
তিব্বতের ইয়ারলুং সাংপো (ব্রহ্মপুত্র) নদীর একটি অংশ। চীন আগামীতে এই নদীর উপর একটি বিশাল বাঁধ তৈরি করতে চায়, যা অত্র অঞ্চলে বিতর্ক উস্কে দিয়েছে। উইকিমিডিয়া কমন্সের মাধ্যমে পাওয়া ছবি ম্যাক্সিশেং 18 এর, সিসি বাই-এসএ ৪.০ লাইসেন্সের আওতায় প্রকাশিত।
এই নিবন্ধটি জমা দেওয়া হয়েছিল গ্লোবাল ভয়সেস ক্লাইমেট জাস্টিস ফেলোশিপের অংশ হিসাবে, যে উদ্যোগটি বিশ্বে চীনা উন্নয়ন প্রকল্পের প্রভাব সম্পর্কে তদন্ত করার জন্য চীনদেশীয় এবং গ্লোবাল সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলির সাংবাদিকদের যুক্ত করে। এখানে আরও এ ধরনের গল্প পাবেন।
২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে চীন ঘোষণা করে যে, তারা তিব্বতে ব্রহ্মপুত্র নদের (স্থানীয় নাম ইয়ারলুং সাংপো) উপর বিশ্বের বৃহত্তম বাঁধটি নির্মাণ করবে যার বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা হবে ৬০,০০০ মেগাওয়াট এবং প্রতি বছর প্রায় ৩০০ বিলিয়ন কিলোওয়াট-ঘন্টা শক্তি উৎপাদন করা সম্ভব হবে। এই ঘোষণার পর নদীটিতে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। ১৩৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ের এই মেডগ জলবিদ্যুৎ প্রকল্পটি ২০৩৩ সাল নাগাদ বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাওয়ার কথা রয়েছে। এর বিপুল শক্তি সম্ভাবনা এবং একইসাথে সম্ভাব্য পরিবেশগত প্রভাবের কারণে প্রকল্পটি বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যম ও পরিকল্পনাবিদদের ব্যাপক দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।

হিমালয়ের উত্তর ঢালের জল নিষ্কাশনকারী ইয়ারলুং সাংপো (ব্রহ্মপুত্র) নদীর অববাহিকার মানচিত্র। সৌজন্যে: উইকিমিডিয়া কমন্স (সিসি বাই-এসএ ৪.০)।
এই সিদ্ধান্তটি নিয়ে জোরালো প্রতিবাদ উঠেছে ভারতে, বিশেষ করে ভাটির অঞ্চলে এর সম্ভাব্য বিরূপ প্রভাবের কারণে। আশঙ্কা করা হচ্ছে যে, নদীর পরিবর্তিত প্রবাহ বিশুদ্ধ জলের সরবরাহ এবং কৃষির উপর প্রভাব ফেলবে, একই সাথে অপ্রত্যাশিত বন্যা ও খরার ঝুঁকিও বাড়িয়ে দেবে।
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলি, যেমন অরুণাচল প্রদেশ এবং আসামের প্রায় ১৩ কোটি মানুষ এবং ৬০ লক্ষ হেক্টর কৃষি জমি এই নদীর উপর নির্ভরশীল। ভারতীয় জলবিজ্ঞানীরা আরও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে, এই বাঁধ নদীর পলি প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করতে পারে এবং ফলস্বরূপ এই অঞ্চলের মাটির উর্বরতা হ্রাস পাবে।
এর জবাবে, ভারত সরকার অরুণাচল প্রদেশের ব্রহ্মপুত্র নদীর অংশের (স্থানীয় নাম সিয়াং) ওপর ১১,০০০ মেগাওয়াটের আপার সিয়াং বহুমুখী প্রকল্প তৈরির প্রস্তাব দিয়েছে। এই প্রকল্পটি শুষ্ক মৌসুমে জলের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের জন্য ৯ বিলিয়ন ঘনমিটার জল সংরক্ষণ করবে এবং এটিকে “চীনের বাঁধ থেকে অতিরিক্ত এবং আকস্মিক জল ছাড়ার ক্ষেত্রে একটি বাঁধা” হিসাবে পরিকল্পনা করা হয়েছে। মজার বিষয় হচ্ছে, অরুণাচলের অনেক স্থানীয় বাসিন্দা এই প্রকল্পের বিরোধিতা করেছেন এবং এর প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছেন। তারা অভিযোগ করেছেন যে এর সম্ভাব্যতা সমীক্ষা গোপনে পরিচালিত হচ্ছে। তাদের ভয় – এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে অনেক লোক বাস্তুচুত এবং স্থানচ্যুত হবে এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে বহিরাগতের আগমনের কারণে সম্ভাব্য জনসংখ্যার পরিবর্তনের আশঙ্কাও রয়েছে।
