
রোহিঙ্গা শরণার্থীর ক্যাম্প-২৬, টেকনাফ, কক্সবাজার, বাংলাদেশ। ছবিটি মাসুম-আল-হাসান রকি দ্বারা উইকিমিডিয়া কমনস এর মাধ্যমে সংগৃহীত। CC BY-SA-4.0.
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলা কক্সবাজারে নজিরহীন রোহিঙ্গা শরণার্থীর প্রবাহ সেখানকার পরিবেশগত ভঙ্গুর এলাকাটিকে হুমকির সম্মুখীন করছে। ১৩ লাখের ঊর্ধে রোহিঙ্গা শরণার্থী ও ১৭ লাখ মোট বসবাসকারী জনগোষ্ঠী, উপরন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের চাপ, অঞ্চলটি গুরুত্বর মানবসৃষ্ট পরিবেশগত সমস্যায় ভুগছে, যার ফলে বন উজাড়, জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি, দূষণ, পানি স্বল্পতা, বাসস্থান হারানো এবং বিচ্ছিন্ন হওয়ায়, অনেক বিপন্নপ্রায় বন্যপ্রজাতির বিলুপ্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
২০১৭ সাল থেকে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন ও সহিংসতা শুরু হওয়ায় মিয়ানমার থেকে বেশিরভাগ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এই ১৩ লক্ষ শরণার্থীরা বাংলাদেশের সবথেকে স্পর্শকাতর ও জৈবিকভাবে দুর্বল এলাকাগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে, টেকনাফ বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, হিমছড়ি জাতীয় পার্ক এবং ইনানী রক্ষিত এলাকাগুলোও তার অন্তর্ভুক্ত।
টেকনাফ বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ১১,৬১৫ হেক্টর এলাকা রক্ষা করে, ও হিমছড়ি জাতীয় পার্কের আনুমানিক ৫৫০ হেক্টর এলাকা- যেগুলো তুলনামূলকভাবে নিরবিচ্ছিন্ন গ্রীষ্মমন্ডলীয় মিশ্র চিরসবুজ বন- রক্ষা করে। এখানে রয়েছে কুলু বাদরের বাসস্থান এবং বাংলাদেশের বিপন্ন এশিয়ান হাতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি করিডোর।
২০১৮ সালের জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) এর পরিবেশের উপর প্রভাব নামক একটি গবেষণায় কক্সবাজারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রবাহের কারণে ১১টি মূখ্য পরিবেশগত প্রভাব শণাক্ত করেছে।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে, প্রাকৃতিক বন, সুরক্ষিত এলাকা, সঙ্কটপূর্ণ বাসস্থান, গাছপালা, বন্যপ্রাণী ও সামুদ্রিক এবং মিঠাপানির বাস্তুতন্ত্রগুলোর উপর সবথেকে বেশি প্রভাব পড়েছে।
অতিরিক্ত জনবসতি হওয়ায়, হাতির পালেরা বনের মাঝে চলাচল করতে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। মাঝেমধ্যে, তাদের চলার পথে কোনো কিছু বাঁধা সৃষ্টি করলে সেগুলো উপেক্ষা করে তারা এগিয়ে যায়, এখান থেকে মানুষ ও হাতির মাঝে দ্বন্দ সৃষ্টি হয় যার ফলে উভয় রোহিঙ্গা শরণার্থী ও স্বাগতিক জনগোষ্ঠীর অনেকেই হতাহতের স্বীকার হয়েছে।
হাতির পাশাপাশি, আরও অনেক বন্যপ্রাণী – পাখি, স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং সরিসৃপও অন্তর্ভুক্ত – তাদের বাসস্থান হারানোর পরে ক্ষতির শিকার হচ্ছে। নানান প্রজাতির গাছপালাও, যেমন ঔষধি গাছ, বাঁশ, বেত এবং গুল্ম, নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে।
পূর্বে, কক্সবাজার ও টেকনাফের সুবিশাল পাহাড়ি বন ৫২৫ প্রজাতির গাছের এবং অনেক স্তন্যপায়ী প্রাণীরও আবাসস্থল ছিল। কিন্তু, গত সাড়ে পাঁচ বছরে, সেই সকল বন এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌছে গিয়েছে।
কক্সবাজারে বন উজাড়
