
এন্টারটেইনমেন্ট টুনাইটেরইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশিত ‘সানা ইউসুফ, টিকটক স্টার, ১৭ বছরে মৃত্যু‘ ভিডিও থেকে স্ক্রিনশট নেয়া। ফেয়ার ইউজ পলিসিতে প্রকাশিত।
১৭ বছর বয়সী ডিজিটাল কনটেন্ট ক্রিয়েটর সানা ইউসুফকে ২ জুন পাকিস্তানের ইসলামাবাদে খুন করা হয়েছে। সারা বিশ্বের বহু পাকিস্তানি নারীর মতো আমিও এই খবরে দারুণ ভাবে শোকাহত। খবরটি আমাকে ভীষণ কষ্ট দিয়েছে। কারণ এই ঘটনা শুধু সানার নয় বরং এটা সেই প্রতিটি মেয়ের গল্প, যাদের বলা হয়েছে তার জীবনের মূল্য অনেক কম, তার কণ্ঠস্বর বেশি জোরে হয়, তার স্বাধীনতা খুব ঝুঁকিপূর্ণ।
সানা ইউসুফ ছিলেন পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের চিত্রাল এলাকার প্রাণবন্ত এক তরুণী। তিনি টিকটকে ৮ লাখ ও ইনস্টাগ্রামে প্রায় ৫ লাখ অনুসারী পেয়েছিলেন যাদের সঙ্গে সংস্কৃতি, আত্মবিশ্বাস আর আনন্দ ভাগ করে নিতেন নানা ধরনের কনটেন্টের মাধ্যমে। তিনি তার মতো প্রাণোচ্ছল মেয়েদের অনুপ্রাণিত করতেন। নিজের সংস্কৃতি উদযাপন করতেন, শিক্ষা নিয়ে কথা বলতেন আর সেই ডিজিটাল জায়গায় নিজের উপস্থিতি দেখাতেন—যেখানে সাধারণত নারীদের উপস্থিতি ভালো চোখে দেখা হয় না। শুধু এই ডিজিটাল মাধ্যমে লাইমলাইটে থাকাটাই একজন পুরুষের কাছে যথেষ্ট ছিল তাকে হত্যা করার “অধিকার” আছে, এমনটা ভাবার।
তাকে খুন করা হয় তার নিজের ঘরেই। সন্দেহ করা হচ্ছে, এক ব্যক্তি যে তাকে মাসের পর মাস অনুসরণ ও হয়রানি করেছিল, সে-ই এই খুন করেছে। কারণ সে সানার ‘না’ মেনে নিতে পারেনি। তাই অনেকের মতোই, সেই মানুষটা তার কণ্ঠস্বর চিরদিনের জন্য বন্ধ করে দিল।
এই খুনের চেয়েও ভয়ানক যা হয়েছে তা হলো এরপরের প্রতিক্রিয়া: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট, রিলস, মন্তব্য — অনেকেই বলেছে, সানা নিজেই দায়ী। তার ডিজিটাল মাধ্যমে উপস্থিতি, নিজেকে প্রকাশ করা, সাহস দেখানো—এসবই নাকি তাকে ‘‘খুন হবার মতো’’ করে তুলেছে। এটা কোনো ছোট গোষ্ঠীর ভাবনা না, এটা সমাজের সামগ্রিক এক মূলধারার চিন্তা। যা মূল গণমাধ্যম থেকে শুরু করে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে ছড়িয়ে পড়েছে, প্রভাবশালীরা বলছেন, ধর্ম ও নৈতিকতার নামে এটিকে মোড়ানো হচ্ছে। এটা মূলতঃ দেখায়, আমাদের সমাজে পুরুষতন্ত্র কত গভীরে গেঁথে আছে—যেখানে একজন নারী চুপ না থাকলে, বাধ্য না হলে, দেহ ও সিদ্ধান্তের অধিকার নিজের হাতে নিলে, তখনই সে “হুমকি” হয়ে যায়।