অন্যদিকে, জলবায়ু সংকটের কারণে ইতিমধ্যেই তীব্র জলকষ্টে ভোগা বাংলাদেশ, তার সেচের চাহিদার ৫৫ শতাংশের পাশাপাশি পানীয় জল ও মৎস্যচাষের জন্য ব্রহ্মপুত্র (স্থানীয়ভাবে যমুনা নামে পরিচিত) নদীর ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। এই নদীর প্রবাহ দেশের ১৭ কোটিরও বেশি মানুষকে প্রভাবিত করে।
২০২২ সালে বাংলাদেশ পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, ব্রহ্মপুত্র নদীর প্রবাহ নুন্যতম ৫ শতাংশ হ্রাস পেলেও নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলে কৃষি উৎপাদনে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস হতে পারে যা খাদ্য নিরাপত্তার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে।
সেজন্যে, বাংলাদেশী কর্মকর্তারা আশঙ্কা করছেন যে বাঁধটি শুষ্ক মৌসুমে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ কমিয়ে দেবে। এ কারণে তারা চীনের কাছে একটি পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন, একটি সম্ভাব্যতা অধ্যয়ন, একটি জলবায়ু প্রভাব মূল্যায়ন এবং বাঁধের জন্যে দুর্যোগ প্রভাব মূল্যায়নের দাবি জানিয়েছে।
এমন সময়ে যখন বাঁধের সামাজিক ও পরিবেশগত ক্ষতির কারণে বিশ্বব্যাপী বাঁধ-বিরোধী আন্দোলনগুলো গতি পাচ্ছে, তখন বিপর্যয়ের ঝুঁকিতে থাকা হিমালয় অঞ্চলের দেশগুলো জলবিদ্যুৎ মেগা প্রকল্পগুলোতে বিনিয়োগ ও উন্নয়নের জন্য প্রতিযোগিতা করছে। জলবায়ু সংকটের কারণে হিমালয়ের পরিস্থিতি এখন আরও খারাপ হয়েছে। উপরন্তু, হিমালয় ভূমিকম্প প্রবণ একটি অঞ্চল, এবং এখানে হিমবাহ হ্রদ বিস্ফোরণ বন্যা ঘন ঘন ঘটে, যেখানে হিমবাহ হ্রদ ফেটে গিয়ে হঠাত বিশাল, সুনামির মতো বন্যা সৃষ্টি করে। ব্রহ্মপুত্র নদের মেডগ জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র এই ধরনের প্রতিযোগিতামূলক উদ্যোগের সর্বশেষ উদাহরণ।
এদিকে, চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম দাবি করেছে যে মেডগ জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র একটি নিরাপদ ও পরিবেশগতভাবে সংবেদনশীল প্রকল্প, যা চীনের কার্বন নিরপেক্ষতার লক্ষ্য পূরণে সহায়তা করবে। তারা আরও বলেছে যে “প্রকল্পটি নদীর নিম্ন তীরবর্তী দেশগুলিকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করবে না” এবং “নিম্নাঞ্চলের দেশগুলির সাথে যোগাযোগ বজায় রাখবে”, পাশাপাশি দুর্যোগ প্রতিরোধ ও উদ্ধারকাজে সহযোগিতা করবে।
ব্রহ্মপুত্রের ভৌগোলিক ও আঞ্চলিক তাৎপর্য
ব্রহ্মপুত্র একটি আন্তঃসীমান্ত নদী যা চীন, ভুটান, ভারত এবং বাংলাদেশ জুড়ে বিস্তৃত হিমালয় অঞ্চলে প্রবাহিত। তিব্বতের কৈলাস পর্বতের কাছে এর উৎপত্তি, যেখানে এটি ইয়ারলুং সাংপো নামে পরিচিত। চীনে ১,৭০০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করার পর এটি দক্ষিণে একটি তীক্ষ্ণ বাঁক নিয়ে অরুনাচল প্রদেশ হয়ে ভারতে প্রবেশ করে। এরপর বাংলাদেশে এটি যমুনা নামে প্রবাহিত হয় এবং অবশেষে গঙ্গা নদীর সাথে মিলিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়।

