
ছবি: ক্যানভা প্রো’র মাধ্যমে আরজু গেবুলায়েভার তৈরি
তুরস্কের সংসদে ১৯ এপ্রিল উগ্র ইসলামপন্থী দল হুদা-পিএআর (মুক্ত কারণ পার্টি) উপস্থাপিত একটি খসড়া আইন এলজিবিটিকিউ+ সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বৈষম্যমূলক অবস্থানের জন্যে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। হিজবুল্লাহর উত্তরসূরি হিসেবে পরিচিত এই দলটি তুরস্কের দণ্ডবিধি ও রেডিও-টেলিভিশনের প্রতিষ্ঠা ও সম্প্রচার পরিষেবা সম্পর্কিত আইনসহ বেশ কয়েকটি মূল আইনি বিধান সংশোধনের চেষ্টা করছে।
খসড়া আইনটির কথিত লক্ষ্য “সাধারণ নৈতিকতা, শালীনতা ও বিনয়ের মতো সামাজিক মূল্যবোধের ক্ষয় রোধ” এবং “জনশৃঙ্খলা ও পরিবারের প্রতিষ্ঠানের জন্যে হুমকি কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে লড়াই” হলেও এটি স্পষ্টভাবে এলজিবিটিকিউ+ অস্তিত্বকে “মানব প্রকৃতি, পরিবার এবং শেষ পর্যন্ত সামাজিক কাঠামো ও মূল্যবোধের” জন্যে হুমকি চিহ্নিত করে।
খসড়া আইনের পিছনে থাকা ২০২৩ সালের মে মাসে সাধারণ নির্বাচনের আগে গঠিত দলটি পিপলস অ্যালায়েন্সের (ক্ষমতাসীন জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির সমর্থনে) অংশ ছিল। এটি এলজিবিটিকিউ+ বিরোধী অবস্থান এবং নারীর অধিকার সম্পর্কে বিতর্কিত দৃষ্টিভঙ্গির জন্যে পরিচিত।
খসড়া আইনে বিতর্কিত প্রস্তাবগুলির মধ্যে রয়েছে “অশ্লীল আচরণ”-এর অপরাধ পুনর্নির্ধারণ করে একই জৈবিক লিঙ্গের মধ্যে সংঘটিত হলে তিন থেকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ডের বিধান থাকবে। খসড়া আইনটি নিজের জৈবিক লিঙ্গ গোপন করে বিয়েকেও অপরাধ গণ্য করে এক থেকে তিন বছরের কারাদণ্ড আরোপ করে।
বিশেষ করে স্থানীয় এলজিবিটিকিউ+ অধিকার সংস্থা কেএওএস জিএল থেকে পাওয়া খসড়া নথির উল্লেখ করে বিয়ানেটের প্রতিবেদন অনুসারে নিচের প্রস্তাবগুলি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে:
সমকামী যৌন সম্পর্ক বা আচরণে জড়িত, প্রচার, উৎসাহিত বা প্রচারকারী ব্যক্তিদের জন্যেও শাস্তির পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। রেডিও-টেলিভিশন সর্বোচ্চ পর্ষদকে রেডিও, টেলিভিশন ও সিনেমা, চলচ্চিত্র, ধারাবাহিক, বিজ্ঞাপন এবং অনুরূপ সকল ধরনের যোগাযোগ চ্যানেলের মাধ্যমে সম্ভাব্য অপরাধ সংঘটন পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণের প্রস্তাবও করা হয়েছে।
দণ্ডবিধিতে সংযুক্তির জন্যে প্রস্তাবিত অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে:
সমকামী যৌন সম্পর্ক বা আচরণের প্রচার, উৎসাহ, প্রচার বা সমর্থকদের তিন থেকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড। এই অপরাধ লিখিত, দৃশ্যমান, শ্রবণযোগ্য, ঐতিহ্যবাহী, বা ডিজিটাল যোগাযোগ বা তথ্য প্রযুক্তি সরঞ্জামের যেকোনো রূপের মাধ্যমে সংঘটিত হলে শাস্তি অর্ধেক বৃদ্ধি করা হবে।
খসড়া আইনটি পাস হলে রেডিও ও টেলিভিশনের প্রতিষ্ঠা ও সম্প্রচার পরিষেবা সম্পর্কিত আইনের ৮ অনুচ্ছেদ যেভাবে সংশোধন করা হবে:
সমকামী যৌন সম্পর্ক বা আচরণের প্রচার বা উৎসাহিত করা, অথবা এই ধরনের বিষয়বস্তু প্রচার বা প্রচার করা নিষিদ্ধ। নারী নির্যাতনকে উৎসাহিত করে বা নারীদের শোষণ করে এমন অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা যাবে না।
এলজিবিটিকিউ+ অ্যাডভোকেসি গ্রুপ এবং আইন বিশেষজ্ঞরা যুক্তি দেন যে প্রস্তাবটি তুরস্কের সংবিধান এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তি লঙ্ঘন করে। একটি যৌথ বিবৃতিতে, এলজিবিটিকিউ+ সংগঠনগুলি ঘোষণা করেছে, “আমরা হুদা-পিএআর’কে জীবন হুমকির মুখে ফেলতে এবং তুরস্কে বসবাসকারী লক্ষ লক্ষ এলজিবিটিকিউআই+ মানুষ এবং তাদের পরিবারের মধ্যে ভয় জাগিয়ে তুলতে দেবো না।”
বিরোধীদলীয় ডিইএম পার্টির আইনপ্রণেতা ওজগুল সাকি খসড়া আইনটির নিন্দা করে বলেছেন, “এটি কোনো আইন নয়, এটি ঘৃণার স্পষ্ট ইশতেহার! এলজিবিটিকিউ+ জীবন কোনো অপরাধ বা বিকৃতি নয়!”
এই প্রস্তাবিত আইনটি তুরস্কে এলজিবিটিকিউ+ ব্যক্তিদের প্রতি ক্রমবর্ধমান বৈরিতার একটি বৃহত্তর নকশার অংশ। প্রাইড মার্চ ২০১৫ সাল থেকে নিষিদ্ধ এবং অংশগ্রহণকারীদের সহিংস পুলিশি হস্তক্ষেপের মুখোমুখি হতে হয়েছে।
রাষ্ট্রপতি রিসেপ তাইয়িপ এরদোয়ানসহ শাসক দলের কয়েক ডজন সদস্য বছরের পর বছর ধরে সম্প্রদায়টির সদস্যদের তিরস্কার, অস্তিত্ব প্রত্যাখ্যান ও দানবীয়করণ করেছে। ধর্ম বিষয়ক অধিদপ্তর ২০২০ সালের এপ্রিলে সম্প্রদায়ের সদস্যদের রোগ ছড়ানোর দায়ে অভিযুক্ত করেছিল। রাষ্ট্রপতি এরদোয়ান ২০২১ সালে বলেছিলেন “এলজিবিটি বলে কিছু নেই।”
তুরস্ক সরকার ২০২১ সালে সমকামিতার প্রচারের অভিযোগে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা মোকাবেলার লক্ষ্যে একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি ইস্তাম্বুল কনভেনশন নিজেকে থেকে প্রত্যাহার করে নেয়, যা প্রান্তিক গোষ্ঠীগুলিকে রক্ষা থেকে আরো পিছু হটার ইঙ্গিত দেয়।
একেবারে সাম্প্রতিক সাধারণ নির্বাচনে সম্প্রদায়টির সদস্য ও তাদের সমর্থকদের লক্ষ্য করে ঘৃণা ও বৈষম্যের বিস্তৃত আখ্যান ছিল অন্যতম আলোচ্য বিষয়। নির্বাচনের আগে রাষ্ট্রপতি এরদোয়ান টেলিভিশনে তার সমর্থকদের বলেছিলেন, ” এলজিবিটি হলো পরিবারের প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করানো একটি বিষ। ৯৯ শতাংশ মুসলমানের দেশ হিসেবে আমাদের পক্ষে এই বিষ গ্রহণ করা সম্ভব নয়।”
বর্তমানে প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুলেমান সোয়লু সমকামী ব্যক্তিদের “বিকৃত” বলে অভিহিত করে তাদের “সন্ত্রাসী সংগঠনের প্রচারণা” হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এছাড়াও সাধারণ নির্বাচনের আগে প্রাক্তন মন্ত্রীর অভিযোগ – এলজিবিটিকিউ+ “প্রাণী ও মানুষের মধ্যে বিয়েকেও অন্তর্ভুক্ত করে।” এদিকে তুরস্কের বিচারমন্ত্রী বেকির বোজদাগ “এলজিবিটি ও অনেক বিকৃতিকে বৈধতা ও স্বাভাবিকীকরণ” করার চেষ্টার দাবি করে বলেন, “সমাজের প্রতিটি সদস্যকে নেতিবাচকতা, বিচ্যুত ও বিকৃত বোঝাপড়া থেকে রক্ষা করা রাষ্ট্রের প্রাথমিক কর্তব্য।”
ইস্তাম্বুলে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে একটি এলজিবিটিকিউ+ বিরোধী সমাবেশে পারিবারিক মূল্যবোধ রক্ষার ব্যানারে আইনি পরিবর্তন ও সকল এলজিবিটিকিউ+ সংগঠন বন্ধের আহ্বান জানানো হয়।
এরদোয়ান ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে নতুন বছরকে “পরিবারের বছর” ঘোষণা করেন। রাষ্ট্রপতির উদ্দেশ্য ছিল দেশের ক্রমহ্রাসমান জন্মহার মোকাবেলা এবং তার মতে, এই পতন তুরস্কের জন্যে একটি “অস্তিত্বগত হুমকি।” সেসময় তিনি এলজিবিটিকিউ+ আন্দোলনকে “বিকৃত,” “ক্ষতিকারক” ও ক্রমহ্রাসমান জন্মহারের কারণ হিসেবে লক্ষ্যবস্তু করেছেন। তাকে ১৩ জানুয়ারি উদ্ধৃত করে বলা হয়, “লিঙ্গ নিরপেক্ষকরণ নীতির প্রাথমিক লক্ষ্য হলো এলজিবিটি-কে পরিবার ও পারিবারিক প্রতিষ্ঠানের পবিত্রতা ভঙ্গের একটি মুগুর হিসেবে ব্যবহার করা।”
মানবাধিকার পর্যবেক্ষক ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ মানবাধিকার সংস্থাগুলি এলজিবিটিকিউ+ ব্যক্তিদের সাথে তুরস্কের আচরণের সমালোচনা করে রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ ও কথাবার্তা সম্প্রদায়টির জন্যে ক্রমবর্ধমান বিপজ্জনক পরিবেশ তৈরি করেছে বলে সতর্ক করেছে।
মধ্যপ্রাচ্যের চোখের সাথে এক সাক্ষাৎকারে কাওস জিএল-এর একজন প্রচারক দামলা উমুত বলেন, “এই খসড়া আইনটি পরিবারগুলিকে রক্ষা করার বিষয়ে নয়; এটি দেশের এলজিবিটিকিউ+ সক্রিয়তা ও সংগঠনগুলির অস্তিত্বকে অপরাধীকরণের বিষয়ে।”
আন্তর্জাতিক লেসবিয়ান, গে, বাইসেক্সুয়াল, ট্রান্স ও ইন্টারসেক্স সমিতি (আইএলজিএ) ইউরোপ তার সাম্প্রতিক ৪৯-দেশের রংধনু ইউরোপ মানচিত্র ও সূচকে তুরস্ককে ৪৬ তম স্থান দিয়েছে। সংস্থাটি এক বিবৃতিতে ২০২৫ সালের মার্চ মাসে তুরস্কের বিচার মন্ত্রণালয়কে “খসড়া সংশোধনীগুলি অনির্দিষ্টকালের জন্যে প্রত্যাহার ও দেশটির সংসদকে প্রস্তাবিত আইন সংশোধনীগুলি প্রত্যাখ্যানের” আহ্বান জানিয়েছে, কারণ এটি “সাধারণ জনগণকে কোনো অতিরিক্ত সুবিধা না দিয়ে তুরস্কে এলজিবিটি+ মানুষের জীবনকে আরো কঠিন করে তুলবে।”