এই মানসিকতার বিরুদ্ধে আমরা না দাঁড়ালে, আমাদের ঘরে, স্কুলে বা অনলাইনে—বিচার সবসময় দেরিতে আসবে, যদি আদৌও কখনো তা আসে।
কারণ এই ঘটনা নতুন নয়। এবং বিরল ঘটনাও নয়।
২০১৬ সালে সোশ্যাল মিডিয়ায় নারীর অধিকার নিয়ে কথা বলে যাওয়া পাকিস্তানি কন্দিল বালুচকেও তার ভাইয়ের সঙ্গে এ বিষয়গুলো নিয়ে দ্বন্ধে জড়িয়ে হত্যা করা হয়। শুধু ডিজিটাল মাধ্যমে উপস্থিত হওয়া আর সাহস দেখানোর কারণেই তাকে এমন নির্মম পরিস্থিতির শিকার হতে হয়েছে। পাকিস্তান মানবাধিকার কমিশন বলছে, ২০২১ সালে ৪৭০টির বেশি এরূপ ‘হত্যা’ মামলার রিপোর্ট করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তব সংখ্যা কয়েক হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে।
২০২২ সালে একই ধরনের ঘটনা ঘটে ১৮ বছর বয়সী সামান আব্বাসের সঙ্গে, যিনি ছিলেন একজন ইতালি ও পাকিস্তানি নারী। তিনি পারিবারিকভাবে ঠিক করা বিয়েতে রাজি না হওয়ায় তার পরিবার তাকে হত্যা করে। পরবর্তীতে এক বছর পর তার মৃতদেহ একটা ফার্মহাউসে খুঁজে পাওয়া যায়। এ অপরাধের দায়ে ২০২৪ সালে তার বাবা-মাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তার এ ঘটনা দেখিয়েছে—নারীদের দেহ, স্বাধীনতা, ভবিষ্যৎ নিয়ে নিয়ন্ত্রণ শুধু দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ না, সীমানা পেরিয়ে অন্য দেশেও হয়।
এবং এই ভয় ধনী-গরিব, প্রভাবশালী-সাধারণ সবার মধ্যেই থাকে।
২০২১ সালের জুলাই মাসে ইসলামাবাদের কূটনৈতিক পরিবারের ২৭ বছর বয়সী তরুণী নূর মুখাদ্দমকে পাশবিকভাবে নির্যাতন ও খুন করে পাকিস্তানের এক ধনী ব্যবসায়ী পরিবারের ছেলে জহির জাফর। যথেষ্ট প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও মামলা বহুদিন চলেছিল। পরবর্তীতে ব্যাপক জনচাপের কারণে অপরাধীর শাস্তি হয়। তবে অনেকেই ভয় পাচ্ছেন, আপিলে হয়তো সে ছাড়া পেয়ে যাবে। যেমন কন্দিল বালুচের ভাই শেষ পর্যন্ত মুক্তি পায়।
এগুলো কয়েকটি ঘটনা যা আমরা জানতে পেরেছি। আরও অনেক ঘটনা আমরা জানিই না। সেগুলো পুলিশ রিপোর্ট পর্যন্ত হয় না।
এই খুনগুলো শুধু খুন না। পাকিস্তানে এগুলো নারীদের প্রতিদিনের দম বন্ধ হওয়া এক দু:সহ অভিজ্ঞতা। আমরা পার্কে, রাস্তার পাশে, চায়ের দোকানে এত অনুপস্থিত কেন? কারণ আমাদের বলা হয়, আমরা সেখানে থাকার যোগ্য না।
২০২৫ সালের এপ্রিলে লাহোরে একটি ঘটনা ভাইরাল হয়। এক নারী পার্কে যোগব্যায়াম করছিলেন, তখন এক পুরুষ অভিযোগ করে তার এ যোগব্যায়াম “অশালীন”। এমন অভিযোগ করে উক্ত নারীর কাছে পরিচয়পত্রও দেখতে চাওয়া হয় এবং দ্রুত পার্ক থেকে চলে যেতে বলা হয় । নিরাপত্তাকর্মীও আশেপাশে থাকা পুরুষেরাও উক্ত ব্যক্তির পক্ষে দাঁড়ায়। শুধু সূর্যের আলোয় নিজের শরীরচর্চাও তখন “ঝুঁকি” হয়ে দাঁড়ায়। এই ঘটনা কিছুদিন আলোচনায় ছিল, কিন্তু আমাদের কাছে বিষয়টি পুরনো ও ক্লান্তিকর: কারণ পাকিস্তানে নারী হলে এমনকি চুপচাপ থাকাও বিপজ্জনক।
আমি পাকিস্তানেই বড় হয়েছি। তাই আমি জানি রাস্তা পার হতে গিয়ে বুক ধড়ফড় করা কাকে বলে। ১০ বছর বয়সে নিজের শরীরকে ছোট করে ফেলাটা কেমন হয়। নিজের নাম দরজায় দেখে, হাসি শুনে, জামা দেখে “লজ্জা”র ভয় কেমন হয়। এত বছর পরেও এই ভয় এখনো আমার শরীরে গেঁথে আছে।
২০২৫ সালে এসেও এসিড হামলা হয়—প্রতি বছর ২০০টির বেশি এবং এর বেশিরভাগই নারীদের উপর হয়ে থাকে। প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলে, তালাক চাইলে, পরিবারকে “অসম্মান” করলে—চেহারায় এসিড ছুড়ে মারা হয়। এখানে স্পষ্ট বার্তা দেয়া হয়: একজন নারীর জীবন কেবল তখনই “মূল্যবান” যখন সে অদৃশ্য, বাধ্য এবং চুপচাপ।
আমরা যারা লাহোর, লন্ডন বা নিউ ইয়র্ক এ আছি বা থাকি তাদের এসব খুনগুলো আর চমকে দেয় না। মন ভেঙে দেয়। কিন্তু ঘটনাগুলো নতুন নয়। এটাই সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার।
আমরা এটা স্বাভাবিক ভাবতে পারি না। প্রতিবাদ হিসেবে মোমবাতি জ্বালিয়ে এগিয়ে যেতে পারি না।
সানার মৃত্যু আমাদের মেধ্যে ক্ষোভের ঝড় তোলে, প্রতিবাদ হয় এবং হ্যাশট্যাগ (#JusticeForSanaYousaf, #StopHonourKillings) ভাইরাল হয়। কিন্তু বিচার শুধু এখানেই থেমে থাকলে চলবে না। তার বাবা মেয়ের হত্যার বিচার চেয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে যেখানে এটা কর্তৃপক্ষের নিজেদেরই উদ্যোগ নিয়ে করা উচিত। এই মৃত্যু, ক্ষমতাবানদের নীরবতা, আগে থেকে জানা ঝুঁকির মধ্যেও কিছু না করা—এমন সব কিছু আমাদের ভাবনাকে থমকে দেয়।
আমি এটা লিখছি শুধু একজন সাংবাদিক বা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কর্মী হিসেবেই নয় বরং আমি লিখছি একজন পাকিস্তানি নারী হিসেবে। এমন একজন হিসেবে যিনি এখনো রাতে ঘুম ভেঙে গেলে সেই পুরনো ভয় মনে করতে পারেন। বাড়ি ফেরার সময় বুক ধড়ফড় করা কেমন ছিল, সেটাও মনে পড়ে। আমি লিখছি এই বিশ্বাস নিয়ে—সানার মতো মেয়েরা কবর না বরং পুরো পৃথিবীটা পাওয়ার যোগ্য।
সানা ইউসুফকে মনে রাখা হোক কেবল তার মৃত্যু দিয়ে নয়, বরং তার জীবন দিয়ে। সে যা করেছে: তা দিয়েই সে তার জায়গা করে নিয়েছে, নিজের কথা বলেছে এবং নেচেছে।
এটাই হোক আমাদের বিপ্লব।