ইয়ারলুং সাংপো নদীর “তীক্ষ্ণ বাঁক”। ইউটিউব থেকে নেওয়া স্ক্রিনশট।
মেডগ জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি “গ্রেট বেন্ড (তীক্ষ্ণ বাঁক)” অঞ্চলে নির্মিত হচ্ছে, যেখানে ইয়ারলুং সাংপো নদীটি অরুণাচল প্রদেশ এবং তারপর ভারতের আসামে প্রবেশের আগে ৫০ কিলোমিটার এর মধ্যে ২,০০০ মিটার নিচে নেমে ব্রহ্মপুত্র নদী হয়ে যায়। এই পানির স্রোতের অনন্য অবস্থানটি ৬০,০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুযোগ করে দেবে।
বেইজিং চীনের বাঁধটিকে প্রচার করেছে তাদের পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎ উদ্যোগের অন্যতম অগ্রদূত হিসেবে। তাদের দাবি, এটি কয়লা-ভিত্তিক শক্তির উপর নির্ভরতা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করে ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিরপেক্ষতার লক্ষ্য পূরণ সহ তাদের জলবায়ু লক্ষ্যগুলিকে জোরদার করবে। ইতিমধ্যে, চীন জলবিদ্যুৎ, সৌর প্যানেলে এবং অন্যান্য উদ্যোগে ব্যাপক বিনিয়োগের মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব শক্তির ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী শীর্ষস্থানীয় স্থান দখল করেছে।
কাঠমান্ডু-ভিত্তিক সাংবাদিক ও লেখক, এবং ‘জলবায়ু যোগাযোগ’ বিষয়ের শিক্ষক কুন্দা দীক্ষিত গ্লোবাল ভয়েসেসের সাথে একটি সাক্ষাৎকারে এই অঞ্চলে বাঁধের সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে তার মতামত তুলে ধরেছেন:
মেডগের মতো প্রকল্পের সমপরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য হয়ত তিন থেকে চারটি বড় কয়লা প্ল্যান্ট তৈরি করতে হত। তাই আমাদের বিশ্বের পরিবেশগত স্বাস্থ্যের দৃষ্টিকোণ থেকে, বাঁধটি পরিবেশগতভাবে ততটা ক্ষতিকারক নাও হতে পারে। এবং জলবায়ুর অবনতির সাথে সাথে ব্রহ্মপুত্রের এই জল নিয়ন্ত্রণ থেকে ভারত আসলে উপকৃতও হতে পারে।
তবে, আমাদের এর ফলে নদীর বাস্তুতন্ত্রের ওপর প্রভাবের দিকে নজর দিতে হবে। আমাদের এটাও জিজ্ঞাসা করতে হবে, এই সমস্ত উৎপাদিত শক্তি কোথায় ব্যবহৃত হবে? যদি এটি চীন তথা বিশ্বের ভোগবাদকে উৎসাহিত করে, এবং অন্তহীন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দিকে ধাবিত করে যা আমাদেরকে এই ঝামেলার মধ্যে টেনে এনেছে, তবে এটি দীর্ঘমেয়াদে কারো জন্যে ভাল হবে না।
চীনের যুক্তি
জনমত গঠনের জন্য চীন যে মূল কৌশলগুলি ব্যবহার করে, তার মধ্যে অন্যতম হলো একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে স্পষ্ট একটি আখ্যান প্রতিষ্ঠা করা এবং তারপর একটি সমন্বিত অনলাইন প্রচারণার মাধ্যমে এটিকে ছড়িয়ে দেওয়া। এর মধ্যে রয়েছে সামাজিক গণমাধ্যমের জনপ্রিয় ইনফ্লুয়েন্সারদের (网红) সাহায্য নেয়া, যারা তাদের শ্রোতাদের উপযোগী করে বার্তাটি পুনরায় পোস্ট বা নতুনভাবে উপস্থাপন করেন। একই সাথে, জাল বা বেনামী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অ্যাকাউন্ট তৈরি করা হয়, যা প্রায় একই ধরনের বিষয়বস্তু শেয়ার করে এবং কৃত্রিমভাবে সেই আখ্যানের দৃশ্যমানতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ায়।
