
উইকিমিডিয়া সাধারণের মাধ্যমে পাওয়া ১৬তম ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনে (২০২৪) চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিংয়ের সাথে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাক্ষাৎ। সৃজনি সাধারণ একইরকম ভাগাভাগি ৪.০।
সাম্প্রতিক দশকগুলিতে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলি ভারত ও চীন উভয়ের প্রধান অবকাঠামো বিনিয়োগের গুরুত্বপূর্ণ গন্তব্যস্থলে পরিণত হয়েছে। এই দুটি আঞ্চলিক শক্তির ক্রমবর্ধমান পদচিহ্ন ভারত মহাসাগরের তীর থেকে হিমালয়ের পাদদেশ পর্যন্ত উন্নয়ন ভূদৃশ্য পুনর্নির্মাণ করছে। অনেক প্রকল্পের ফলাফল একই রকম হলেও সেগুলি স্থানীয় অর্থনীতি ও দৈনন্দিন জীবনে তাদের প্রভাব নিয়ে উদ্বেগও তৈরি করেছে।
চীনের বন্ধনী ও সড়ক উদ্যোগ: সূচনা ও বিতর্ক

প্রস্তাবিত বন্ধনী ও সড়ক উদ্যোগ। ২০১৭ সালে লোমস অলংকৃত, উইকিমিডিয়া সাধারণের মাধ্যমে। সৃজনি সাধারণ একইরকম ভাগাভাগি ৪.০।
চীনের ২০১৩ সালে প্রথম শুরু বন্ধনী ও সড়ক উদ্যোগ (বিআরআই) সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী আন্তর্জাতিক অবকাঠামো প্রচেষ্টার অন্যতম হিসেবে বিবেচিত। বিআরআই ১৫০টিরও বেশি দেশে ১ লক্ষ কোটি ডলারেরও বেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকা জুড়ে বন্দর, রেলপথ, মহাসড়ক ও জ্বালানি নেটওয়ার্কের উন্নয়নে সহায়তা করেছে। সবুজ অর্থায়ন ও উন্নয়ন কেন্দ্রের মতে কোভিড-১৯ মহামারীর পরে মূলত বিভিন্ন চীনা নীতিনির্ধারণী ব্যাংক ও রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি পরিচালিত বিআরআই অর্থায়নে পুনরুজ্জীবন ঘটেছে।
তবে শ্রীলঙ্কায় বিআরআই একটি সতর্কতামূলক উদাহরণ। চীনের রপ্তানি-আমদানি ব্যাংকের ঋণে নির্মিত হাম্বানটোটা বন্দর প্রত্যাশিত রাজস্ব তৈরি করতে পারেনি। সার্বভৌমত্ব ও অর্থনৈতিক দুর্বলতা উদ্বেগ প্রকাশ করে শ্রীলঙ্কা সরকার ২০১৭ সালে চীনা ব্যবসায়িক বন্দর হোল্ডিংসকে ৯৯ বছরের জন্যে ইজারা দেয়। সমালোচকরা – বিশেষ করে পশ্চিমা গণমাধ্যম – এটিকে চীনের “ঋণ-ফাঁদ কূটনীতি“র প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করলেও চীনা কর্মকর্তারা এই দাবিটি দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেছে।
কিছু পণ্ডিতের যুক্তিতে “ঋণ-ফাঁদ কূটনীতি” শব্দটি বিভ্রান্তিকর। জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেবোরা ব্রুটিগাম তার ২০২০ সালের প্রবন্ধ “চীনের ‘ঋণ-ফাঁদ কূটনীতি'র একটি সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি: একটি মিমের উত্থান“-এ যুক্তি দেন শ্রীলঙ্কার মতো দেশগুলিতে ঋণ সংকট মূলত চীনের জোর-জবরদস্তির পরিবর্তে অভ্যন্তরীণ অব্যবস্থাপনা, আগ্রাসী অবকাঠামো ব্যয় ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চাপের কারণে ঘটেছে।
বিদেশী উদ্যোগগুলি বাংলাদেশের অবকাঠামো ও জ্বালানি দৃশ্যপটকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করেছে। এর একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ চীনা তহবিল ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা নিয়ে বিআরআই কাঠামোতে নির্মিত ২৪৮ কোটি ডলারের কয়লাভিত্তিক প্রকল্প পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ২০২০ সাল থেকে চালু হয়ে দীর্ঘস্থায়ী জ্বালানি ঘাটতি দূর করতে সাহায্য করলেও পরিবেশগত প্রভাব ও আমদানিকৃত কয়লা নির্ভরতার জন্যে সমালোচিত। তাছাড়া এটি দীর্ঘমেয়াদী স্থায়িত্ব ও ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তিতে বাংলাদেশের জলবায়ু প্রতিশ্রুতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণতা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি করেছে।
আরো পড়ুন: যুক্তরাষ্ট্রের নতুন বিকল্প প্রস্তাবে চীনের বন্ধনী ও সড়ক উদ্যোগ কৌশল পুনর্বিবেচনা বাংলাদেশের
রাজধানীর বিমানবন্দরকে প্রধান শিল্প এলাকাগুলির সাথে সংযুক্ত করে ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ আরেকটি প্রধান বিআরআই প্রকল্প হলো ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। চীনা বৃহৎ সেতু প্রকৌশল কোম্পানি বাস্তবায়িত প্রকল্পটি ২৫ বছরের নির্মাণ-মালিকানাধীন-স্থানান্তর মডেলের একটি সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব হিসেবে গঠিত। এটি যানজট কমিয়ে সরবরাহ দক্ষতা বৃদ্ধি করবে বলে আশা করা হলেও বিশেষজ্ঞরা প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের অভাব ও আর্থিক ব্যবস্থায় সীমিত স্বচ্ছতা চিহ্নিত করেছে।
বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ২০২৫ সালের মার্চ মাসে চীন সরকারি সফরের সময় দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা জোরদারের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে সফলভাবে বাংলাদেশের জন্যে মোট ২১০ কোটি ডলার বিনিয়োগ, ঋণ ও অনুদানের প্রতিশ্রুতি নিশ্চিত করেন।

মালদ্বীপ ও চীনের নেতাদের অংশগ্রহণে একটি চুক্তি অনুষ্ঠান, ১০ জানুয়ারি, ২০২৪। ছবি উইকিপিডিয়া ও মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের মাধ্যমে। প্রকাশ্য ডোমেন
মালদ্বীপে বিআরআইয়ের চীনা ঋণ প্রধান আবাসন প্রকল্প এবং মালে ও হুলহুলে দ্বীপ সংযোগকারী গুরুত্বপূর্ণ সিনামালা সেতুর জন্যে ছিল। বিভিন্ন প্রতিবেদন ২০১৮ সালে মালদ্বীপের মোট সরকারি ঋণ বেড়ে তার জিডিপির ৭২ শতাংশে প্রায় ৩৮০ কোটি ডলারে পৌঁছানোর ইঙ্গিত দেয়।
আবার মালদ্বীপে আগের বছরে জিডিপির ১১০.৪% ঋণ ২০২৪ সালের প্রথম ত্রৈমাসিকে ১১৬.৫%-এ উন্নীত হয়ে মোট ঋণ প্রায় ৮২০ কোটি ডলারে হলে উদ্বেগ দেখা দেয়। চীন দেশটিকে বৈদেশিক ঋণের একটি বড় অংশ প্রায় অর্ধেক মোট ১৩৭ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে। ঋণের ক্রমবর্ধমান বোঝা স্বায়ত্তশাসন ও পরিশোধের শর্ত নিয়ে উদ্বেগ তৈরি করেছে।
