‘পেরোনবাদী’ যেই পোপ ফ্রান্সিসকে আর্জেন্টিনীয়রা ভালোবাসতে ঘৃণা করতো

আর্জেন্টিনীয় সাংবাদিক লিওনার্দো অলিভার ২৫ এপ্রিল, ২০২৫ কানেক্টাসে প্রকাশিত গল্পের এই সংস্করণটি একটি গণমাধ্যম চুক্তির অধীনে গ্লোবাল ভয়েসেসে পুনঃপ্রকাশিত হয়েছে।

আর্জেন্টিনীয় পোপ নির্বাচিত হওয়ার পর ১৪ মার্চ, ২০১৩ পেজিনা ১২ পত্রিকার প্রচ্ছদের শিরোনাম হয় “মাই গড!” প্রবন্ধটিতে বলা হয় বুয়েনস আইরেসের বিশপ হিসেবে জর্জ মারিও বার্গোগলিও “সামরিক একনায়কতন্ত্রের সাথে জড়িতের কথিত অভিযুক্ত কিরচনারপন্থী সরকারের সাথে বিরোধপূর্ণ সম্পর্ক; এবং সমকামী বিবাহের পাশাপাশি যৌন শিক্ষা ও প্রজনন স্বাস্থ্য নীতির তীব্র বিরোধী।” একই সংবাদপত্র ১২ বছর পর, ২২শে এপ্রিল, ২০২৫ তার প্রচ্ছদে “ঈশ্বরেরকরুণা” লিখে বার্গোগলিও  নয় বরং পোপ ফ্রান্সিসের মৃত্যুর ঘোষণা দেয়।

তবে কিরচনারপন্থী সংবাদমাধ্যম পেজিনা ১২-ই একমাত্র পিছু হটে নি । অনেক আর্জেন্টিনীয়ও সেই পথে হেঁটেছে —যেমন, (প্লাসা দে মায়োর দাদি) আবুয়েলাস ডি প্লাজা ডি মায়োর সভাপতি এস্তেলা দে কার্লোত্তো (যিনি সাম্প্রতিক পেরোনবাদী সরকারে ঘনিষ্ঠ), এবং এমনকি একসময় বেরগোলিওকে ‘ডানপন্থী’ বিশপ ও প্রকৃত ‘বিরোধীদলীয় প্রতিনিধি’ ভাবলেও পরে তাকে ‘প্রগতিশীল’ পোপ মেনে নিয়ে ভ্যাটিকানে তার সাথে ছবি তুলতে আগ্রহী ক্রিস্তিনা ফার্নান্দেস দে কিরচনারও।

আর্জেন্টিনায় পেরোনবাদ পোপের চেয়ে বেশি ক্যাথলিক হয়ে উঠলে অন্যরাও তাই করে। তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সময়  হাভিয়ের মিলে তাকে “পৃথিবীতে মন্দের প্রতিনিধি” হিসেবে উল্লেখ করলেও তার মৃত্যুর পরপরই, রাষ্ট্রপতি তার “দয়া ও প্রজ্ঞা“র প্রশংসা করে এবং তার সরকার (১২ বছর আগে) এই যিশুভক্ত রোমান পোন্টিফ নিযুক্ত হওয়ার সময় তার প্রতি আকৃষ্ট অনেকের উচ্চারিত বাক্যের প্রতিধ্বনি তুলে তাকে ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর্জেন্টিনীয়” দাবি করে।

এই বিরোধগুলো দেশের অস্তিত্বে মিশে আছে। বছরের পর বছর ধরে, দেশটি একদিকে একজন স্বদেশি পোপের গৌরব নিয়ে গর্ব করেছে, আর অন্যদিকে মুদ্রাস্ফীতির মতো একটি মৌলিক সমস্যা সমাধান করতে না পারার হতাশায় ভুগেছে। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের পুজনীয় মারাদোনা ও মেসির মতো প্রতিভাধরদের দেশটি কিছুটা অহংকারও রপ্তানি করে, যা সীমানার বাইরে আর্জেন্টিনীয়দের আলাদা করে চিনিয়ে দেয়। মিলে শাসিত এই দেশটি একজন দুর্বোধ্য রাজনীতিক বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক আন্দোলন ও এখন পর্যন্ত সবচেয়ে জনপ্রিয় পেরোনবাদের জনক হুয়ান ডোমিঙ্গো পেরোনেরও দেশ। ফ্রান্সিস সেই পোপ যাকে আর্জেন্টিনীয়রা ভালোবাসতে ঘৃণা করলেও তিনি সমানভাবে জনপ্রিয়।

একজন পেরোনবাদী পোপ?

Francisco es incomprensible sin Bergoglio; Bergoglio sin el peronismo; y el peronismo sin el nacionalcatolicismo que con varios matices impregnó a la Iglesia y a la cultura argentina.

বার্গোগলিও ছাড়া ফ্রান্সিস; পেরোনবাদ ছাড়া বার্গোগলিও এবং গির্জা ও আর্জেন্টিনার সংস্কৃতিকে বিভিন্ন সূক্ষ্মতায় সজ্জিত করা জাতীয় ক্যাথলিকবাদ ছাড়া পেরোনবাদ বোধগম্য নয়।

ইতিহাসবিদ লরিস জানাত্তার লেখা এই বাক্যটি আর্জেন্টিনার মৃত পোপের তীব্র সমালোচনা হিসেবে চিহ্নিত হলেও পোপ সবসময় তার স্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়িয়েছেন: “আমি কখনো পেরোনিস্তা দলের সদস্য, জঙ্গি বা পেরোনবাদের কর্মীও ছিলাম না,” সাংবাদিক সার্জিও রুবিন ও ফ্রান্সেসকা অ্যামব্রোগেত্তির সাথে একটি দীর্ঘ কথোপকথন “এল পাস্তোর” বইতে ফ্রান্সিস দাবি করেছেন।

তবুও যখনই পোপ সামাজিক ন্যায়বিচারের মতো ধারণার উপর মনোযোগ দিতেন, যখনই দরিদ্র ও বঞ্চিতদের পক্ষে কথা বলতেন, অথবা “জনগণের” কাছে আবেদন করতেন, তখনই তার বিরুদ্ধে পেরোনবাদী বর্ণনার মিলের অভিযোগ আসতো।

“ফ্রান্সিসকো, এল আর্জেন্টিনো কুয়ে পুয়েডে ক্যাম্বিয়ার এল মুন্ডো” (যে আর্জেন্টিনীয় ফ্রান্সিস বিশ্ব বদলাবে) বইয়ের লেখক আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক লুইস রোজালেস তাকে একজন পেরোনবাদী হিসেবে চিহ্নিত করা এড়িয়ে গেলেও এর প্রভাব স্বীকার করেন। কানেক্টাসেরএর সাথে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন “নিঃসন্দেহে, পেরোনবাদ আর্জেন্টিনায় খুবই প্রভাবশালী। খুব জটিল সময়ে স্থানীয় গির্জার গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকায় কখনো কখনো বার্গোগলিও পেরোনবাদের কাছাকাছি চলে যেতেন।”

পেরোনও চার্চের মতবাদ থেকে খুব বেশি দূরে ছিলেন না। রোজালেস সমাজতান্ত্রিক বা পুঁজিবাদী নয় তৃতীয় গির্জার ক্রমকে প্রচারকারী ত্রয়োদশ লিও’র ১৮৭১ সালের “রেরাম নোভারাম” এনসাইক্লিকাল উদ্ধৃত করেছেন। বিশ্লেষণের দাবি কয়েক দশক পরে পোপের লেখা পেরোনবাদের প্রতিষ্ঠাতাকে অনুপ্রাণিত করবে।

“এল পাপা পেরোনিস্তা” (“পেরোনবাদী পোপ”) বইয়ের লেখক ইগনাসিও জুলেতা ব্যাখ্যা করেছেন ৫০ ও ৬০ এর দশকে জাতীয় ক্যাথলিক ধর্মে পেরোনবাদী সংস্করণ চলু থাকার সময় ফ্রান্সিস সেমিনারিতে গিয়েছিলেন: “বার্গোগলিওকে সেই বিশ্বে স্থানীয় স্বাধীনতার ধর্মের স্তরে প্রশিক্ষণ দেওয়া হলে সেই মতবাদটিই তিনি ভ্যাটিকানে নিয়ে যান।”

তবে জানাত্তা এটিকে আরো এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যান। তার বইতে তিনি জনপ্রিয়তাবাদ ছাড়াও, ফ্রান্সিসের পেরোন মতবাদে উপস্থিত দুটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন: পশ্চিমা-বিরোধী মনোভাব  ও উদারনীতি-বিরোধিতা। “ফ্রান্সিস বৈশ্বিক দক্ষিণে তার সকল ভ্রমণে ‘দরিদ্রদের’ পশ্চিমা অগ্রগতির প্রলোভনের কাছে নতি স্বীকার না করতে সতর্ক কতেছেন,” ইতালীয় লেখক লিখেছেন।

লাতিন আমেরিকার প্রথম পোপের উত্তরাধিকার

আর্জেন্টিনা তার সবচেয়ে সার্বজনীন সন্তানের মৃত্যুতে অভ্যস্ত হয়ে উঠলেও বিশ্ব এখনো ফ্রান্সিসের আসল উত্তরাধিকার নিয়ে বিতর্ক করছে। তিনি ১,৩০০ বছরেরও বেশি সময়ের মধ্যে প্রথম অ-ইউরোপীয় পোপ। (হলি সি-তে পৌঁছে তার নিজের দাবি) “বিশ্বের শেষ প্রান্ত” থেকে এসে  তিনি কখনো কার্ডিনালদের কলেজের প্রতিনিধিত্ব না করা ভৌগোলিক অঞ্চলের দরজা খুলে দেওয়ার যাত্রা শুরু করে তার উত্তরসূরি নির্বাচনের দায়িত্বে ছিলেন।

বলিভিয়া সফরে ২০১৫ সালে পোপ ফ্রান্সিস। ছবি ফ্যাবিওলা চাম্বির, অনুমতিসহ ব্যবহৃত।

পোপ হিসেবে তার ১২ বছরের সময়কালে ৪৭ বার ভ্রমণে তিনি ৬৬টি দেশ পরিদর্শন করেন। (তার সহকর্মীদের সাথে ব্যাতিক্রমভাবে আর্জেন্টিনা ছাড়া) আমেরিকায় তার সাতটি ভ্রমণে তিনি ১০টি দেশে যান। এই অর্থজ তার পোপত্ব একটি বিপ্লবী ধারণার জন্ম দেয়: “আগের মতো রোমভক্ত পৃথিবী নয়, বরং বিশ্বমুখী রোম। তিনি বিশ্বের পাঁচটি মহাদেশে ৪৭টি ভ্রমণে সেন্ট পিটারের আসন গ্রহণ করঞ্ছেন,” কানেক্টাসে ভ্যাটিকান বিশেষজ্ঞ নেস্টর পঙ্গুতা বলেছেন।

ভ্যাটিকানের ঘনিষ্ঠ আরেক ব্যক্তি স্পেনীয় সাংবাদিক হোসে ম্যানুয়েল ভিদাল (রিলিজিওন ডিজিটাল সংস্থা পরিচালক), বার্গোগলিওর আর্জেন্টিনা ও লাতিন আমেরিকীয় প্রকৃতি পোপের শৈলীতে মূল্যবোধ তৈরি করেছিল বলে মনে করেন। তিনি ব্যাখ্যা করেন, “সাম্প্রদায়িকতা, সম্প্রদায়, সহানুভূতি, ঘনিষ্ঠতা, এই সমস্ত গুণাবলী লাতিন আমেরিকার গির্জাগুলিতে পূর্ণরূপে অনুভূত হলেও পশ্চিমা গির্জায় অতোটা নয়।

জর্জ বার্গোগলিও ২০১৩ সালের মার্চ মাসে বেনেডিক্ট ষোড়শের উত্তরসূরি নির্বাচনের জন্যে কনক্লেভে যোগ দেওয়ার সময় তিনি কয়েক সপ্তাহের মধ্যে বুয়েনস আইরেসে ফিরে আসার আশা করে সাথে একটি ছোট ব্যাগ ছাড়া কিছুই নিয়ে যাননি। তিনি জানতেও পারেননি তিনি আর কখনো ফিরে আসবেন না। তিনি হয়ে উঠবেন ফ্রান্সিস – ইতিহাস তৈরি করা “পেরোনবাদী” পোপ। এখন তাকে ভালোবাসতে ঘৃণা করা আর্জেন্টিনীয়রা তারা শোকে মুহ্যমান।

পেরোনবাদ ১৯৪০-এর দশকে রাষ্ট্রপতি ও সামরিক ব্যক্তি হুয়ান ডোমিঙ্গো পেরোন প্রতিষ্ঠিত সামাজিক ন্যায়বিচার, অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ ও যাদুকরী নেতৃত্ব সমন্বিত আর্জেন্টিনার একটি রাজনৈতিক আন্দোলন। তখন থেকেই এটি দেশের রাজনীতিতে অন্যতম প্রভাবশালী শক্তি যা প্রচলিত বাম বা ডান কোনোটির সাথে একেবারে মিলে যায় না বলে অনেকে মনে করে।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .