
তুর্কমেনেস্তানের এক পাহাড় চূড়ার সামনে দাড়িয়ে থাকা আখাল টেক প্রজাতির ঘোড়া।ছবি তুর্কমেনেস্তারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া।ফেয়ার ইউজ।
তুর্কমেনস্থান বিশ্বের অন্যতম এক প্রাচীন ও সুন্দর প্রজাতির ঘোড়ার আবাসস্থল, যে সব ঘোড়া আখাল টেক নামে পরিচিত।তুর্কমেনেস্তানের দক্ষিণের আখাল মরুভুমির টেক নামের আদিবাসীরা হাজার বছর ধরে এই ঘোড়া লালন পালন করে আসছে।
বুদ্ধিমত্তা, গতি, সহনশীলতা, বিশ্বস্ততা ও বিস্ময়কর সৌন্দর্যের কারণে পরিচিত আখাল টেক ঘোড়া সবসময় তুর্কমেনেস্তানের নাগরিকদের মূল্যবান সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হতো, যারা ঐতিহাসিকভাবে পরিবহন, চলাচল ও সঙ্গী ইিসেবে এই সব ঘোড়ার উপর নির্ভর করত।

নিজের আখাল টেক ঘোড়ায় সাওয়ার এক তুর্কমেন নাগরিক। ছবি তুর্কমেনস্থান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়-এর। ফেয়ার ইউজ।
যিশুর জন্মের ১০০০ বছরা আগেও এই ঘোড়ার ইতিহাস পাওয়া গেছে, যার ফলে এই ঘোড়ার ইতিহাস অন্তত ৩০০০ বছরের পুরনো এবং যৌক্তিকভাবে বলা যায় বিশ্বের সবচেয়ে পুরানো বিশুদ্ধ প্রজাতির ঘোড়া। যাযাবর টেক আদিবাসীরা যে এই গুরত্ব প্রদান করে যেটা মোটেও বাড়াবাড়ি নয়, যারা মানুষ পরিবহনের জন্য এই ঘোড়া ব্যবহার করে।
কারাকোরাম মরভুমি দিয়ে ঘেরা ভৌগলিক অঞ্চল এবং গবাদিপশুর জন্য চারণভূমি পর্যাপ্ত পরিমাণে না থাকার কারণে সেটি এই ধরণের ঘোড়ার প্রজননকে প্রভাবিত করেছে। এ কারণে এই প্রজাতির ঘোড়ার সংখ্যা খুবই অল্প, আর এই প্রজাতির শ্রেষ্ঠ ঘোড়াই কেবল অবশিষ্ট রয়েছে আর সেগুলোই শুধু বাচ্চা দেয়। এই রুক্ষ মরুভুমির পরিবেশে হাজার বছর ধরে পরিকল্পিত ভাবে ঘোড়া প্রজনন বা বাচ্চার জন্ম দেওয়া এক সৌন্দর্য ও টেকসই প্রজননের এক রহস্য বহন করে চলেছে করেছে।
আখাল টেক ঘোড়ার আলাদা শারীরিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এদের চামড়ার উপরে ধাতব সোনালি চেহারার উজ্জ্বলতা, তাঁদের লোমের এক আলাদা ধরণের বৈশিষ্ট্যের কারণে এই বিশেষত্ব যা আলোকে প্রতিফলিত করে। আর এই বৈশিষ্ট্যের কারণে তারা সোনালী ঘোড়া নামটি অর্জন করেছে, আর এ নামে তারা সারা বিশ্বে পরিচিত। এই সৌন্দর্যের আড়ালে লুকিয়ে আছে তাদের অসাধারণ মনোবল, শক্তি ও সহনশীলতা।

এক দুর্লভ ইসাবেল রঙ্গের এক আখাল টেক ঘোড়া। ছবি তুর্কমেনেস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে নেওয়া।ফেয়ার ইউজ।
আধুনিক বিশ্ব প্রথম এই ঘোড়ার গুণাবলীর কথা জানতে পারে ১৯৩৫ সালে এক কষ্টসহিষ্ণু ঘোড়া দৌড় প্রতিযোগিতায় যা অনুষ্ঠিত হয়েছিল তুর্কমেনিস্তানের রাজধানী আশগাবাত থেকে মস্কো পর্যন্ত। তুর্কমেনিস্তান এর ঘোড়সওয়াররা ৮৪ দিন আখাল টেক ঘোড়া নিয়ে ৪৩০০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়েছিলো, যার মধ্যে ছিল তিন দিন পানি ও খাবার ছাড়া ৩৬০ কিলোমিটার দূরত্বের কারাকোরাম মরুভূমি পাড়ি দেওয়া।
অন্যান্য ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতাতেও আখাল টেকে ঘোড়ারা অসাধারণ ফলাফল করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদাহারণ হলো এক স্ট্যালিওন ঘোড়া, যার নাম আবশিনথে, যার ঘোড়াদের নিয়ে আয়োজিত আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় সবচেয়ে বেশী ছয়টি পদক জেতার রেকর্ড রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ১৯৬০ সালে রোম গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে ড্রেসেজ (ঘোড়া পরিচালনা) প্রতিযোগিতায় স্বর্ণ জেতাসহ আরো দুটি অলিম্পিক পদক জেতার গৌরব।
যেমনটা ঘটে থাকে, আখাল টেক ঘোড়া তাঁর নিজ এলাকা তুর্কমেনেস্তানে সবচেয়ে বেশী সম্মানিত, যেখানে তাঁরা জাতীয় এক প্রতীক ও স্থানীয় সংস্কৃতি ও প্রতিদিনের জীবনের প্রধান উপাদানে পরিণত হয়েছে।২০২৩ সালে ইউনেস্কো আখাল টেক ঘোড়ার প্রজনন, শিল্প ও ঘোড়া সাজানোর যে ঐতিহ্যবাহী প্রথা রয়েছে সেটাকে ইউনেস্কো তাঁর সুক্ষ্ম সংস্কৃতির ঐতিহ্য ও মানবতার প্রতিনিধিত্বের তালিকায় লিপিবদ্ধ করেছে।
এই ঘোড়া তুর্কমেনস্তানের প্রথা ও ঐতিহ্য ইতিহাস, শিল্পের সাথে কী ভাবে ওতোপ্রতো হয়ে জড়িয়ে আছে সেটি তুর্কমেনেস্তান এই ঘোড়াদের প্রদান করা মূল্যের এক প্রতিচ্ছবি। এর এক উদাহরণ হচ্ছে এই বিয়ের অনুষ্ঠান যেখানে বর তাঁর কনের বাড়িতে হাজির হয়েছে মেয়েদের তৈরি অলঙ্কারে সজ্জিত আখাল টেক ঘোড়ায় চড়ে।

Jewelery items worn by Akhal-Teke horses. Photo from the Ministry of Foreign Affairs of Turkmenistan. Fair use.
তাঁদের ঘোড়ার প্রতি তুর্কমেনেস্তথানের নাগরিকদের ভালোবাসা দেশটির চলচ্চিত্র, সঙ্গীত ও সাহিত্যে প্রতিফলিত হয়। তুর্কমেনেস্তানের অন্যতম এক বিখ্যাত চলচ্চিত্রের নাম মেনিন দোস্তুম মেলেগুশ (আমার বন্ধু মেলেগুশ), ১৯৭২ সালের এই হাস্যরসাত্মক চলচ্চিত্রে আলতাই ভেলোদভ নামের মল্লভুমির এক তরুণের মেলেগুশ নামের এক আখাল টেক ঘোড়ার বিক্রি ঠেকানো ও তাঁকে বিদেশে নিয়ে যাওয়া থেকে বাঁচানোর চেষ্টাকে তুলে ধরা হয়েছে।
এই চলচ্চিত্রটি ইউটিউবে দেখাতে পাওয়া যাবে।
এছাড়াও তুর্কমেনেস্তানের এক জনপ্রিয় গায়ক হাজিইয়ে ইয়াজমামেদেও এর মেলেগুশ (কমলা পাখি) নামের একটি গানও রয়েছে যা আখাল টেক ঘোড়াকে উৎসর্গ করে গাওয়া হয়েছে।
নীচে মেলেগুশ গানটির ভিডিও দেওয়া হয়েছে।
এইসব ঘোড়াদের সবচেয়ে বড় ভক্ত হচ্ছে তুর্কেমেনেস্তানের শাসক রাষ্ট্রপতিরা, যারা কীনা আখাল টেক ঘোড়াকে তাঁদের ব্যাক্তিত্বের সাথে যুক্ত করে প্রায় পূজনীয় এক উপাদানে পরিণত করেছে।দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি সাপারমুরাত নিয়াজভ তাঁর নিজের ঘোড়া ইনারদাগ (আগুনে পর্বত) তুর্কমেনেস্তানের কোট অফ আর্মস বা প্রতীকে স্থাপন করেছেন ও তিনি দেশে এক অশ্ব মন্ত্রণালয় স্থাপন করেছেন, আর এর ফলে এই দেশে বিশ্বের একমাত্র দেশে পরিণত হয়েছে যেখানে এরকম এক মন্ত্রণালয় রয়েছে।
তাঁর উত্তরসুরি গুরবানংগুলি বেরিদিমুহাম্মদিউ তাকেও ছাড়িয়ে গেছেন ইয়ানরদাগ, পোলাটলি (ইস্পাত) ও তাঁর নিজস্ব ঘোড়া একে খান (সাদা খান) এর ভিন্ন মূর্তি তৈরি করেছেন, যা খোড়া পায়ে দশ মিটার যাওয়ার বিশ্ব রেকর্ড গড়েছে।
আখাল টেক ঘোড়া দেশটির দুর্দান্ত সব একনায়কদের সাথে সংযুক্তির কারণে বিদেশী প্রচার মাধ্যমে দুর্নামের ভাগিদার হচ্ছে।তবে এরা কেবল তুর্কমেনেস্তানের স্বৈরশাসকদের ঘোর পছন্দের প্রাণী শুধু নয়, বরঞ্চ সত্যিকারের এক জাতীয় প্রতীক- তুর্কমেনিস্তানের সংরক্ষিত ইতিহাস এর এক জীবন্ত অংশ ও জাতীয় গর্ব এবং আনন্দের এক উৎস।