তবে মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ মুইজ্জু চীনকে “মালদ্বীপের নিকটতম মিত্র ও উন্নয়ন অংশীদারের অন্যতম” বর্ণনা করেছেন। অবকাঠামো উন্নয়নের লক্ষ্যে তিনি গভীরতর বিআরআই সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। দেশে চীনের পদচিহ্ন আরো প্রসারিত করে ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে চীনা যান্ত্রিক প্রকৌশল কর্পোরেশন (সিএমইসি) মালদ্বীপের নির্মাণ, গৃহায়ন ও অবকাঠামো মন্ত্রণালয়ের সাথে মালে অ্যাটলের গুলহিফালহু দ্বীপে প্রধান অবকাঠামো নির্মাণের একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।
ভারতের উত্থান: প্রতিবেশী প্রথম ও পূর্বমুখী নীতি

আসিয়ান-ভারত ও পূর্ব এশিয়া শীর্ষ সম্মেলনে যোগদানের জন্যে ম্যানিলায় পৌঁছালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে স্বাগত জানানো হয়, ১২ নভেম্বর, ২০১৭। উইকিমিডিয়া মাধ্যমে পাওয়া।
দীর্ঘকাল আঞ্চলিক শক্তি প্রতিভাত ভারত বৈদেশিক কূটনীতির হাতিয়ার হিসেবে ক্রমবর্ধমানভাবে অবকাঠামো ব্যবহার করলেও ভুটান বাদে ভারতের দক্ষিণ এশীয় প্রতিবেশীদের বেশিরভাগই চীনের বিআরআইয়ে যোগদনের ফলে অঞ্চলটি জুড়ে চীনা বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। চীন ২০১৮ সাল থেকে বাংলাদেশ, মালদ্বীপ, মিয়ানমার, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে ১৫ হাজার কোটি ডলারেরও বেশি বিনিয়োগ করেছে।
চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ভারতে উদ্বেগ সৃষ্টি করায় দক্ষিণ এশীয় দেশগুলির মধ্যে সম্পর্ক গভীরতর করতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি “প্রতিবেশী প্রথম” নীতির মাধ্যমে ভারতের আঞ্চলিক প্রচারণা জোরদার করেছেন। এটির পরিপূরক “পূর্বমুখী নীতি” দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও বৃহত্তর এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সাথে ঘনিষ্ঠ অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। চীনের ঋণ-চালিত মেগা-প্রকল্পের বিপরীতে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি তিনটি মূল নীতি: স্বচ্ছতা, সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা ও জনগণকেন্দ্রিক উন্নয়নের উপর জোর দেয়।
শ্রীলঙ্কায় ২০২২ সালের অর্থনৈতিক সংকটের সময় ৪০০ কোটি ডলারেরও বেশি ঋণ সহযোগিতাসহ ভারতের অবকাঠামোগত সম্পৃক্ততা মূলত কৌশলগত সহায়তার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে। জ্বালানি ও খাদ্যের মতো অপরিহার্য আমদানির আওতাধীন এই সহায়তা শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বিশেষ করে ত্রিনকোমালি তেল ট্যাঙ্ক ফার্ম ও উত্তরাঞ্চলে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উদ্যোগের মতো প্রকল্পের মাধ্যমে ভারত জ্বালানি সহযোগিতায়ও অবদান রাখলেওএই প্রচেষ্টাগুলির স্বচ্ছতা ও স্থানীয় প্রভাব সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। উদাহরণস্বরূপ, প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র প্রক্রিয়া ছাড়াই ভারতের আদানি গ্রুপকে ৪৪.২ কোটি ডলারের একটি বায়ুশক্তি প্রকল্প পরিবেশগত তদারকি ও জাতীয় সার্বভৌমত্ব নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
মালদ্বীপে ভারতের প্রধান উদ্যোগ ৫০ কোটি ডলারের বৃহত্তর মালে সংযোগ প্রকল্প (জিএমসিপি) ২০২২ সালে জাতীয় সার্বভৌমত্ব হুমকিতে ফেলে বিদেশী সামরিক উপস্থিতি সক্ষম করার অভিযোগে বিরোধীদের “ভারতহটাও” আন্দোলনের তীব্র প্রতিক্রিয়ার মুখে পড়ে। এই প্রতিবাদ উন্নয়ন ও বহিরাগত প্রভাব উদ্বেগের ভঙ্গুর ভারসাম্যকে তুলে ধরে।
আরো পড়ুন: ভারতের প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে সামাজিক মাধ্যমে মন্তব্যের জন্যে মালদ্বীপের তিন উপমন্ত্রীর শাস্তি
আস্থা পুনর্গঠনের চেষ্টায় ভারত ২০২৪ সালে মালদ্বীপের ২৮টি দ্বীপ জুড়ে ১১ কোটি ডলারের (প্রায় কোটি টাঁকা) একটি স্যানিটেশন প্রকল্প চালু করে। কূটনৈতিক আলোচনার পর ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে জিএমসিপি নির্মাণ কাজ আবার শুরু হয়। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক পুনরুদ্ধারে আন্তরিকতার চিহ্ন হিসেবে ভারত ২০২৫ সালের মার্চ মাসে মালদ্বীপের নাগরিকদের জন্যে ভিসা-মুক্ত ভ্রমণ চালু করে।
বর্তমানে খুলনার রামপালে ভারতের বিশেষ অর্থায়ন কর্মসূচির আওতায় অর্থায়িত ভারত ও বাংলাদেশের সম-অংশীদারিত্বের যৌথ উদ্যোগ কয়লাভিত্তিক মৈত্রী সুপার তাপ-বিদ্যুৎ প্রকল্প বাংলাদেশের গ্রিডে ১,৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। বাংলাদেশে ২০২৪ সালের আগস্টে সরকার পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী পাইপলাইনের মতো বেশ কয়েকটি প্রকল্প অনির্দিষ্টকালের জন্যে স্থগিত করা হয়েছে।

থাইল্যান্ডের ব্যাংককে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে মোদির সাক্ষাৎ, ৪ এপ্রিল, ২০২৫। উইকিপিডিয়া ও ভারত সরকারের মাধ্যমে পাওয়া ছবি। প্রকাশ্য ডোমেন।
ব্যাংককে বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে ৪ এপ্রিল, ২০২৫ তারিখে মোদি মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে সাক্ষাতে ২০২৪ সালের পর প্রথমবার আলোচনা হয়। এই বৈঠক পুনর্মিলন ও স্থগিত প্রকল্প চালু করার সুযোগ তৈরি করে।
সামনের পথ
উত্তেজনার ইতিহাস সত্ত্বেও দক্ষিণ এশিয়ার মূল খেলোয়াড় চীন ও ভারতের প্রত্যেকেরই আলাদা কৌশল রয়েছে। চীন বৃহদাকার বিআরআই প্রকল্পগুলিতে মনোনিবেশ করলেও ভারত সংযোগ ও সক্ষমতা বৃদ্ধিকে অগ্রাধিকার দেয়। তবে ভারত ও চীনের স্বার্থসংশ্লিষ্ট পারস্পরিক সহযোগিতার সুযোগ তৈরি করা কিছু ক্ষেত্রও রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার অবকাঠামোগত চাহিদা লক্ষকোটি ডলারে পৌঁছে যাওয়ায় উভয় দেশের উদ্যোগ পরস্পরের পরিপূরক, বাণিজ্য ও বিনিয়োগের মাধ্যমে তাদের প্রভাব বিস্তার করছে। প্রতিবেশীদের সাথে উন্নত সংযোগ ও বাণিজ্য থেকে লাভবান হলেও আজকের ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে ভারতকে অর্থনৈতিক কূটনীতি জোরদার করতে হবে।