বিশ্ব ব্যাংক ২০২২ সালের এক প্রতিবেদনে উপগ্রহ উপাত্ত ও প্রশিক্ষিত শ্রেণীবিন্যাস অ্যালগোরিদম ব্যবহার করে সময়ের প্রবর্তনে কত পরিমাণ জমির লোকসান হয়েছে সেটি দেখিয়েছে। উক্ত প্রতিবেদনে কক্সবাজার মানচিত্রে (শরণার্থী ক্যাম্পের এলাকা অন্তর্ভুক্ত করে) ১৬,৬০৭ হেক্টর বনের ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা (এল ইউ এল সি) নথিভুক্ত করা হয়েছে।
২০১৭ সাল থেকে সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় মাত্রায় বনের ক্ষতি হয়েছে ২০২০ সাল পর্যন্ত, স্বাভাবিকভাবে ২০১৭ ও ২০১৮ সালে প্রায় ৭০০,০০০ রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে স্থানান্তর হওয়ার সাথে যেটা মিলে যাচ্ছে। ২০১৭ সাল থেকে আনুমানিক ১,৩৩৭ হেক্টর বনকে বাসস্থানে রূপান্তর করা হয়েছে।
বিশ্ব ব্যাংকের এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে ক্যাম্প সীমানার এক কিলোমিটারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হারে বন ধ্বংস হয়েছে, যা ক্যাম্পবাসীদের মানবিক কার্যকলাপের কারণে ঘটেছে। গবেষণায় আরও দেখা গিয়েছে যে ক্যাম্পের পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে বসতি স্থাপনের জন্য বনাঞ্চল পরিষ্কার করার সুস্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে।
২০১৬ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত ক্যাম্প এলাকা ৮৩৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, এটি আরও ইঙ্গিত দেয় যে একই সময়ের মধ্যে ১৭৫ হেক্টর থেকে ১,৫৩০ হেক্টর পর্যন্ত বৃদ্ধি ঘটেছে, যা ৭৭৪ শতাংশ বৃদ্ধি নির্দেশ করে।
সর্ববৃহত শরণার্থী শিবিরটি, কুতুপালং-বালুখালি কম্পাউন্ড, ২০১৬ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে মোট ১,২১৯ হেক্টর এলাকা বৃদ্ধি পেয়েছে।
বসতির বিস্তার ছাড়াও, প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা, সেবা ও অবকাঠামোগত প্রোজেক্ট যেমন সড়ক, পানি, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা এবং স্বাস্থ্যবিধি কাঠামোগুলোর উন্নতির কারণেও ঐ এলাকার বন উজাড় হয়ে গিয়েছে। গবেষকদের মতে, এর কারণে বনটির অর্থনৈতিক স্বম্ভাবনা ও কদর কমে গিয়েছে।
পরিবেশগত ও আর্থিক প্রভাব
জ্বালানী কাঠের জন্য ২৩৪ হেক্টর আবাদি বন ও ৫০৮ হেক্টর প্রাকৃতিক বন সহ রোহিঙ্গা শরণার্থীরা তাদের ক্যাম্পের বাইরের ৭৪২ হেক্টর বনকে উজাড় করে ফেলেছে।
উপরন্তু, বন উজাড়ের ফলে ১৩.৫৮ শতাংশ কাঁচামাল ১৪.৫৭ শতাংশ জীববৈচিত্র্যের হ্রাস পেয়েছে, যা সর্বমোট ২,৪২০.৬৭ কোটি বাংলাদেশী টাকা (২২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) সমতুল্য ক্ষতির পরিমাণে দাঁড়িয়েছে।
২৫শে আগস্ট, ২০১৭ থেকে, ক্যাম্পের বাসিন্দারা ৪,৯৩৭ হেক্টর সামাজিক ও প্রাকৃতিক বনকে ধ্বংস করেছে, কারণস্বরুপ ৯,৮২০ কোটি বাংলাদেশী টাকার (আনুমানিক ৯০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) লোকসান হয়েছে।
কক্সবাজারের দক্ষিণ বন বিভাগের মতে, বন্য সম্পদ ধ্বংসের কারণে আনুমানিক ৯,৪৫৭ কোটি বাংলাদেশী টাকার (৮৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, যথারীতি জীববৈচিত্র্যের লোকসান হয়েছে ২,২৩৪ কোটি বাংলাদেশী টাকা (২০৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার)।
সর্বমোট ক্ষতির পরিমাণ দাড়াচ্ছে ১১,৮৬৫.৫৬ কোটি বাংলাদেশী টাকা (১.০৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার)।
জ্বালানি কাঠের জন্য বনউজাড়

বাংলাদেশের কক্সবাজারের জেলা নির্দেশক ম্যাপ। ছবিটি আরমান আজিজ দ্বারা উইকিমিডিয়া কমনস এর মাধ্যমে সংগৃহীত। CC BY-SA 4.0.
