হয়ে মারা গেছেন। মরক্কোর বাহিনী কমপক্ষে ২০ টি টিয়ার গ্যাস ক্যানিস্টার এক সংকীর্ন স্থানে নিক্ষেপ করেছিল বলে জানা গেছে, পাশাপাশি স্পেনের গার্ডিও সিভিলিও (সিভিল গার্ড) টিয়ার গ্যাস এবং কমপক্ষে ৬৫ টি রাবার বুলেট ব্যবহার করেছে।
সাক্ষীরা নির্মম মারধরের বর্ণনা দিয়েছেন, একজন বেঁচে থাকা ব্যাক্তি বলেছেন, একজনকে মাথায় পেটানো হচ্ছিল ‘মরে গেছে কিনা পরীক্ষা করার জন্য’। উঠোনের ভেতর জনসমাগমে পিষ্ট হয়ে ভয়ঙ্কর পদদলন ঘটে, মৃতদেহগুলো স্তুপবদ্ধ ছিল এবং কোনো চিকিৎসা সহায়তা পাওয়া যায়নি।
মরক্কোর কর্তৃপক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে, তারা অনেক নিহত ব্যাক্তিকে নাদরো'র সিদি সালেম কবরস্থানের কাছাকাছি চিহ্নবিহীন কবরগুলোতে দাফন করেছে, কিন্তু মৃত্যুসনদ জারি করেনি। এই স্বচ্ছতার অভাবের কারনে কয়েক ডজনকে আনুষ্ঠানিক ভাবে ‘নিখোঁজ’ দেখানো হয়েছে, যা ইচ্ছাকৃত গোপনীয়তা এবং দোষমুক্তির আশংকা বাড়িয়েছে।

আজকের মেলিয়া সীমান্তের বেড়া। ছবি তুলেছেন মোহাম্মদ বেলকাসেন, অনুমতি নিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে।
মৃত ও নিখোঁজের পরিসংখ্যানে পার্থক্য
তিন বছর পেরিয়ে গেলেও সেই ঘটনার সঠিক মৃতের সংখ্যা জানা যায়নি। অনেকের খোঁজ মেলেনি, যারা সীমান্ত পেরোবার চেষ্টা করেছিল কিন্তু সম্ভবত ব্যর্থ হয়েছিল। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল কমপক্ষে ৩৭ জন নিশ্চিত মৃত্যুর এবং ৭৩ জন নিখোঁজের তথ্য জানিয়েছে। কামিনান্দো ফ্রন্টেরাস ৪০ জন মৃত্যুর এবং ৭৭ জন নিখোঁজের কথা বলেছে। এনএমডিএইচ-নাদর (‘অ্যাসোসিয়েশন মারোকাইন দেস ড্রোয়েস উমাঁ’) বর্ডার ফরেনসিকস এর সাথে মিলিয়ে ২৭ জন মৃত্যুর এবং ৭০-এর বেশি নিখোঁজের সংখ্যা দিয়েছে। অন্যদিকে, ৭৪ টি এনজিওর একটি জোট জাতিসংঘে একটি যৌথ চিঠিতে জানিয়েছে, কমপক্ষে ৩৭ জন নিহত হয়েছে এবং ৭০-এর বেশি এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি।
তবে, সরকারি মরক্কো রিপোর্ট অনুযায়ী, ২৩ জন অভিবাসীর মৃত্যু এবং ২ মরক্কোর পুলিশ অফিসার নিহত হয়েছে, সঙ্গে ৭৬ জন অভিবাসী ও ১৪০ জন নিরাপত্তা কর্মী আহত হয়েছে। এই তথ্য স্পেনের গৃহমন্ত্রকও অনুমোদন করেছে।
তবে, এল পেইস, লাইটহাউস রিপোর্টস, লে মদঁ, ডের স্পিগেল এবং এনাস প্রভূত আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম কর্তৃক স্বাধীন তদন্তে অভিযোগ করা হয় যে, অন্তত একজন অভিবাসী স্পেনীয় ভূখন্ডে মারা গেছেন। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও জানিয়েছে যে স্পেনীয় বাহিনী ৪৭০ বার “হট রিটার্ন” নামে পরিচিত প্রক্রিয়া চালিয়েছে, যার মাধ্যমে যারা বেড়া পেরিয়ে গিয়েছিল তাদের জোড়পূর্বক মরক্কোতে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
অন্যদিকে, যারা বেচেঁ গিয়েছিল, তাদের অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের তথ্য অনুযায়ী মরক্কোর দূরবর্তী এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের বর্তমান অবস্থা অজানা। কিছু খবর অনুযায়ী তারা লিবিয়া, আলজেরিয়া বা তিউনিসিয়া সহ অন্যান্য অভিবাসন পথ ধরে তাদের যাত্রা চালিয়ে গিয়েছেন, তবে এই তথ্যের কোনো নির্ভভরযোগ্য উৎস পাওয়া যায়নি।
ফলপ্রসূ হয়নি তদন্ত
২৪ জুনের ঘটনার মাত্র চার দিন পর, ২০২২ সালের ২৮ জুন, স্পেনের পাবলিক প্রসিকিউটর একটি তদন্ত শুরু করেন ঘটনার প্রকৃততা এবং স্পেনীয় কর্তৃপক্ষের কর্মকান্ড উপযুক্ত ছিল কিনা তা যাচাই করার জন্য। কিন্তু একই বছরের ২৩ ডিসেম্বর মামলটি বন্ধ করে দেওয়া হয়, কারন হিসেবে বলা হয় “সারসংক্ষেপে ফেরত পাঠানোর ঘটনায় কোনো অপরাধমূলক প্রমান পাওয়া যায়নি”।
মরক্কোর কর্তৃপক্ষও তাদের নিরাপত্তা বাহিনীর কার্যকলাপ সম্পর্কে নিজস্ব তদন্ত শুরু করেছিল। ২৪ জুন, ২০২৪-এ এটি আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ ঘোষনা করা হয়, আবার “অপরাধের প্রমানের অভাব” উল্লেখ করে এবং জন্দারমারির কার্যকলাপ কে তারা অভিবাসীদের এক সহিংস হামলার বিরুদ্ধে আত্মরক্ষামূলক পদক্ষেপ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছে।

মেলিয়া সীমান্তের বর্তমান অবস্থা। ছবি তুলেছেন মোহাম্মদ বেলকাসেন, অনুমতি নিয়ে ব্যবহৃত।
সবকিছু থমকে আছে, তবুও সবকিছু আগের মতোই
মেলিয়া ইউরোপে প্রবেশের অনেক অভিবাসন পথের একটি গুরুত্বপূর্ণ শেষ গন্তব্য হিসেবে থেকে গেছে। দৈনন্দিন জীবন স্বাভাবিকভাবেই চলতে থাকে, যেন কিছুই বদলায়নি—যদিও সেই স্মৃতির শহরটিতে, এর বাসিন্দাদের মধ্যে, এবং সেখানে পেরিয়ে যাওয়া অভিবাসীদের মনে গভীরভাবে লেগে আছে।
২০২২ সালের পর থেকে এত বিশাল কোনো সীমান্ত পেরোনো ঘটনা আর ঘটেনি। বেড়াটি আরও শক্তপোক্ত করা হয়েছে, যদিও এরপর ছোট ছোট প্রচেষ্টা রেকর্ড করা হয়েছে। গত দুই বছরে প্রায় ১,৭৭০ জন অভিবাসী বেড়া পেরিয়েছে। বর্তমানে, মেলিয়া প্রবেশের প্রধান পথ সমুদ্র পথে।

মেলিয়া সীমান্তের বর্তমান অবস্থা। ছবি তুলেছেন মোহাম্মদ বেলকাসেন, অনুমতি নিয়ে ব্যবহৃত।
সময় যত এগোয়, এক বিষয় অপরিবর্তিত থাকে; নীরবতা ও দায়বদ্ধতার অভাব। আর মৃত ও নিখোঁজদের পরিবারের জন্য সেই ক্ষত আজও অমোচনীয়—সত্য, ন্যায়বিচার ও স্মৃতির অপেক্ষায় রয়ে গেছে।