উদাহরণস্বরূপ, ইয়ারলুং সাংপো নদীর বাঁধের প্রকল্পের কথাই ধরা যাক। চীনের শীর্ষস্থানীয় সার্চ ইঞ্জিন বাইডুতে “雅鲁藏布江大坝” (ইয়ারলুং সাংপো বাঁধ) লিখে অনুসন্ধান করলে শত শত নিবন্ধ পাওয়া যায়, যার মধ্যে অনেকগুলোই আশ্চর্যজনকভাবে একই ধরনের বিষয়বস্তু বারবার তুলে ধরে। এই নিবন্ধগুলো সাধারণত একটি সুসংহত আখ্যান অনুসরণ করে, যা প্রচুর জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনা দিয়ে শুরু করে বেশ কয়েকটি আকর্ষণীয় বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে।
চীনা রাষ্ট্র এবং তাদের অনুমোদিত গণমাধ্যম জোর দিয়ে বলেছে যে ইয়ারলুং সাংপো গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন (বিশাল গিরিখাত) বিশ্বের সবচেয়ে নাটকীয় এবং সম্পদ সমৃদ্ধ নদী উপত্যকাগুলোর মধ্যে একটি। চীন দাবি করে যে যুক্তরাষ্ট্রের খ্যতনামা গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের চেয়েও গভীর এই গিরিখাতটিতে ৬,০০০ মিটারেরও বেশি উল্লম্ব পানি পতন হয় – যার কারণে জলবিদ্যুৎ উন্নয়নের জন্য এটি একটি আদর্শ স্থান।
চীনা গণমাধ্যম আরও দাবি করে যে মেডগ বাঁধের বার্ষিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ৩০০-৪০০ বিলিয়ন কিলোওয়াট-ঘণ্টায় পৌঁছাতে পারে। সরকারি বিবরণ অনুসারে, এই প্রকল্পটি কয়লার ব্যবহার এবং কার্বন নিঃসরণ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করবে, এবং এটি বিশ্বব্যাপী কার্বন নিরপেক্ষতার লক্ষ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান হিসেবে প্রশংসিত হচ্ছে।
উপরন্তু, রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে, এই বাঁধটি কেবল একটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প হিসেবে নয়, বরং একটি বৃহত্তর জাতীয় কৌশলের অংশ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। চীনের “ওয়েস্ট-টু-ইস্ট পাওয়ার ট্রান্সমিশন (পশ্চিম থেকে পূর্বে বিদ্যুৎ প্রবাহ)” কৌশলের অধীনে, মেডগ তিব্বত থেকে পূর্ব চীনের শিল্পাঞ্চলে পরিচ্ছন্ন শক্তি সরবরাহ করবে, যা কয়লার উপর নির্ভরতা হ্রাস করবে এবং চীনের শক্তি স্বায়ত্তশাসনকে বাড়িয়ে তুলবে। এই প্রকল্পটি নদীর উজানের অংশগুলোর সম্পূর্ণ বিকাশ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য চীনের সক্ষমতারও ইঙ্গিত দেয়। এটিকে তিব্বতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি উদ্দীপিত করার এবং জাতীয় সীমান্ত নিরাপত্তা সুসংহত করার একটি উপায় হিসেবেও উপস্থাপন করা হচ্ছে। পরিশেষে, বাঁধটিকে বন্যা নিয়ন্ত্রণ, খরা প্রশমন এবং এমনকি শুষ্ক মৌসুমে আন্তঃসীমান্ত জল সহায়তার একটি হাতিয়ার হিসেবেও চিত্রিত করা হচ্ছে।
এদিকে, চীনা গণমাধ্যম ইঙ্গিত দিচ্ছে যে ভারতের আপত্তিগুলো পরিবেশগত উদ্বেগের পরিবর্তে ভূ-রাজনৈতিক সন্দেহের ভিত্তিতে উদ্ভূত হচ্ছে। চীনা সূত্রগুলো যুক্তি দেয় যে বাঁধটি রান-অফ-দ্য-রিভার (অর্থাৎ, বড় আকারের সংরক্ষণের জন্য নয়) প্রকৃতির এবং পরিবেশগত ক্ষতি এড়াতে বৈজ্ঞানিকভাবে ডিজাইন করা হয়েছে। এই উদ্বেগগুলো চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর এবং চীন-নেপাল রেলপথের মতো চীনের আঞ্চলিক অবকাঠামো প্রকল্পগুলো সম্পর্কে ভারতের উদ্বেগের একটি বিস্তৃত প্যাটার্নের মধ্যে পড়ে, যার সর্বশেষ উদাহরণ হিসেবে ইয়ারলুং সাংপো বাঁধ ভারতীয়দের অস্বস্তিতে ফেলেছে।
এই বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে, চীনা সরকারের একটি বেনামী সূত্র গ্লোবাল ভয়েসেসকে বলেছে: “ইয়ারলুং সাংপো নদী বাঁধ প্রকল্পটি গোপনীয় হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছে। বর্তমানে, বিদেশী গণমাধ্যম এই বিষয়টিকে আমাদের প্রধান জাতীয় অবকাঠামোগত প্রচেষ্টাকে কলঙ্কিত ও দুর্বল করার জন্য ব্যবহার করছে—এটি আমাদের অফিসিয়াল লাইন।”
ভারত-চীন জলবিদ্যুৎ আধিপত্য
অনেক দিক থেকেই, চীন যদি মেডগ বাঁধ নির্মাণ করে, তবে তা ভারতের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে—কেবল পরিবেশগত বা জলবিদ্যুৎগত দিক থেকেই নয়, ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকেও। যেহেতু জলবায়ু সংকটের ক্রমবর্ধমান প্রভাবে জলের চাহিদা তীব্র হচ্ছে এবং জল নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে, তাই উজানের দেশ হিসেবে চীন কর্তৃক এই বাঁধ নির্মাণ দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক ক্ষমতার গতিশীলতার একটি সন্ধিক্ষণ হতে পারে, যা ভারতের নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা এবং প্রভাবকে গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
ভারত সরকার নিজেই বলেছে যে বাঁধের বিশালতা “চীনকে জলের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করতে পারে, যা একটি কৌশলগত হুমকি তৈরি করতে পারে।” প্রকৃতপক্ষে, অনেক বিশেষজ্ঞ একমত যে ভারতের প্রধান উদ্বেগ জলের প্রাপ্যতা এবং প্রবাহ নয়, বরং মেডগ জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা।
বেইজিং-এর সাথে যুক্ত সূত্রগুলো যুক্তি দেয় যে ভারত তার প্রতিবেশী দেশগুলোতে অবকাঠামোগত উন্নয়নকে ধারাবাহিকভাবে প্রতিহত করেছে—তা সে নেপালে চীনের প্রকল্প, চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর অথবা এখন ইয়ারলুং সাংপো বাঁধই হোক না কেন। এ ছাড়া, চীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পশ্চিমা মিত্রদের এই প্রকল্পের বিরোধিতা করার জন্য ভারতের প্রচেষ্টাকে প্রকৃত পরিবেশগত বা মানবিক উদ্বেগের পরিবর্তে বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ কৌশলের অংশ হিসাবে দেখছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সি.সি.টি.ভি.-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সরকারি বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে:
ইয়ারলুং সাংপো নদীর নিম্নাঞ্চলে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বিষয়ে চীন ইতিমধ্যেই তাদের অবস্থান স্পষ্ট করে দিয়েছে। আমি আবারও বলতে চাই যে এই প্রকল্পের নির্মাণ কঠোর বৈজ্ঞানিক মূল্যায়নের মধ্য দিয়ে গেছে এবং ভাটির দেশগুলির পরিবেশগত পরিবর্তন, ভূতত্ত্ব বা জল সম্পদ অধিকারের উপর এর কোনো বিরূপ প্রভাব পড়বে না। অন্যদিকে, এটি কিছুটা হলেও দুর্যোগ প্রতিরোধ, প্রশমন এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় অবদান রাখবে।