
নাইজেরিয়ার লাগোসের একটি রাস্তায় এপ্রিল মাসে তীব্র তাপপ্রবাহ দৃশ্যমান। পেক্সেলস থেকে নেওয়া ছবি। ব্যবহার উন্মুক্ত।.
লিখেছেন: ওলুওয়াজোমিলোজু টুকি, আফিয়িনফোলুওয়া আকিনমাদে এবং ওলুওয়াতোসিন লরেন্স
এবছর এপ্রিলের মাঝামাঝি উত্তর নাইজেরিয়ায় একটি ঐতিহাসিক তাপপ্রবাহের ফলে বেশ কয়েকটি অঞ্চলে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস (১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট) ছাড়িয়ে গেছে এবং এমনকি কিছু শহরে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস (১০৭.৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট) পর্যন্ত পৌঁছেছে।
নাইজেরিয়ার নাগরিক, চিকিৎসক ও পরিবেশ বিজ্ঞানীরা এখন চরম তাপ পরিস্থিতি ও জনগণের উপর এর প্রভাব নিয়ে ব্যাপক উদ্বিগ্ন। নাইজেরিয়ার আবহাওয়া সংস্থা (নিমেট) তাপ-সম্পর্কিত ঝুঁকি থেকে জনগণকে সুরক্ষার সতর্কতামূলক বিবৃতি জারি করে জনগণকে ঠান্ডা থাকা ও তাদের শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের উপায় অনুসন্ধানের পরামর্শ দিয়েছে।
উচ্চ তাপমাত্রাটি স্বাভাবিক ঋতু পরিবর্তনের বাইরে। এই ঘটনা অব্যাহত থাকলে তা একটি বিপজ্জনক নতুন স্বাভাবিকের ইঙ্গিত হতে পারে। নাইজেরিয়ায় তাপের মাত্রা প্রতি বছর ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং গত কয়েক দশকে পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। এই বৃদ্ধির জন্যে মূলত লোভ, সম্পদ সঞ্চয় ও বিশ্বায়ন পরিচালিত মানব-সৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ী করা যেতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের অনেক মানবিক চালিকাশক্তির মধ্যে অন্যতম বড় অবদানকারী কয়লা, তেল ও গ্যাসের মতো জীবাশ্ম জ্বালানি, কারণ এগুলি সকল কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমনের ৯০ শতাংশেরও বেশি।
বন উজাড় অর্থাৎ “মানুষের বন পরিষ্কার বা পাতলা করা“ও একটি কারণ। বিশ্বব্যাপী শিল্পায়নের হারেব্যাপক বৃদ্ধির কারণে বক্সাইট, কাঠ, কাঠকয়লা, রাবার ও আরো অনেক প্রাকৃতিক সম্পদের চাহিদা বৃদ্ধির ফলে নির্মাতারা বেপরোয়াভাবে সকল জমি ও বন পরিষ্কার করে যাচ্ছে।
জাতিসংঘের মতে নাইজেরিয়ায় বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বন উজাড়ের হার, যেখানে প্রতি বছর আনুমানিক ৩.৭ শতাংশ বন ধ্বংস হয়। শুধু ২০২০ সালে কোভিড-১৯ মহামারী ও বৈশ্বিক লকডাউনের সময় প্রায় ৫৯.৫ মেট্রিক টন কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমনের সমান মোট ৯৭.৮ কিলোহেক্টর প্রাকৃতিক বন উজাড় হয়েছে। নাইজেরীয় সংরক্ষণ ফাউন্ডেশনের (এনসিএফ) মতে বন উজাড়ের ফলে দেশের মূল রেইনফরেস্টের ৯৬ শতাংশ ধ্বংস হয়ে গেছে।

একজন কাঠুরে কেটে ফেলা গাছ কাটছে। ছবি: হালিমাতিশিয়াক, উইকিমিডিয়া সাধারণ (সৃজনি সাধারণ একইরকম ভাগাভাগি ৪.০ চুক্তি)।
আফ্রিকার বৃহত্তম তেল উৎপাদনকারী ও বিশ্বের ১৪তম বৃহত্তম দেশ নাইজেরিয়ার শিল্পের বাতাসে নির্গমন ও জীবাশ্ম জ্বালানি দহনের সমস্যাও উদ্বেগের বিষয়। শুধু ২০১৮ সালে নাইজেরিয়ায় আনুমানিক ৭৪০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের নির্গমন ঘটে যা বিশ্বে সপ্তম বৃহত্তম। নাইজেরিয়ার কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন ২০২২ সালে ১২২,৭৫০,৪১০ টন ধরা হয় যা আগের বছরের তুলনায় ০.৩৫ শতাংশ হ্রাস হলেও বিশেষ করে এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশের তুলনায় এই পরিসংখ্যান এখনো আকাশচুম্বী। নাইজেরিয়ার গ্যাস ও পেট্রোলের উপর অত্যধিক নির্ভরতা এই তীব্র পার্থক্যের কারণ।
অনেক দেশ কম নির্গমনের সবুজ শক্তির উৎসে রূপান্তরিত হওয়ার ক্ষেত্রে এগিয়ে গেলেও নাইজেরিয়া তা খুব কমই পেরেছে, এর বেশিরভাগ মেশিন ও ইঞ্জিন এখনো নোংরা শক্তির উৎসের উপর নির্ভরশীল। নাইজেরিয়ায় ২০২২ সালে প্রায় ৪০ শতাংশ পরিবার শক্তির চাহিদা মেটাতে গ্যাস জেনারেটর ব্যবহার করায় জ্বালানিতে ব্যয় হয় মোট ১.৪ হাজার কোটি ডলার (প্রায় ১.৭ লক্ষ কোটি টাঁকা)। গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন ওজোন হ্রাস ও বৈশ্বিক উষ্ণায়নের দিকে পরিচালিত করা ছাড়াও বায়ুর গুণমানকে খারাপ করে যা প্রভাবিত সম্প্রদায়ের উপর নেতিবাচক স্বাস্থ্যের প্রভাব ফেলতে পারে।
জলবায়ু জ্ঞান পোর্টাল মনে করে বর্তমান বৈশ্বিক নির্গমন হারে শতাব্দীর শেষ নাগাদ তাপমাত্রা ২.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়ে ৫.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছে যাবে। এই পরিস্থিতিতে এপ্রিল মাসে নাইজেরিয়ায় এধরনের তাপপ্রবাহ ক্রমশ স্থায়ী ও আরো বিপজ্জনক হয়ে উঠবে।
অতিরিক্ত তাপ কেবল অস্বস্তির বাইরেও মানুষের শরীরের উপর নেতিবাচক স্বাস্থ্যগত প্রভাব ফেলতে পারে। উচ্চ তাপমাত্রার জায়গায় থাকা লোকেরা পানিশূন্যতা ও তাপ ক্লান্তি মিলে হিট স্ট্রোকের দিকে পরিচালিত করতে পারে, যা শিশু ও বয়স্কদের পাশাপাশি স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগা ব্যক্তিদের জন্যে মারাত্মক হতে পারে। চিকিৎসা দলগুলি জানিয়েছে নাইজেরিয়ার তাপপ্রবাহের সময় তাপ-সম্পর্কিত অসুস্থতায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা মারাত্মক বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে এক নারীর এমনকি গর্ভপাতও ঘটে। এর বিরুদ্ধে লড়াই করতে তারা জল গ্রহণ ও সূর্য থেকে সুরক্ষা চর্চার পক্ষে পরামর্শ দিতে শুরু করেছে। গরমের মাসগুলিতে নাইজেরিয়ায় শ্বাসকষ্ট ও হৃদরোগের পাশাপাশি দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্য সমস্যা তীব্রতর হয়ে ওঠায় স্বাস্থ্যসেবা পরিষেবাগুলি বর্ধিত চাপের শিকার হয়।
বিশেষজ্ঞদের তৈরি বেশ কয়েকটি সুরক্ষা নির্দেশিকা তাপপ্রবাহের প্রভাব কমানোর বিভিন্ন পদ্ধতি প্রস্তাব করেছে। পর্যাপ্ত জল গ্রহণ, দিনের বেলায় ঘরের ভেতরে থাকা, হালকা ও শ্বাস-প্রশ্বাসের উপযোগী পোশাক পরা, এবং পাখা ও ঠান্ডা জল ছেটানো শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে পারে। অসুস্থ ব্যক্তি বা গৃহহীন জনগোষ্ঠীর মতো ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠীরা প্রায়শই বেশি ঝুঁকিতে থাকে।
আশঙ্কা প্রকাশ করে পরিবেশ কর্মী ও বিজ্ঞানীরা অবিলম্বে নাইজেরিয়ায় টেকসই পরিবেশগত নীতিমালা প্রণয়নের আহ্বান জানিয়েছে। বছরের শুরুতে পরিলক্ষিত উচ্চ তাপমাত্রা ২০০৪ সালে ইয়োলায় রেকর্ড উচ্চ ৪৬.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের প্রায় কাছাকাছি। সরকার, পরিবেশ সংস্থা ও নাগরিকসহ সকল ক্ষেত্রের তাৎক্ষণিক, সিদ্ধান্তমূলক পদক্ষেপের অভাব চরম তাপপ্রবাহ অব্যাহত রেখে হয়তো আরো অনেককে বিপন্ন করবে।