বন বিভাগের মতে, রোহিঙ্গা আবাসস্থান ও সংশ্লিষ্ট সকল প্রকল্পের জেরে প্রায় ৪,৯৩৭ হেক্টর বন তছনছ করা হয়েছে। সেইসাথে, অতিরিক্ত ১,২০০ – ১,৬০০ হেক্টর বনের জমি জ্বালানী কাঠের জোগানের জন্য ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়।
রোহিঙ্গারা মূলত ক্যাম্পের আশেপাশের বন্য এলাকার উপর নির্ভরশীলতা জ্বালানী কাঠের জন্য, অর্থাৎ প্রতিদিন, ১.৩ মিলিয়ন বাসিন্দারা প্রায় ৫০,০০০ কিলোগ্রাম জ্বালানী কাঠ ব্যবহার করে থাকে। সর্বোমোট প্রতিদিন যেটা ৫ কোটি বাংলাদেশী টাকা (৪১৩,৩৭২ মার্কিন ডলার) সমপরিমাণ আর্থিক লোকসান।
রোহিঙ্গা সংকটের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় ৮ বছর পর, শুধুমাত্র ৪০ শতাংশ নতুন-আগত রোহিঙ্গারা ক্যাম্পে থাকছে। বাকিরা নতুন আশ্রয়ের তৈরি করার জন্য পাহাড় কাটছে ও বন উজাড় করে ফেলছে।
বর্তমানে, এলাকাটির গড় পরিবার ৬ কিলোগ্রাম কাঠ প্রতিদিন ব্যবহার করে। টেকনাফে বার্ষিক মাথাপিছু জ্বালানি কাঠের ব্যবহার অনুমান করা হয়েছিল ১,১৬৮ কিলোগ্রাম।
২০১৮ সালের আগস্ট মাসে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (LPG) প্রকল্পের পরীক্ষামূলক পর্যায় চালু হওয়ার আগে, রোহিঙ্গা শরণার্থীরা প্রতি মাসে আনুমানিক ৬,৮০০,০০০ কিলোগ্রাম জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করছিল।
২০১৯ সালের নভেম্বরের মধ্যে এলপিজি (LPG) কর্মসূচির ফলে রোহিঙ্গা শিবিরে বসবাসকারী পরিবারের মধ্যে জ্বালানি কাঠের চাহিদা ৮০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে, যা বন উজাড়ের হারকে টেকসই বন ব্যবস্থাপনার সীমার মধ্যে নিয়ে এসেছে।
তবে, ইউএনএইচসিআর (UNHCR) কখনোই শরণার্থী শিবিরে ১০০ শতাংশ জ্বালানি সরবরাহ করেনি, কারণ অনেক শরণার্থী এলপিজি বা চুলার প্রযুক্তির সাথে অপরিচিত
জাতিসংঘ সতর্ক করেছে যে তহবিলের অভাবে ২০২৫ সালের এপ্রিল থেকে বাংলাদেশে প্রায় এক মিলিয়ন রোহিঙ্গা শরণার্থীর খাদ্য রেশন অর্ধেক করতে বাধ্য হবে।
যদি খাদ্য, রান্নার জ্বালানি বা আশ্রয়ের জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল কমে যায়, তাহলে এটি ইতিমধ্যেই সংকটাপন্ন এই সম্প্রদায়ের জন্য মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে।
এটি শরণার্থীদের নির্যাতনের শিকার হওয়ার সম্ভাবনা বাড়াতে পারে এবং কক্সবাজারের সংরক্ষিত জাতীয় উদ্যানের বন ও পাহাড়ের প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর তাদের নির্ভরতা আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।
২০১৯ সালে ইউএনএইচসিআর (UNHCR) এবং তাদের সহযোগী সংস্থাগুলি সিআরএনএস (CRNS), আইইউসিএন (IUCN) এবং ব্র্যাক (BRAC) ১৫০ হেক্টর জমিতে গাছ ও গুল্ম রোপণ করেছে, যা মাটির পুনরুদ্ধার এবং ২.৫ কিলোমিটার দীর্ঘ জলপ্রবাহ পুনর্বাসন করতে সহায়তা করেছে।
যদিও এলপিজি চালু করা এবং পুনরায় বনায়ন বন উজাড় কমাতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে, তবে এই উদ্যোগগুলো পরিবেশগত ক্ষতির প্রকৃত মাত্রা মোকাবিলা করতে পারেনি।
বাংলাদেশ সরকারের কক্সবাজারে নেওয়া পদক্ষেপের অংশ হিসেবে, এই পরিস্থিতি পরিবেশ ও প্রতিবেশ পুনরুদ্ধারে জরুরি হস্তক্ষেপ ও বিনিয়োগের দাবি রাখে।
কক্সবাজারের পরিস্থিতি মানব কল্যাণ ও পরিবেশ সংরক্ষণের মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে।