
বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় সুপেয় পানির সংগ্রহণ। স্থানঃ দেবহাটা, সাতক্ষীরা, বাংলাদেশ। ছবিটি উইকিমিডিয়ার মাধ্যমে সংগ্রহ করেছেন বলরাম মহলদার। CC BY-SA 3.0.
কক্সবাজার, বাংলাদেশের দক্ষিন-পশ্চিমাংশের একটি উপকূলীয় অঞ্চল, বাংলাদেশের স্থানীয় নাগরিক ও পৃথিবীর সবথেকে বড় শরণার্থী শিবিরের বাসস্থান, প্রাথমিকভাবে এটি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দ্বারা পরিপূর্ণ, প্রতিনিয়ত তারা সুপেয় পানির স্বল্পতার সম্মুখীন হচ্ছে। স্বাগতিক জনগোষ্ঠিদের যখন ভূগর্ভস্থ জল নিয়ে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে, তখন উঠতি রোহিঙ্গা জনসংখ্যা উপরন্তু সংকটকে আরও তীব্রতর করে তুলেছে এবং অঞ্চলটির প্রাকৃতিক সম্পদের উপর চাপ পড়ছে।
সুপেয় পানির স্বল্পতা এতটাই গুরুতর যে পানির পাওয়ার জন্য এলাকাবাসীকে একটি দোকানে যেতে হবে যেখানে মাটির গভীরতা থেকে পানি উত্তোলন করে, পরিশুদ্ধ করে এবং তারপরে বিক্রি করা হয়।
সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলায়, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে, সেখানকার এলাকাবাসী প্রতি যাত্রায় ৬০ লিটার পানি ক্রয় করে, যার খরচ দাঁড়ায় ৩০ টাকা (০.২৫ ডলার) পানির জন্য এবং অতিরিক্ত ২০ টাকা (০.১৬ ডলার) পা-চালিত পরিবহনের ভাড়া।
সুপেয় পানি বাবদ মাসিক খরচ দাড়ায় ৪০০ টাকা (৩.২৭ ডলার) – যেটা কিনা একজন ভূমিহীণ কৃষকের গড় আয়ের চেয়ে ১০ শতাংশ বেশি – বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে সুপেয় পানির খরচ শহরগুলোর তুলনায় ৪০ গুণ বেশি, এটি ঝুকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর উপর একটি গুরুতর এবং অসামঞ্জস্যপূর্ণ বোঝাকে তুলে ধরে।
কক্সবাজারের পার্শ্ববর্তী উখীয়া ও টেকনাফে টিউবওয়েল দ্বারা সুপেয় পানি উত্তোলন করা এখন খুবই কষ্টসাধ্য হয়ে উঠেছে, যেহেতু প্রতিনিয়ত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সমাগম বেড়েই চলেছে সেহেতু ভূগর্ভে পানির স্তর খুব দ্রুতই নিচে নেমে গিয়েছে।
১৯৯১ সাল থেকেই কক্সবাজারে রোহিঙ্গা জনসংখ্যা ওঠানামা করছে। তা সত্ত্বেও, ২০১৭ সালের আগস্টের শুরু থেকে, রোহিঙ্গাদের বাসস্থান রাখাইন, মায়ানমার থেকে যখন তাদের উপর অত্যাচার নিপিড়ন বৃদ্ধি পেল তখন থেকে তারা বাংলাদেশে প্রচুর পরিমাণে শরণার্থী বেশে আশ্রয় নিতে শুরু করলো। এই প্রচুর জনসমাগম স্বাগতিক জনগোষ্ঠীকে অপার চাপের সম্মুখীন করলো, যা সুপেয় পানির ঘাটতির কারনে একই ধরণের অর্থনৈতিক বোঝার মুখোমুখি হতে পারে।
৩১শে জুলাই ২০২৩ সালের মধ্যে, জাতিসংঘের শরণার্থী কমিশনার ও বাংলাদেশ সরকার এখন পর্যন্ত মোট ৯৬২,৪১৬ জন শরণার্থীকে লিপিবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছে, লক্ষণীয় যে স্থানচ্যুত মানুষের মাত্রা এবং চলমান মানবিক প্রতিবন্ধকতা। নিঃসন্দেহে সেখানে কয়েক হাজার শরণার্থী এখনো অলিপিবদ্ধ রয়েছে এবং তারা এই পরিসংখ্যানের থেকে অনুপস্থিত।
বর্তমানে শরণার্থী ক্যাম্পে দৈনিক সুপেয় পানির চাহিদা দাঁড়িয়েছে ২২ লক্ষ লিটারে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পার্শ্ববর্তী এলাকার স্বাগতিক জনগোষ্ঠীরা গুরুতর ভাবে সুপেয় পানির অভাবে ভুগছে, যেহেতু হাজার হাজার টিউবওয়েলের পানি শুকিয়ে গেছে, টেকনাফের গ্রামবাসীদেরকে জোর পূর্বক হয়ে ভূগর্ভের ৫০০ ফিট পর্যন্ত গভীরে পানির জন্যে খনন করা হচ্ছে।
স্বাগতিক জনগোষ্ঠীগুলোর সাক্ষাৎকারে জানা যায় যে গভীর টিউবওয়েল স্থাপনের খরচ দাড়িয়েছে ১,৫০,০০০ টাকায় (১,২৩০ ডলার), একটি অগভীর কূপের স্থাপনা খরচ যেখানে ১৫,০০০ টাকা (১২৩ ডলার), অতিরিক্ত পরিমাণে ভূগর্ভের পানি উত্তোলন প্রাকৃতিকভাবে কূপের পানি পূরণের হারের থেকে বেশি।
তাদের প্রতিকূলতায় লক্ষণীয় যে টেকনাফে সুপেয় পানির স্বল্পতা রয়েছে, যেখানে মাটির ২৫-৩০ মিটার নিচেই শিলামূল পাওয়া যায়, আর গভীর টিউবওয়েল স্থাপন করা এলাকাবাসীর জন্য একটি ব্যয়বহুল পন্থা হিসেবে রূপ নিয়েছে।
সেখানকার বসবাসরত পরিবারগুলোর উপর অর্থনৈতিক চাপ এবং জীবন জীবিকার ব্যয় বেড়েই চলেছে, দূরদূরান্ত পানির উৎস থেকে পানি সংগ্রহ করা ও ক্রমবর্ধমান বোতলজাত পানির উপর নির্ভরতার কারণে।
সম্প্রতি মাটির ৮০০ মিটার গভীরতা থেকে পানি উত্তোলনের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে, টেকনাফের স্বাগতিক জনগোষ্ঠীদেরকে পার্শ্ববর্তী গ্রামের পাইপলাইনের পানির দিকে জোরপূর্বক নির্ভর হওয়া লাগছে, সংকটময় পরিস্থিতিকে আরও বেশি প্রভাবিত করছে।
কক্সবাজার কেন নিরাপদ পানি হারাচ্ছে?
কক্সবাজারের বাসিন্দারা প্রতিকূলতায় ভূগছে যেহেতু প্রতি বছর ভূগর্ভের পানির স্তর ১০-১৫ ফিট নিচে নেমে যাচ্ছে। এমনকি ১০ বছর আগেও, মাটির ১২০-১৫০ ফিটের মধ্যে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর পাওয়া যেত; বর্তমানে, খননকারীদের অবশ্যই ৩০০ থেকে ৫০০ ফিট দূরত্ব অতিক্রম করতে হবে।
২০২৩ সালের একটি প্রতিবেদনে বলা হয় যে, কক্সবাজারের ৩১,০০০ টিউবওয়েলের ২৩ শতাংশ – আনুমানিক ৭,০০০ – অকেজো হয়ে গিয়েছে।
সুপেয় পানির পরিবর্তে লবণাক্ত ও কর্দমুক্ত পানি উঠে আসায় জেলাটির প্রায় সকল অব্যবহারযোগ্য হয়ে পড়েছে। জনগণ বাধ্য হয়ে পুকুরের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, যেখানের পানি ঘন ঘনই লবণাক্ত পানি দ্বারা দূষিত হয় এবং অবশেষে মানুষের ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ে।
সাম্প্রতিক কোনো পরিক্ষা-নিরীক্ষা দ্বারা পানি সংকট অথবা লবণাক্ততার স্তরের উপর গবেষণা পরিচালনা করা হয়নি, বিশেষ করে স্বাগতিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে এবং কক্সবাজারের পার্শ্ববর্তী এলাকায়। কিন্তু, ২০১৯ সালের একটি গবেষণায় চকোরিয়া উপজেলার লবণাক্ততা, শুকনা মরশুমে, এক তৃতীয়াংশ টিউবওয়েল অতিরিক্ত সোডিয়াম দ্বারা দূষিত, যখন ২০০ মিটারের অধিক গভীর কূপের পানি লবণাক্ত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
রোহিঙ্গা জনসমাগম ছাড়াও, বন উজাড়, পাহাড় কাটা, খাল খনন, পুকুর ও জলাধার ভরাট করা, অতিরিক্ত পরিমাণে ভূগর্স্থ পানি ব্যবহার করা, অপরিকল্পিত নির্মাণকার্য পরিচালনা করা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কক্সবাজারের পানির স্তর অবিচলিতভাবে নেমেই চলেছে, সেই সাথে সুপেয় পানির স্বল্পতার দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
স্বাগতিক জনগোষ্ঠীদেরকে উদ্দেশ্য করে সরকার ইতিমধ্যে পানি সংকটকে চিহ্নিত করেছে ও কয়েকটি প্রকল্প শুরু করেছে, সুপেয় পানির টেকসই বিকল্প হিসেবে বৃষ্টির পানি সঞ্চয় এবং সংরক্ষণ করতে উৎসাহিত করা হচ্ছে।
সরকারী বরাদ্দ ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির পাশাপাশি কক্সবাজারে সুপেয় পানির সংকট মোকাবিলা করার জন্য ভূগর্ভের পানির ব্যবহারকে রোধ, বড় আকারের পুকুর, খাল ও জলাধার খনন করে বৃষ্টির পানি ও সুপেয় পানির সংরক্ষণ করার মত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।
ব্র্যাক, পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম এনজিও, গভীর কূপ, নলকূপ স্থাপন ও পাইপের মাধ্যমে কক্সবাজারে ক্লোরিনযুক্ত পানি সরবরাহ করছে, এতে করে রোহিঙ্গা ও স্বাগতিক জনগোষ্ঠী উভয়ের জন্য সুপেয় পানির যোগান হচ্ছে, পৃথিবীর সর্ববৃহৎ শরণার্থী শিবির চলমান রাখার জন্য যৌক্তিক প্রতিকূলতার সম্মুখীন হওয়ায় এই সহায়তার ধারণক্ষমতা অনিশ্চয়তায় বিরাজমান।
বিশুদ্ধ সুপেয় পানির সুবিধা একটি মৌলিক মানবাধিকার, তারপরেও বাংলাদেশের উপকূলীয় সম্প্রদায়ের মানুষেরা এই ক্রমবর্ধ্মান প্রতিকুলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেই চলেছে।
একটা সময়ের মৌলিক সুবিধা বর্তমানে একটি দৈনিক প্রতিযোগিতার ন্যায় – স্বাগতিক জনগোষ্ঠীরা পানি আনার জন্য অতিরিক্ত শ্রম ব্যয় করছে, নিকটবর্তী গ্রামগুলো থেকে পানি সংগ্রহ করার জন্য পাইপলাইন স্থাপন করছে এবং শোধনাগার থেকে পরিশোধিত পানি কেনার বোঝা বহন করে চলেছে।