যুদ্ধের ছায়ায় ধ্বংস: নেতানিয়াহুর পরবর্তী লক্ষ্য কি ইরান?

Rescue teams inspect a destroyed building in Tehran after Israeli strikes on June 13.

২০২৫ সালের ১৩ই জুন এক ইসরায়েলি হামলার পর তেহরানে একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবন পরিদর্শন করছে উদ্ধারকারী দলগুলি। ইনস্টাগ্রামে @alishtayeh1 এর আপলোড করা ভিডিও থেকে নেওয়া স্ক্রিনশট। ফেয়ার ইউজ।

মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়ালে, যখন বাঁচা আর শেষ হয়ে যাওয়ার মাঝে মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ব্যাবধান — তখন কে বন্ধু, কে শত্রু, কে দোষী আর কে নির্দোষ, শক্তিশালী পুরুষ নাকি দুর্বল কিশোরী, সে সবই অর্থহীন হয়ে যায়। সে মুহূর্তে একটাই বিষয় গুরুত্বপূর্ণ: বেঁচে থাকা।

নাথিং এন্ড সো বি ইট” বইতে ওরিয়ানা ফালাচ্চি বারবার তুলে ধরেছেন, ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিভিন্ন সমরে থাকা সৈন্যরা কীভাবে এক নিষ্ঠুর অথচ গভীর মানবিক অনুভূতির কথা স্বীকার করেছেন। যখন কোনো গুলি তাদের নয়, পাশে থাকা সঙ্গীর গায়ে লাগে—তখন তারা বেঁচে যাওয়ার আনন্দে ভেসে যান। এক সৈনিক বলেছিলেন, ‘ যখন গুলিটা আমার বন্ধুকে আঘাত করল, আমাকে নয়–আমি খুশি হয়েছিলাম। লজ্জার হলেও সত্যি, আমি সত্যিকারের খুশি হয়েছিলাম যে সে মারা গেল, আর আমি বেঁচে গেলাম।’

ফালাচ্চি নিজের লেখায় বর্ণনা করেছেন, কীভাবে তিনি সামরিক হেলিকপ্টারে বসে মৃত্যুর মুখোমুখি গ্রামবাসীদের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বেঁচে থাকার জন্য প্রার্থনা করেছিলেন। এমনকি জানতেন, তার বাঁচার মানে অন্য কারও মৃত্যু হলেও — তবুও সেই প্রার্থনা থামেনি।

ঠিক এই অনিশ্চয়তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি আমরা।

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যখন ইরানের পারমানবিক কর্মসূচী থামানোর অজুহাতে ইরানি ভূখন্ডে সরাসরি সামরিক হামলা আরও বাড়িয়ে তুলছেন, তখন গেরমি, তাবরিজ এবং হামদানের সুবাশি-এর রাডার সাইটগুলো আক্রমণের শিকার হয়েছে। এসব হামলায় ইরানের বিমান প্রতিরক্ষা ও বিমান বাহিনীর বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা, অসংখ্য বেসামরিক নাগরিক এবং গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক অবকাঠামো ধ্বংস হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই হামলাগুলোতে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের ভেতরের সংযোগীদের (অভ্যন্তরীন সূত্র) সক্রিয়ভাবে ব্যাবহার করা হয়েছে। ইরানের গোয়েন্দা ব্যবস্থায় গভীর অনুপ্রবেশের মাধ্যমে এই হামলা সংঘটিত হয়, যার পরিকল্পনা ইউক্রেনের ড্রোন হামলার কৌশল অনুসরণ করে করা হয়েছে। সেই হামলাগুলো রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছিল।

ড্রোন, মাইক্রো-ড্রোন এবং হাতে বহনযোগ্য  “স্পাইক” ক্ষেপণাস্ত্রের হামলায় ইরানের ২০ জনের বেশি শীর্ষ সামরিক কমান্ডার নিহত হয়েছেন। গোয়েন্দা তথ্য এতটাই গভীরভাবে অনুপ্রবেশ করেছিল যে, হামলার কয়েক মাস আগেই এসব কমান্ডারের বাসস্থান, বৈঠকের কক্ষ এবং এমনকি শয়নকক্ষের অবস্থানও নির্ভুলভাবে শনাক্ত করা হয়। অভিযান শেষে যখন মাইক্রো-ড্রোনবাহী ট্রাকের সন্ধান মেলে, তখন তা ইঙ্গিত দেয় — ইরানের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় মোসাদের প্রবেশ কতটা ভয়াবহ এবং বিস্তৃত।

এ তো কেবল শুরু

ইরানের পারমানবিক ও সামরিক স্থাপনাগুলোর ওপর আক্রমণ আরও তীব্র হয়েছে। যদিও দেশটি আনুমানিক ৫,০০০ টির মতো বিমান প্রতিরক্ষা অবস্থান এবং প্রায় শতাধিক ভূগর্ভস্থ স্থাপনা বজায় রাখছে, তবু খন্দাক (আরাক), ফোরদো এবং নাতানজ-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে। ইসরায়েলি বাহিনী নাতানজের ভূপৃষ্ঠ স্তরের স্থাপনাগুলো সম্পুর্ন ধ্বংস করে দিয়েছে এবং ইসপাহানের বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি সাধন করেছে।

গত সপ্তাহে ইসরায়েলি হামলার পরিধি আরও বিস্তৃত হয়ে পৌঁছে গেছে ইরানের জ্বালানি শোধনাগার ও জ্বালানি অবকাঠামোর ওপর। এতে ইরানকে জ্বালানি সংকটে ফেলার হুমকি তৈরি হয়েছে। তেহরান, বান্দার আব্বাস এবং এমনকি আবাদানেও শোধনাগারে চালানো হামলা ইঙ্গিত দিচ্ছে, এটি শুধু সামরিক শক্তি কে দুর্বল করার পরিকল্পনা নয়—বরং সাধারণ মানুষের জীবনে সরাসরি আঘাত হানার সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টা। নেতানিয়াহুর লক্ষ্য এখন আর কেবল ইরানের পারমানবিক অবকাঠামো ধ্বংস করা নয়। তার নতুন কৌশল–টানা বোমাবর্ষণ আর মনস্তাত্ত্বিক সন্ত্রাসের মাধ্যমে গোটা দেশের মেরুদণ্ড ভেঙে ফেলা। এরকম কৌশল আমরা আগেও দেখেছি—গাজা, লেবানন ও সিরিয়ায়

কিন্তু ইরান সিরিয়া নয়। ইসরায়েলের বর্তমান লক্ষ্য হলো — ইরানের ভেতর গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি করা। ৯ কোটি জনসংখ্যার এই দেশটি বহুদিন ধরেই গভীর জাতিগত, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিভাজনের মধ্যে রয়েছে। কুর্দিস্তানবালুচিস্তানে সক্রিয় সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী, লাখ লাখ আফগান শরনার্থী আর আইএসআইএস-খোরাসান এর মতো উগ্রপন্থী সংগঠনের উপস্থিতি ইরানের ভেতরকার দুর্বলতাকে বিপজ্জনক মাত্রায় উন্মোচিত করেছে। অন্যদিকে, দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার বৈষম্য ও জনঅসন্তোষের মোকাবিলা না করে বরং দমন-পীড়নকেই প্রধান কৌশল হিসেবে বেছে নিয়েছে।

জবাবে, ইরান পাল্টা ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলের বিভিন্ন অঞ্চলে — যদিও ইসরায়েলের আধুনিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও আঞ্চলিক সমন্বয় থাকায় হামলার প্রভাব কিছুটা সীমিত হয়। তবুও, এই নিষ্ঠুর প্রতিশোধের চক্র থামার কোনো লক্ষণ নেই। এখন ইসরায়েল এমনভাবে যুক্তরাষ্ট্রকেও এই সংঘাতে টেনে আনার চেষ্টা করছে, যদিও আইনি দিক থেকে এমন যুদ্ধে অংশ নিতে মার্কিন কংগ্রেসের অনুমোদন প্রয়োজন। তবে নেতানিয়াহুর চূড়ান্ত লক্ষ্য হয়তো শুধু ইরনের পারমাণবিক কর্মসূচী থামানো নয়— বরং গোটা দেশটিকে ধ্বংসস্তুপে পরিনত করা।

একটি কথা স্পষ্ট করে বলা দরকার ; শুধু বিমান হামলা চালিয়েই ইরানের পারমানবিক কর্মসূচী ধ্বংস করা সম্ভব নয়। তবে ইরানকে সামাজিক বিপর্যয় ও অভ্যন্তরীণ অস্থিরতার দিকে ঠেলে দিয়ে ভেতর থেকেই শাসনব্যবস্থার পতনের পথ সহজ করে তোলা যেতে পারে। এদিকে ইরানি রাষ্ট্র নিজেই এই রাজনৈতিক সংকট সামাল দিতে অপরাগ—কিংবা ইচ্ছুক নয়। সমাজ ভেঙে পড়েছে। কেউ কেউ ইসলামিক রেভ্যুলেশনারী গার্ড কর্পস (আইআরজিসি)-এর নিহত কমান্ডারদের জন্য শোক প্রকাশ করছে, আবার কেউ এই মৃত্যুতে উল্লাস করছে। এই বিভাজন মেটানোর বদলে সরকার দমন-পীড়ন ধরপাকড় এবং ভিন্নমত দমনে আরও আগ্রাসী হয়ে উঠেছে। মোসাদের ভেতর থেকে অনুপ্রবেশের চমকে দেওয়া প্রমাণ সামনে আসার পরও তেহরান তার নিরাপত্তা ব্যবস্থা পূনর্মূল্যায়ন করেনি। রাজনৈতিক বন্দিরা এখনও কারাগারে। রাস্তা-ঘাটে নিরাপত্তা বাহিনীর নজরদারি, বিশেষ করে নারীদের উপর, আগের মতোই চলছে। মীমাংসার কোনো আলামত এখনও দেখা যাচ্ছে না।

বিরোধিতা এবং অভিযোগ সত্ত্বেও, অনেক ইরানিই বিদেশি সামরিক হস্তক্ষেপ বিরোধী। শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে ক্ষোভ থাকলেও আক্রমনের মুখে এক মূহুর্তের জন্য দেশপ্রেমিক ঐক্যের আবহ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু এই ভঙ্গুর ঐক্য বেশিদিন টিকতে পারে না—সরকারের অব্যবস্থাপনা আর দমন-পীড়ন এর মধ্যে। আর এই ভাঙনকেই হয়তো ইসরায়েল কাজে লাগানোর অপেক্ষায় আছে। পরবর্তী ধাপে তারা চেষ্টা করতে পারে—বাইরের চাপকে দেশের ভেতরে ধ্বংসযজ্ঞে পরিনত করা। অর্থাৎ বোমা, অস্ত্র আর দুর্ভিক্ষের মধ্য দিয়ে এক ধরনের নিরব শাসন পরিবর্তন ঘটানো

সম্ভবত ইরানের নতুন প্রজন্মের অনেকে—যারা যুদ্ধ আর বোমাবর্ষনের ভয়াবহতার সঙ্গে পরিচিত নয়—শুরুতে নেতানিয়াহুকে তাদের দমনপীরিত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এক ধরনের বাহ্যিক ভারসাম্য হিসেবে দেখেছিল। কিন্তু যখন বিমান হামলায় বাড়ি-ঘর ধ্বংস হচ্ছে, শিশুরা নিহত হচ্ছে, তখন ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, কোনো দখলদার সেনাবাহিনী কখনো শান্তি বা গনতন্ত্র বয়ে আনতে পারে না।

তেহরানে শিশুদের মৃত্যু – তাদের বাবা মায়ের মতাদর্শ যা-ই হোক না কেন– এক নির্মম সত্যকে প্রকাশ করে : দখলদার সেনাবাহিনী কখনো সরকার আর সাধারণ মানুষের মধ্যে পার্থক্য করে না। হ্যাঁ, ইসলামিক প্রজাতন্ত্র শাসনব্যবস্থা অত্যাচারী। কিন্তু নেতানিয়াহু তার থেকেও নির্মম। কেউ কেউ তাকে ইরানি জনগণের বন্ধু বলে দেখানোর চেষ্টা করে। কিন্তু এই গল্প মিথ্যা। আমরা এটা আগেও দেখেছি—লেবাননে, ইরাকে, গাজায়। এটা আসলে এক ধরনের ‘মানবিক বোমাবর্ষণ’ নামে প্রচারিত মিথ্যা গল্প।

এই যুদ্ধ—যা তেহরানের ভুল সিদ্ধান্ত আর নেতানিয়াহু ক্ষমতার লালসা থেকে শুরু—এখন সাধারণ মানুষের মধ্যে গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়ার ঝুঁকি তৈরি করেছে। আর সেটা হবে প্রতিটি ইরানির জন্য এক গভীর ট্রাজেডি। আর যে-ই হোক না কেন–তুর্ক, কুর্দি, ফারসি, লোর, আরব বা বালচু–সবাই বছরের পর বছর শাসনের নামে দমন-পীড়নের শিকার। এবং তাদের বুঝতে হবে, প্রকৃত পরিবর্তন কখনো ওপর থেকে বা বাইরের কেউ এনে দিবে না। সেই পরিবর্তন আসতে হবে ভেতর থেকেই।

প্রকৃত পরিবর্তন তখনই আসে, যখন কোন শাসক বুঝতে বাধ্য হয় যে, জনগণ আর তাদের পক্ষে নেই—এবং তখনি তারা জনগণের দিকে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। শান্তি পশ্চিমা বিশ্বের হাত ধরে আসে না, বরং শুরু হয় নিজের দেশের ভেতর ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। ইসরায়েল শুধু পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায়নি, বরং তাদের বহুদিনের কৌশল অনুসারে, ইচ্ছাকৃতভাবে শিশুদের টার্গেট করেছে।

কৌশলগত সামরিক স্থাপনায় হামলার ফুটেজ প্রকাশে অস্বীকৃতি জানালেও, ইসরায়েল ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে বিধ্বস্ত ভবনের ছবি সম্প্রচার করেছে, যেন তারা এই সংঘর্ষের একমাত্র ভুক্তভোগী। বার্তাটা ছিল খুবই স্পষ্ট — সামরিক আগ্রাসন আড়াল করো, বেসামরিক ক্ষয়ক্ষতির ছবি দেখাও, আর বিশ্বজনমতের সহানুভূতি অর্জন করো। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, তেহরানের শাসনব্যবস্থার কোন বৈধতা আমি স্বীকার করি না— তবে আমার ভবিষ্যৎ ঠিক করে দেওয়ায় অধিকার ইসরায়েলেরও নেই।

আমরা—আমার মতো সাধারণ মানুষরাই—নিজেদের ভবিষ্যৎ নিজ হাতে গড়ে তুলতে পারি এবং অবশ্যই গড়ে তুলতে হবে। কোনো যুদ্ধাপরাধীর হাতে নয়। ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের এই যুদ্ধ আসলে কোন কিছু ঠেকানোর লড়াই নয়। এটি মূলত ইরানের অবকাঠামো ধ্বংস করা, সমাজকে টুকরো টুকরো করে ভেঙে ফেলা, আর দেশটিকে ভেতর থেকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়ার পরিকল্পনা।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .