
কঙ্গো নদীর তীরে বসবাসকারী ইসাঙ্গি জনগোষ্ঠী। ছবি: জুলিয়েন হারনেইস, উইকিমিডিয়া সাধারণ (সৃজনি সাধারণ একইরকম ভাগাভাগি ৪.০ অনুমতি)
লেখক: গ্রেস কোবার
আমাজন অববাহিকার পর কঙ্গো অববাহিকা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম রেইনফরেস্ট (ঘনবর্ষণ বনাঞ্চল)। উচ্চ মাত্রার জীববৈচিত্র্যের জন্যে পরিচিত এই অঞ্চলটিতে নদী, বন, তৃণভূমি ও জলাভূমি থাকলেও ক্রমবর্ধমান কাঠ কাটা, অবকাঠামো প্রকল্প এবং কোল্টান, হীরা ও সোনার মতো খনিজ আহরণে এর পরিবেশ ও বন্যপ্রাণীর উপর প্রভাব পড়ছে।
কঙ্গো অববাহিকা
কঙ্গো অববাহিকা ৫০,০০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মানুষের দখলে এবং ব্যবহৃত। এটি ৭.৫ কোটি মানুষের খাদ্য, পানি ও আশ্রয় জোগায়। কাঠ, তেল ও খনিজ পদার্থে সমৃদ্ধ এটি বৈশ্বিক গ্রিনহাউস গ্যাস, কার্বন ডাই অক্সাইড নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিশাল কার্বন শোষক হিসেবে কাজ করে। আঞ্চলিক ও স্থানীয় আবহাওয়ার ধরন নিয়ন্ত্রণকারী অববাহিকার বন আফ্রিকার একটি বড় অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ জলের উৎস সঞ্চালনে সহায়তা করে।
অববাহিকার সবচেয়ে বিখ্যাত বাসিন্দাদের মধ্যে রয়েছে বন্য হাতি, গরিলা, শিম্পাঞ্জি, ওকাপি, চিতাবাঘ, জলহস্তী, মহিষ ও সিংহ। কঙ্গো অববাহিকায় নয়টি দেশের (অ্যাঙ্গোলা, ক্যামেরুন, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র, গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র কঙ্গো, কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, বুরুন্ডি, রুয়ান্ডা, তানজানিয়া ও জাম্বিয়া) অংশ থাকলেও সাধারণত এই অঞ্চলে বিস্তৃত বনভূমিসহ ছয়টি দেশ: ক্যামেরুন, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র, কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র কঙ্গো (ডিআরসি), নিরক্ষীয় গিনি ও গ্যাবন কঙ্গো রেইনফরেস্টের সাথে যুক্ত।বৈশ্বিক তহবিলের (ডাব্লিউডাব্লিউএফ) প্রতিবেদন অনুসারে কঙ্গো অববাহিকায় ১০ হাজারেরও বেশি উদ্ভিদ প্রজাতি রয়েছে, যার ৩০% এই অঞ্চলে স্বকীয়। এই বনাঞ্চলটি ৪০০ টিরও বেশি স্তন্যপায়ী প্রাণী ও ১,০০০ টিরও বেশি পাখির প্রজাতিসহ বিপন্ন প্রাণীর আশ্রয়স্থল। বনভূমিতে বাসস্থানের চরিত্র গঠনে কিছু প্রজাতির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, মধ্য আফ্রিকার বনাঞ্চলে সাধারণত লম্বা গাছ থাকলেও আমাজন বা বোর্নিওর বনের তুলনায় ছোট গাছের ঘনত্ব কম।
কঙ্গো অববাহিকায় প্রধান চ্যালেঞ্জ
অনেক জনগণ, বিশেষ করে আদিবাসী সম্প্রদায়, খাদ্য, জল ও কৃষিকাজের উপকরণের জন্যে কঙ্গো অববাহিকার উপর নির্ভরশীল। ডিআরসি, ক্যামেরুন ও গ্যাবনের কিছু অংশের অর্থনৈতিক কষ্ট পরিস্থিতিকে আরো খারাপ করেছে। অর্থনৈতিক চাপ ও শহরাঞ্চলে চাকরির অভাবে শহর থেকে অনেক বেকার মানুষ খাদ্যের সন্ধানে ও জীবিকা নির্বাহের জন্যে বনে ফিরে আসায় বন্যপ্রাণী ও প্রাকৃতিক সম্পদের উপর আরো চাপ সৃষ্টি হচ্ছে।
গ্রিনপিসের মতে আফ্রিকার সমৃদ্ধ প্রাকৃতিক সম্পদের সুবিধা নিতে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে বিভিন্ন দেশের বিনিয়োগকারীরা ছুটে আসছে। দুর্ভাগ্যবশত, প্রায়শই স্থানীয় সম্প্রদায় ও পরিবেশের ক্ষতি করেই এই কাজ করা হয়। অনেক কোম্পানি আফ্রিকায় সম্পদ আহরণ ও রপ্তানির জন্যে বিশাল জমি কিনছে বা লিজ নিচ্ছে। খুব দ্রুত ও অস্বচ্ছ চুক্তির কিছু বৃহৎ পরিসরে ব্যাপক জমির দখলকে “ভূমি দখল” বলা হচ্ছে। এই চুক্তিগুলি মানুষের খাদ্য প্রাপ্তি হ্রাস, দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধীরগতির এবং মূল্যবান প্রাকৃতিক অঞ্চল ধ্বংস করতে পারে বলে জাতিসংঘ সতর্ক করেছে।
আরো পড়ুন: চীন সবুজ শক্তির রূপান্তরকে শক্তিশালী করতে ডিআরসি থেকে কোবাল্ট ব্যবহার করছে। কিন্তু এর মূল্য কী?
প্রায়শই ব্যাপক বন উজাড় ও স্থানীয় সম্প্রদায়ের সাথে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলি কঙ্গো অববাহিকায় পাম তেল ও রাবারের মতো ফসল চাষের বড় খামার স্থাপন করছে। কঙ্গো অববাহিকায় বেপরোয়া ও অবৈধ কাঠ কাটা পরিবেশ ও স্থানীয় সম্প্রদায়ের মারাত্মক ক্ষতির কারণ। বড়-ছোট উভয় কোম্পানির উদ্বেগজনক হারে গাছ কাটায় বন উজাড় হচ্ছে ওবন্যপ্রাণীর আবাসস্থল হ্রাস পাওয়ার সাথে সাথে অঞ্চলটি জলবায়ু পরিবর্তনের জন্যে আরো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। আসবাবপত্র ও মেঝের মতো পণ্যে ব্যবহারের জন্যে রপ্তানি করতে অবৈধভাবে বছরের পর বছর মূল্যবান গাছ কাটা হচ্ছে। এখনো কঙ্গো অববাহিকায় অবৈধ কাঠ কেটে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলি ও ক্রমবর্ধমানভাবে চীনসহ সারাবিশ্বে পাঠানো হচ্ছে। অবৈধ কাঠ আমদানি বন্ধ করতে যুক্তরাষ্ট্রে লেসি আইন ও ইইউতে টিম্বার রেগুলেশন রয়েছে। কার্যকর হতে শুরু করা এসব আইন ব্যবসাগুলিকে তাদের কাঠের উৎস পরীক্ষায় দায়ী করা হলেও অবৈধ কাঠ চীনে পাঠানো এবং প্রক্রিয়াজাত করে বিশ্বব্যাপী বিক্রি করা সম্ভব হওয়া যতক্ষণ পর্যন্ত কোম্পানিগুলি সর্বদা কঙ্গো অববাহিকায় অবৈধভাবে গাছ কাটা চালানোর প্রণোদনা পাবে।
বিশ্বের অবশিষ্ট কার্বন শোষক অঞ্চলের অন্যতম ও জীববৈচিত্র্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ আবাসস্থল কঙ্গো অববাহিকা। এটি রক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও তা বিশ্বের কিছু দরিদ্রতম সম্প্রদায়ের চাহিদার সাথে ভারসাম্যপূর্ণ হতে হবে।
ডিআরসি’র অনেকের কাছে কাঠ ও কোল্টান আহরণের মতো শিল্প একটি বিরল অর্থনৈতিক সুযোগ। চ্যালেঞ্জ হলো পরিবেশ সংরক্ষণের পাশাপাশি জনগণকে দারিদ্র্য থেকে মুক্ত করার উপায় খুঁজে বের করা। সঠিক নীতিমালার মাধ্যমে এই ভারসাম্য সম্ভব। কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের (ডিআরসি) ইঙ্গা জলপ্রপাতে সাতটি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্যে পরিকল্পিত বৃহৎ ইঙ্গা বাঁধের মতো প্রকল্প বিশ্বের বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ বাঁধ চীনের থ্রি গর্জেস বাঁধের দ্বিগুণেরও বেশি প্রায় ৪০ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে বলে আশা করা হচ্ছে। সমর্থকদের দাবি প্রকল্পটি আফ্রিকায় আরো নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ সরবরাহ, কর্মসংস্থান তৈরি ও পারিবারিক আয় বৃদ্ধি করতে সাহায্য করবে। প্রকল্পটি ভালভাবে পরিচালিত হলে এটি ডিআরসিকে নবায়নযোগ্য শক্তিতে শীর্ষস্থানীয় করে তুলতে পারে। বর্তমানে শিশুশ্রমের মতো মানবাধিকার লঙ্ঘনে পরিপূর্ণ হলেও টেকসই, নীতিগত কোল্টান খনিজ আহরণের মাধ্যমে অববাহিকা ধ্বংস না করে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করা যেতে পারে।
আরো বিস্তৃতভাবে বলতে গেলে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক স্যার পার্থ দাশগুপ্ত যেমন করে জোর দিয়ে ২০২১ সালের দাশগুপ্ত পর্যালোচনায় তুলে ধরে ছিলেন তেমন করে নীতিনির্ধারকরা অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে জীববৈচিত্র্যকে অন্তর্ভুক্ত করে প্রকৃতির সঠিক যত্ন না নিলে গুরুতর অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত পরিণতি হতে পারে। তবে অববাহিকার সঠিক যত্ন নিলে দীর্ঘমেয়াদে ও অর্থনীতি উভয়ই সমৃদ্ধ হবে।
ভবিষ্যতের জন্যে আশাবাদ
আন্তর্জাতিক বন গবেষণা কেন্দ্রের (সিআইএফওআর) একটি প্রতিবেদন অনুসারে, বন উজাড় ও অবক্ষয় নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে ২০২০ সালে বিদ্যমান কঙ্গো অববাহিকায় অক্ষত রেইনফরেস্টের অন্তত ২৭ শতাংশ ২০৫০ সালের মধ্যে হারিয়ে যাবে।
গবেষকরা জোর দিয়ে বলেছে সংরক্ষিত এলাকা তৈরি, বন ছাড় এবং সম্প্রদায় বন তৈরির মতো উন্নত ভূমি ব্যবহার নীতি বন উজাড় ও অবক্ষয় কমাতে সাহায্য করতে পারে। আন্তর্জাতিক উন্নয়নের ফরাসি কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের (সিআইআরএডি) পিয়েরে প্লোটনের মতে, এই পদ্ধতিগুলি বন রক্ষা ছাড়াও স্থানীয় সম্প্রদায়গুলিকে সংরক্ষণে জড়িত করে তাদের দৈনন্দিন চাহিদা পূরণে সহায়তা করে।
বিশেষজ্ঞরা আরো উল্লেখ করেছে অনন্য সমৃদ্ধ প্রাকৃতিক ঐতিহ্য ও অনেক প্রজাতির কারণে মধ্য আফ্রিকা বিশ্বব্যাপী জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। সিআইএফওআর-আইসিআরএএফ-এর মধ্য আফ্রিকার আঞ্চলিক আহ্বায়ক রিচার্ড আতি বলেছেন আজও লক্ষ লক্ষ মানুষকে সমর্থন করা এই অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্র এই যৌথ সম্পদটিকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যে সুরক্ষিত রাখতে হবে। তিনি জোর দিয়ে বলেন এই জীববৈচিত্র্য রক্ষার দায়িত্ব মধ্য আফ্রিকার দেশগুলি ছাড়াও বিশ্ব সম্প্রদায়েরও।